ইরানের জন্দিশাপুর: খুজেস্তানের হৃদয়ে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়
(last modified Tue, 03 Jun 2025 11:47:12 GMT )
জুন ০৩, ২০২৫ ১৭:৪৭ Asia/Dhaka
  • জন্দিশাপুর: খুজেস্তানের হৃদয়ে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়
    জন্দিশাপুর: খুজেস্তানের হৃদয়ে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়

পার্স টুডে : বর্তমান দেজফুল শহরের ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, ইরানের খুজিস্তানের উত্তর সমভূমিতে প্রাচীন জন্দিশাপুর শহরের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত; যা একদিন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কেন্দ্র ছিল।

প্রতিষ্ঠা ও ইতিহাস

সাসানীয় সম্রাট শাপুর প্রথম-এর নির্দেশে তৃতীয় খ্রিষ্টাব্দে জন্দিশাপুর শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন এর নাম ছিল 'ভেহ-আন্দিও-শাপুর' যার অর্থ 'আন্তাকিয়ার চেয়েও শ্রেষ্ঠ'। ২৬০ খ্রিষ্টাব্দে, দক্ষিণ তুরস্কে অবস্থিত এডেসা নামক স্থানে এক যুদ্ধে শাপুর রোমের সম্রাট ভ্যালেরিয়ানকে পরাজিত করেন এবং তাকে অনেক সৈন্যসহ বন্দি করেন।

ওই যুদ্ধে জয়লাভের পর, শাপুর আন্তাকিয়ার সৌন্দর্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ইরানে অনুরূপ একটি শহর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এ কাজে তিনি রোমান বন্দিদের ব্যবহার করেন যারা রোমান স্থাপত্যবিদ্যায় দক্ষ ছিল। শহরটি নির্মাণের জন্য তিনি সেই স্থান বেছে নেন যেখানে শাপুরের সৈন্যরা জমায়েত হতো। সেখানে তিনি হিপোডামাসের (খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর গ্রীক বিজ্ঞানী) স্থাপত্য শৈলীতে একটি শহর নির্মাণ করেন।

শহরের নকশা

শহরটির নকশা ছিল প্রশস্ত ও সোজা বুলেভার্ড, ছেদকৃত রাস্তাঘাট, সমান্তরাল গলি এবং এক থেকে তিন তলা পর্যন্ত ভবন। এই শহর ছিল এক ধরনের দাবার বোর্ডের মতো – আয়তাকার নকশা খুজিস্তানের সমভূমিতে খোদাই করা, যা ছিল চলাচলের এবং স্থান ব্যবহার করার এক কার্যকরী ব্যবস্থা।

জ্ঞানের কেন্দ্র

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জন্দিশাপুর প্রাচীন খুজিস্তানের সাতটি প্রধান শহরের মধ্যে গণ্য হত। এর খ্যাতি কেবল কৌশলগত অবস্থানের জন্য নয় বরং ইরানি, গ্রীক, ভারতীয় ও রোমান জ্ঞান ঐতিহ্যের সমন্বয়ের জন্য ছিল।

প্রাথমিকভাবে, শহরটি 'শাপুর প্রথম'-এর একটি সামরিক দুর্গ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু এর উর্বর জমি ও সুন্দর বাগানের কারণে এটি দ্রুত একটি বৈজ্ঞানিক-চিকিৎসা কেন্দ্রে পরিণত হয়। 'শাপুর প্রথম' গ্রীক চিকিৎসা গ্রন্থগুলো পাহলভী ভাষায় (সাসানীয় রাজদরবারের বৈজ্ঞানিক ভাষা) অনুবাদের নির্দেশ দেন।

কিন্তু জন্দিশাপুরের স্বর্ণযুগ ছিল খসরু আনুশিরভানের শাসনামলে, যখন সেখানে একটি বিশাল হাসপাতাল নির্মিত হয়েছিল এবং শহরের মেডিকেল স্কুল সাসানীয় সাম্রাজ্যে চিকিৎসা ও জ্ঞানের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিতি পায়। মধ্যযুগে, পণ্ডিতরা জন্দিশাপুরকে একটি বিশিষ্ট চিকিৎসা ও শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করতেন।

বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়

জন্দিশাপুরকে সঠিকভাবেই ইতিহাসের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায়, যেখানে প্রথমবারের মতো একাডেমিক কাঠামোতে হিপোক্রেটিক মেডিসিন শিক্ষা দেওয়া হতো। এই শহর প্রাচীন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র ও পণ্ডিতদের আকর্ষণ করত—নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান, যারা গ্রীক গ্রন্থের সিরিয়াক অনুবাদ এনেছিলেন, থেকে শুরু করে ভারতীয় গণিতবিদ ও গ্রীক দার্শনিকরা।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সমন্বিত চিকিৎসা বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল, যা ভারত, ইরান, সিরিয়া ও গ্রিসের জ্ঞানের মিশ্রণ ছিল। এমনকি প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রচনাও পাহলভীতে অনূদিত ও পড়ানো হতো।

ইতিহাসবিদদের মতে, শহরের প্রতিষ্ঠাতা শাপুর প্রথম একটি ব্যাপক অনুবাদ প্রকল্পের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং অসংখ্য গ্রীক চিকিৎসা গ্রন্থ পাহলভীতে অনূদিত হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে, জন্দিশাপুরের লাইব্রেরি বুদ্ধিবৃত্তিক বৈচিত্র্যের প্রতীকে পরিণত হয়।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরানি চিকিৎসকরা গ্রীক দার্শনিক, সিরিয়াক ভাষী বিজ্ঞানী ও ভারতীয় গণিতবিদদের পাশাপাশি কাজ করতেন। কেউ কেউ বলেন, এই শহরই পরবর্তীতে বাগদাদের বিখ্যাত বাইতুল হিকমায় যে বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, তার পথ প্রশস্ত করেছিল।

অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক হৃদয়

জন্দিশাপুর কেবল একটি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না; সাসানীয় সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ইয়াজদগার্দ তৃতীয়ের মুদ্রা এই শহর ও সিস্তান অঞ্চলে তৈরি হতো। এখানে সুগন্ধি তৈরির কারখানা, বস্ত্রশিল্প ও রাজকীয় উৎপাদন কেন্দ্রও গড়ে উঠেছিল।

পতন ও অবিচ্ছেদ্য উত্তরাধিকার

নবম ও দশম শতাব্দীতে, বাগদাদের উত্থানের সাথে সাথে জন্দিশাপুর ধীরে ধীরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে যায়। এর লাইব্রেরি, লেকচার হল ও বাগানগুলো নীরবতায় নিমজ্জিত হয়।

তবে সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতনের সাথে জন্দিশাপুরের মহিমার অবসান ঘটেনি। এর উত্তরাধিকার ইসলামি যুগের গভীর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। খ্যাতনামা বখতিশু পরিবার – চিকিৎসকদের এক বিশিষ্ট বংশ – এই ঐতিহ্য রক্ষা করে।

আজ, কেবল কিছু ধ্বংসাবশেষই বাকি আছে, যা করুণ নদীর তীরে প্রাচীন ঐশ্বর্যের গৌরবের স্মৃতি বহন করে চলেছে।# 
 

পার্সটুডে/এমএএআর/৩