সৌদি আরবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও বিদেশি শ্রমিকদের অবস্থা: পর্ব-এক
সব যুগে এবং সভ্য সমাজে সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো হয়। সেই সমাজে অন্যান্য নাগরিকদের মতো সংখ্যালঘু মানুষদেরও সমান অধিকার দেয়া হয়।
তবে একইসঙ্গে বিশ্বের অনেক দেশেই সংখ্যালঘুদেরকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এ প্রসঙ্গে আমরা সৌদি আরবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিদেশি শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে ধারাবাহিক আলোচনার ব্যবস্থা করেছি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সংখ্যালঘুদের অধিকার মেনে চলা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান ঘটানোর ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে এবং এ ব্যাপারে তারা ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা বিষয়ক ইউরোপীয় কনভেনশনের এক নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার মতো বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানবাধিকার এবং সংখ্যালঘু অধিকার অবিচ্ছেদ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেকোনো দেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। তাই সরকার কোনো বৈষম্য ছাড়াই ভাষাগত, জাতীয়তা কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের অধিকার রক্ষা করতে বাধ্য। ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘে গৃহীত এক ঘোষণা পত্রে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। ঘোষণায় বলা হয় প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক সংখ্যালঘু অধিকার দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এখানে সংখ্যালঘু বলতে জাতিসংঘ ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিগত ও সংস্কৃতিগত সংখ্যালঘুদের বুঝিয়েছে।
জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশ নিজের ভূখণ্ডের মধ্যে ধর্মীয়, ভাষাগত, জনগোষ্ঠীগত, সংস্কৃতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থকে রক্ষা করবে এবং তাদের পরিচিতির প্রকাশ ও উন্নয়ন ঘটাতে উৎসাহ দান করবে। বহু আগেই জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা বলা হয়। জাতিসংঘ তার মানবাধিকার সনদের ৩০ নম্বর ধারায় এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তির ২৭ নম্বর ধারায় ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিগোষ্ঠীগত ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু জনগণের অধিকারের বিষয়টিকে নিশ্চিত করার কথা বলেছে।
এবারে এ প্রসঙ্গে আমরা সৌদি আরবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করব। ২০১৭ সালে সৌদি আরবের বিভিন্ন সংস্থার জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে সেদেশে স্থানীয় উপজাতিদের বসবাস ছাড়াও এক কোটি ২০ লাখ বিদেশি নাগরিকের উপস্থিতি রয়েছে। সৌদি আরবে সংখ্যালঘু শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে যদিও দেশটির সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলে না কিন্তু ধারণা করা হয় সেদেশটির মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশের বেশি শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়। এ ছাড়া অল্প কিছু সংখ্যক ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষও নাগরিক হিসেবে সেখানে বসবাস করে।
বহু আগে থেকেই সৌদি আরবে তিনটি মূল ধারার জনগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করে আছে। এরা হচ্ছে হেজাযিয়ন, নজদি ও অসুরি জাতিগোষ্ঠী। সৌদি আরবের একেবারে কেন্দ্রে নজদি জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস যারা বর্তমানে দেশটির শাসন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছে। এরা মূলত একসময় যাযাবর জীবন যাপন করত এবং পরবর্তীতে দেশটির ক্ষমতা লাভ করে। মক্কা, মদিনা ও জেদ্দায় রয়েছে হেজাযিয়নদের বসবাস। ক্ষমতাসীনরা মনে করেন সরকার পরিচালনা করার মতো যোগ্যতা হেজাযিয়নদের নেই এবং এ কারণে প্রশাসনে এদের উপস্থিতি খুব কমই দেখা যায়। আর অশুরি জনগোষ্ঠী হচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিমের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দা।
সৌদি আরবে বসবাসকারী সংখ্যালঘু শিয়া মুসলমানদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। কিন্তু গত প্রায় আড়াইশ বছর ধরে তারা নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে। প্রচণ্ড শিয়া বিদ্বেষী সৌদি ওয়াহাবি শাসকবর্গ দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শিয়াদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে।
বিশেষ করে ধর্মীয় ক্ষেত্রে বড় ধরনের জুলুম করা হচ্ছে সৌদি আরবের শিয়া মুসলমানদের সঙ্গে। ফুয়াদ ইব্রাহিম সৌদি আরবে শিয়া মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে তার এক গ্রন্থে লিখেছেন, সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা কোনোভাবেই সেদেশে ধর্মীয় ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য অর্থাৎ ভিন্ন ধর্ম বা মাজহাবের অনুসারীদেরকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। শিয়া মুসলমানরা সৌদি নাগরিক হলেও তারা নিজ দেশেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত। সৌদি শাসকবর্গ শিয়া মাজহাবের তাওয়াস্সুল বা শাফায়াত করার আকিদা বিশ্বাসকে কুসংস্কার বলে মনে করে। তারা ইমামবাড়ায় শিয়া মুসলমানদের ধর্মীয় কার্যক্রম, বিশেষ দিবস উপলক্ষে বিশেষ পোশাক করা, শোকানুষ্ঠান পালন প্রভৃতির ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে রেখেছে।
শিয়া মুসলমানদের শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপের মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তারা চরম বৈষম্যের শিকার। সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় কাতিফ প্রদেশে বেশিরভাগ শিয়া মুসলমানদের বসবাস যারা তেল সমৃদ্ধ এলাকায় বসবাস করেও অর্থনৈতিকভাবে অন্য জনগোষ্ঠীর চেয়ে পিছিয়ে আছে। খ্যাতনামা লেখক রবার্ট ল্যাসি 'রাজাদের অন্দরে' নামক বইয়ে লিখেছেন, তেলসমৃদ্ধ শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলীয় কাতিফ প্রদেশ যদি সৌদি শাসকবর্গের অধীনে না থাকতো তাহলে ওই এলাকা আজ সমগ্র পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী, সমৃদ্ধ ও উন্নত অঞ্চল হিসেবে আবির্ভূত হতো। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিয়া অধ্যুষিত ও তেল সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েও এই এলাকা বর্তমানে সৌদি আরবের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া, অনুন্নত ও দরিদ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলের জনগণ পর্যাপ্ত শিক্ষা ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ও অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া পুঁজি বিনিয়োগেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ ১৯৮৭ সালে প্রথম কাতিফ প্রদেশেই অত্যাধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছিল।
সৌদি আরবের উগ্র ওয়াহাবি মাওলানারা শিয়া মুসলমানদের জবাই করা পশুর গোশত খাওয়াও হারাম বলে ঘোষণা দিয়েছে। শিয়াদেরকে কাফের ফতোয়া দিয়ে তাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকেও হারাম বলে ফতোয়া জারি করেছে। একদিকে ওয়াহাবি মাওলানারা শিয়াদের বিরুদ্ধে এ ধরণের ফতোয়া দিচ্ছে অন্যদিকে সৌদি সরকার শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে পরিকল্পিত উপায়ে দরিদ্র ও অধিকার বঞ্চিত করে রেখেছে।
এ ছাড়া, সৌদি সরকার সেদেশে বসবাসরত শিয়া মুসলমানদেরকে ধর্মীয় পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত রেখেছে। এমনকি চাকরির সুযোগ থেকেও তাদেরকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, দূতাবাস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানও ওয়াহাবিদের নিয়ন্ত্রণে চলছে এবং সেখানে শিয়া মুসলমানদের চাকরির সুযোগ নেই। এমনকি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদেও শিয়াদেরকে রাখা হয় না।
মোটকথা সৌদি আরবের শাসকবর্গ এবং ধর্মীয় লাইনের নীতিনির্ধারক সবাই শিয়া নাগরিকদের বিরুদ্ধে একাট্টা। তারা সর্বশক্তি দিয়ে শিয়া মুসলমানদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। #
পার্সটুডে/এমআরএইচ/ মো.আবুসাঈদ/১২