নভেম্বর ২৪, ২০২১ ১৮:০৪ Asia/Dhaka
  • ইসরাইলের আয়রন ডোম
    ইসরাইলের আয়রন ডোম

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় ইহুদিবাদী ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোমের কার্যকারিতা ও এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে আয়রন ডোমের কার্যক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আরো জোরদার হয়েছে।

চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলের হাইফা শহরের পেট্রোকেমিকেল কারখানায় বিস্ফোরণ, এপ্রিলে অধিকৃত রামাল্লা শহরে ইসরাইলের একটি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি কারখানায় বিস্ফোরণ এবং ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলের দিমোনা পরমাণু কেন্দ্রের কাছে সিরিয়ার একটি রকেট আছড়ে পড়ে। এ ছাড়া, সম্প্রতি গাজার ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম ফিলিস্তিনিদের বহু ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।

পাশ্চাত্যের কয়েকটি গণমাধ্যম ইসরাইলের এসব স্থাপনায় বিস্ফোরণ ও রকেট হামলার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে এ থেকে ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোমের দুর্বলতা ও ব্যর্থতাই ফুটে উঠেছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট 'সংঘাতের দোরগোড়ায় মধ্যপ্রাচ্য' শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছে, সিরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের দিমোনা পরমাণু কেন্দ্রের কাছে নিক্ষেপের ঘটনা থেকে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা ফুটে উঠেছে।

মিডিলইস্ট মনিটর ওয়েব সাইটের এক প্রতিবেদনে ইসরাইলের দিমোনা পরমাণু কেন্দ্রের কাছে সিরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনাকে ইসরাইলের জন্য অনেক বড় বার্তা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এতে লেখা হয়েছে দিমোনা কেন্দ্রের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। এমনকি গত কয়েক বছরের ঘটনাবলীতে ইসরাইলের সামরিক সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ অবস্থায় ইসরাইলের 'আয়রন ডোম' ফিলিস্তিনিদের কাছে হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে এবং তারা একে 'রেশমি ডোম' নামে অভিহিত করেছেন। তাই ইসরাইলি কর্মকর্তাদেরকে এটা মেনে নিতে হবে যে ইরান, সিরিয়া কিংবা হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকানোর ক্ষমতা তাদের নেই। 

গত মে মাসে গাজার ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে সামরিক ক্ষেত্রে ইসরাইলের দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রতিরোধের মুখে যুদ্ধ শুরুর ১২ দিন পর ইসরাইল যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সেথ যে ফ্রান্তেযম্যান ১২ দিনের যুদ্ধ  সম্পর্কে  মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসিতে এক নিবন্ধে লিখেছেন, অতীতের যে কোনো যুদ্ধের চেয়ে এবারের যুদ্ধের পার্থক্য হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা নজিরবিহীন ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট হামলা চালিয়েছে। আর এসব ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে ইসরাইলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব একটা সফলতা দেখাতে পারেনি। গাজা উপত্যকার হামাস ও তাদের সহযোগী যোদ্ধারা মনে করেন এবারের ১২ দিনের যুদ্ধ ছিল হামাসের জন্য বিরাট বিজয়। কেননা হামাস ইসরাইলের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু রকেট ছোড়ে এবং শেষ পর্যন্ত ইসরাইল যুদ্ধবিরতি করতে বাধ্য হয়। হামাসের প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্যাপক রকেট হামলা চালিয়ে ইসরাইলের আয়রন ডোম ব্যবস্থার কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা। যুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে ১৪০টি রকেট নিক্ষেপ করে।

কানাডার বারাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মাইকেল অর্মিস্ট্রাং ব্রিটেনের একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত নিবন্ধে লিখেছেন, 'ইসরাইলের সমরবিদরা প্রথমে ভেবেছিলেন সম্প্রতি সংঘটিত ১২দিনের যুদ্ধ ২০১৪ সালের যুদ্ধের মতোই হবে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর দেখা গেল গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তি অনেক বাড়িয়েছে এবং তা আরো ধ্বংস ক্ষমতা সম্পন্ন। এর আগে ২০০৮ সালে গাজার বিরুদ্ধে তিন সপ্তাহের যুদ্ধে ইসরাইল বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। তবে এবারের ১২ দিনের যুদ্ধের একটি ব্যতিক্রমী দিক হচ্ছে গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধারা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে বিপুল পরিমাণে রকেট নিক্ষেপ করেছিল যা কিনা ইসরাইলিদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছিল। প্রতিরোধ যোদ্ধারা যুদ্ধ শুরুর প্রথম ২৪ ঘন্টায় ৪৭০টি রকেট ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে নিক্ষেপ করেছিল। প্রতিদিন ৪০৮টি রকেট তারা নিক্ষেপ করতো। ২০১২ সালের যুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা দৈনিক ৩১৬টি এবং ২০১৪ সালের যুদ্ধে দৈনিক ১৯২টি করে রকেট নিক্ষেপ করতো।'

কানাডার বারাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহযোগী অধ্যাপক ও সামরিক বিশেষজ্ঞ তার নিবন্ধে আরো লিখেছেন, ফিলিস্তিনিদের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আগের চেয়ে আরো বেশি নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ছোঁড়া রকেটের অন্তত ৫০ ভাগই ইসরাইলের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। ২০১৪ সালের তুলনায় ফিলিস্তিনিদের এবারের যুদ্ধ ক্ষমতা ১৮ শতাংশ বেড়েছে। ফিলিস্তিনিরা এখন আরো বড় ও শক্তিশালী এবং আরো দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সক্ষম। এর আগের যুদ্ধগুলোতে তারা ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে হামলা চালিয়েছে কিন্তু এবারের ১২ দিনের যুদ্ধে তারা রাজধানী তেলআবিবেও হামলা চালিয়েছে।

সামরিক দিক দিয়ে ইসরাইলিদের দুর্বলতার আরেকটি দিক হচ্ছে, সেনাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। ইসরাইলের গণমাধ্যমগুলোর বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনারা সবচেয়ে বেশি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। এসব সেনারা নতুন যে কোনো যুদ্ধে যেতে ভয় পাচ্ছে এবং যুদ্ধ তাদের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এমনকি অনেকে সেনাবাহিনী থেকে পালিয়েছে।

মোটকথা, মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসরাইলি সেনাদের ভাব-মর্যাদা অনেক কমে গেছে। অথচ তারা নিজেদেরকে একসময় অপরাজেয় ভাবতো। এ অবস্থায় জনগণের মধ্যে ইসরাইলের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আগ্রহও কমে গেছে। এমনকি সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে খেদমতে নিযুক্তরাও পালিয়ে গেছে। আল মিয়াদিন নিউজ চ্যানেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইহুদিদের তথাকথিত প্রতিশ্রুত ভূমি রক্ষায় প্রথম দিকের অভিবাসীরা সেনাবাহিনীতে কাজ করাকে পবিত্র মনে করতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে এবং সেনা সদস্যরা যে কোনো অজুহাতে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়ার বা পালানোর চেষ্টা করছে। অবশ্য সেনাবাহিনী থেকে পালানোর ঘটনা নতুন নয় কিন্তু বিগত দিনের তুলনায় পালানোর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

ইসরাইলিদের দুশ্চিন্তার আরেকটি কারণ হচ্ছে তাদের গোয়েন্দা তথ্যে ব্যাপক ঘাটতি। গত জুলাইয়ে বেনগুরিয়ান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কাছে অগ্নি সংযোগ, সেপ্টেম্বরে ইসরাইলের জেলখানা থেকে ৬ জন ফিলিস্তিনি বন্দীর পলায়নের ঘটনা ছিল ইসরাইলের জন্য লজ্জাজনক । যদিও ইসরাইলি সেনারা ওই ৬ জনকে ফের আটক করেছে কিন্তু এসব ঘটনায় তাদের তথ্য ও নিরাপত্তাগত দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ