জুন ৩০, ২০২১ ১৯:১১ Asia/Dhaka
  • কালো তালিকা থেকে সৌদিকে বাদ দিয়ে ইয়েমেনের আনসারুল্লাহকে অন্তর্ভুক্তির রহস্য

ইয়েমেনের ব্যাপারে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন যুদ্ধ বিধ্বস্ত ওই দেশটির জনগণের জন্য আরেকটি বড় আঘাত। সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে এখনো নারী ও শিশুর মৃত দেহ উদ্ধার করা হচ্ছে। এসব নৃশংসতার বীভৎস ছবি ও ভিডিও সারা বিশ্বের মিডিয়ায় তুলে ধরা হচ্ছে এবং ইয়েমেনের বিরুদ্ধে অন্যায় নিষেধাজ্ঞার কারণে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটেরও তীব্র সমালোচনা হচ্ছে।

তারপরও জাতিসংঘ সম্প্রতি এক ঘোষণায় শিশু অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ইয়েমেনের জনপ্রিয় আনসারুল্লাহ সংগঠনকে নিষেধাজ্ঞা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। অন্যদিকে সৌদি বিমান হামলায় এ পর্যন্ত  হাজার হাজার ইয়েমেনি শিশু নিহত হলেও জাতিসংঘ শিশু হত্যাকারীর তালিকা থেকে সৌদি আরবের নাম বাদ দেয়ায় বিশ্বজুড়ে এ সংস্থার প্রতি সমালোচনা দিন দিন বাড়ছে।

ইয়েমেনের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রী তোহা আল মোতাওয়াক্কেল বলেছেন, 'সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের হামলায় এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি শিশু নিহত এবং চার হাজারের বেশি শিশু আহত কিংবা পঙ্গু হয়েছে। ইউনিসেফও স্বীকার করেছে ইয়েমেনের চার লাখ শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে যাদের মধ্যে ৮০ হাজার শিশু মৃত্যুর প্রহর গুনছে।' ইয়েমেনের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রী আরো বলেছেন, উত্তর ইয়েমেনের সাদা প্রদেশে সৌদি জঙ্গি বিমান থেকে এমন সব বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে যার তেজস্ক্রিয়ার প্রভাবে বহু শিশু জিনগত জটিল সমস্যায় ভুগছে। আহত বহু শিশু জরুরি চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থায় স্থল, আকাশ ও পানি পথে কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইয়েমেনের সাদা প্রদেশে চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। শুধু তাৎক্ষণিক চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের অভাবে সাদা প্রদেশের শতশত শিশু প্রাণ হারিয়েছে।

১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর শিশুদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক অধিকার রক্ষা বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে বহু দেশ শিশু অধিকার রক্ষা বিষয়ক সনদে সই করে এবং এ বিষয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন শুরু করে। ধারণা করা হচ্ছিল, সরকারগুলো শিশু অধিকার রক্ষা এবং তাদের অবস্থার উন্নয়নে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। এও আশা করা হচ্ছিল যে হয়তো শিশুদের চোখের পানি আর দেখতে হবে না, তারা সহিংসতার শিকার হবে না, জুলুম, নির্যাতন ও আগ্রাসনেরও শিকার হবে না।

বাস্তবতা হচ্ছে, শিশু অধিকার রক্ষা বিষয়ক কনভেনশন শিশুদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু তারপরও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষুধার্ত শিশুদের আর্তনাদ, যুদ্ধের কবলে পড়ে তাদের হতাহত হওয়া, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে যা মানব সভ্যতার জন্য লজ্জাজনক। একদিকে যেমন প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে মারণাস্ত্র তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে অর্থের অভাবে রোগশোক, ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে বিশ্বের বহু শিশু প্রাণ হারাচ্ছে।

শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যুদ্ধে। অথচ যেখানে শিশুরা আনন্দে, হাসিখুশিতে উৎফুল্ল থাকবে, খেলাধুলা করবে, লেখাপড়া শিখবে এবং আত্মিক ও শারীরিকভাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার কথা সেখানে তারা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কবলে পড়ে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো শিশু অধিকার রক্ষায় সুন্দর সুন্দর কথা বললেও বাস্তবে শিশুদের রক্ষায় তারা কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না।

জাতিসংঘ

২০১৬ সালের ২ জুনে জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে জানায় ইয়েমেনে শিশু হত্যার কারণে সৌদি আরব ও তার মিত্রদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সেইসঙ্গে ইয়েমেনের ৬০ শতাংশ শিশু মৃত্যুর জন্য সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটকেও দায়ী করা হয়েছিল। কিন্তু সৌদি আরবের প্রবল আপত্তি ও চাপের মুখে জাতিসংঘ শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে। সৌদি হুমকির  কারণে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন ওই ঘোষণার এক সপ্তাহ পরই শিশু হত্যাকারীর তালিকা থেকে সৌদি আরবের নাম বাদ দিতে বাধ্য হয় যা ছিল অযৌক্তিক এবং আন্তর্জাতিক সমাজকে বিস্মিত করেছিল।

সৌদি কর্মকর্তারা জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ওই কালো তালিকা থেকে সৌদি আরবের নাম বাদ দেয়া না হলে জাতিসংঘে অর্থ দেয়া বন্ধ করে দেয়া হবে। সে সময় ইয়েমেনের একটি শিশু জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে লেখা অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শি এক চিঠিতে বলেছিল, 'আমি বড় হয়ে যখন লেখাপড়া শেষ করব এবং জাতিসংঘের মহাসচিব হব তখন সৌদি আরবের বিচার করব। কেননা আমার স্কুলের বন্ধু আহমাদ যে কিনা আমার পাশে  বসত সৌদি আরব তাকে হত্যা করেছে। তারা যদি আমাকে হুমকি দেয় তাতে আমি ভয় পাব না। কেননা ততদিনে আমি বড় হয়ে যাব এবং আমি মরতে চাই না।'

এদিকে, শিশু হত্যার অভিযোগ তুলে জাতিসংঘ ইয়েমেনের জনপ্রিয় আনসারুল্লাহ সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এর প্রতিবাদে রাজধানী সানায় হাজার হাজার শিশু-কিশোর সমবেত হয়ে জাতিসংঘের এ পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, 'আমরা জানি কারা সত্যিকারের খুনি। তারাই আসল হত্যাকারী যারা আমাদেরকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, খাদ্য আসতে দিচ্ছে না এবং জাতিসংঘ এ জঘন্য অন্যায়ের সহযোগী।' 

ইয়েমেনে শুধু যে গণহত্যা চলছে তাই নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মানবাধিকারের দাবিদার সরকারগুলো তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসছে না। ইয়েমেন, সিরিয়া ও ফিলিস্তিন শিশুহত্যার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় বিশ্বের সব সরকার, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তি ও মানবিক ত্রাণ সাহায্যকারী সংস্থাগুলো এসব অঞ্চলের শিশুদের রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে শিশু অধিকার রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। আরব দেশগুলো তাদের তেল বিক্রিবাবদ অর্থ অস্ত্রক্রয়সহ অন্য অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করছে। ইয়েমেনে শিশু হত্যায় শুধু যে সৌদি আরব জড়িত তা নয় মানবাধিকারের দাবিদার পাশ্চাত্যের সরকারগুলোও তাদের স্বার্থের কারণে সৌদি অপরাধযজ্ঞের বিষয়ে টু শব্দটিও করছে না।

এ কারণে সৌদি আরব আরো বেপরোয়া হয়ে আন্তর্জাতিক সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইয়েমেনে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জাতিসংঘ ইয়েমেনের জনপ্রিয় আনসারুল্লাহ সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সৌদি আরব আরো বেশি ঔদ্ধত্য হয়ে উঠেছে।

জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনসারুল্লাহ কোনো অস্ত্র আমদানি করতে পারবে না। আনসারুল্লাহর নেতা সাইয়্যেদ আবদুল মালিক হুথি ও তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ মিত্রের সফর ও সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

এর প্রতিক্রিয়ায় ইয়েমেনের হুথি আনসারুল্লাহ আন্দোলন বলেছে, সৌদি আরবের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে জাতিসংঘ। গুতেরেসের এ সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেছে আনসারুল্লাহ আন্দোলন। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন  

ট্যাগ