শান্তিতে নোবেল জয়ী ইসরাইলি সন্ত্রাসী মোনাচিম বেগিন
৯ মার্চ শনিবার ছিল দেইর ইয়াসিনের কসাই নামে পরিচিত ইহুদিবাদী নেতা মোনাচিম বেগিনের মৃত্যু বার্ষিকী। এই ইসরাইলি সন্ত্রাসী ১৯৪৮ সালের বসন্তের এক সকালে কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই নিজের নেতৃত্বাধীন জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইরগুন’কে নিয়ে পশ্চিম তীরের দেইর ইয়াসিন গ্রামে হানা দেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত ইরগুন বাহিনী শত শত বছরের সভ্যতাসমৃদ্ধ ফিলিস্তিনি গ্রামটিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় এবং ওই গ্রামের সব মানুষ সন্ত্রাসী এই বাহিনীর হামলায় নিহত হয়।
১- পরিবার:
সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী, অন্যতম উগ্র ইহুদিবাদী নেতা এবং ইসরাইলের ডানপন্থি লিকুদ দলের প্রতিষ্ঠাতা মোনাচিম বেগিন ১৯১৩ সালে পোল্যান্ডের ব্রেস্ট-লিতোফেস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করে।
তার পিতা উলফ ডোভ বেগিন ছিল একজন উগ্র ইহুদিবাদী এবং তার মা এশিয়া কুরোসোভস্কি একজন সুপরিচিত ইহুদি পুরোহিত পরিবার থেকে উঠে এসেছিল।
২- সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু
মোনাচিম বেগিন ১৯২৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ‘জাবোটিনস্কি’র চিন্তাভাবনা এবং মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তার উদ্ভাবিত মতাদর্শ ও পদ্ধতি অর্থাৎ একটি সংশোধনবাদী ইহুদিবাদী মতবাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
এই আগ্রহের কারণে সে কোনো কালক্ষেপণ না করেই উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘বেতারে’ যোগদান করে। ওই গোষ্ঠীতে সে উন্নতির সোঁপানগুলো দ্রুত অতিক্রম করে এবং পরের বছরই ব্রেস্ট-লিতোফেস্ক শহরে বেতারের কমান্ডার নিযুক্ত হয়।
১৯৩৫ সাল নাগাদ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বেতার যথেষ্ট প্রসার লাভ করে এবং বেগিন এই গোষ্ঠীর একটি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে। একই বছর ক্রাকোতে অনুষ্ঠিত বেতারের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বেগিন এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেতাদের সারিতে মঞ্চে উপবিষ্ট হওয়ার সুযোগ পায়।
৩- ফিলিস্তিনে আগমন
১৯৪২ সালে মোনাচিম বেগিন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে।
সেখানে যাওয়ার পর বেগিন প্রথমে হাইফা এবং পরে বায়তুল মোকাদ্দাস শহরে ব্রিটিশ সেনা কমান্ডারদের জন্য ইংরেজি দোভাষী হিসেবে কাজ শুরু করে। একই বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বেতারের সকল দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত হয়।
এরপর ১৯৪৩ সালে সামরিক ও সন্ত্রাসী সংগঠন ‘ইরগুন’র ভারপ্রাপ্ত প্রধান হয় মোনাচিম বেগিন। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত আরব ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যায় বেগিন। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, সরকারি স্থাপনা ধ্বংস করার মতো নাশকতামূলক তৎপরতা চালানো ছিল তার নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান কাজ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইহুদিবাদী মতবাদের প্রচার ও প্রসারকারীরা তার এসব তৎপরতাকে সমর্থন জানাত।
বেগিন ও তার সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইরগুন এ সময়ে যেসব ভয়াবহ অভিযান পরিচালনা করে সেগুলোর মধ্যে ছিল ‘বাদশা দাউদ’ হোটেলে বোমা হামলা ও দেইর ইয়াসিনের নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনা করা।
বেগিনের সন্ত্রাসী তৎপরতা এতটা বিস্তৃত হয়ে পড়ে যে, ফিলিস্তিনের তৎকালীন শাসক ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা বেগিনকে ‘সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ইহুদিবাদী’ সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করে।
পরবর্তী জীবনে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে দেয়া এক বক্তব্যে বেগিন বলেছিল, “আমি একজন সাবেক সন্ত্রাসী!”
৪- রাজনৈতিক জীবন
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড জবরদখল করে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বেগিন ইহুদিবাদী ফ্যাস্টিস্ট রাজনৈতিক দল ‘হিরোত’ (স্বাধীনতা) গঠন করে।
হিরোত দলের সভাপতি থাকার সময় আর্থিক সহায়তা চাইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করে বেগিন। ওই সফরে হানা আর্নেটসহ আরো কিছু ইহুদি চিন্তাবিদ নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি খোলা চিঠি পাঠিয়ে মোনাচিম বেগিনকে এমন একটি দলের নেতা বলে উল্লেখ করেন যেটি ‘এর সংগঠন, কর্মপদ্ধতি, রাজনৈতিক দর্শন এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের’ দিক দিয়ে নাৎসি এবং ফ্যাসিস্ট দলের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। ওই চিঠিতে দেইর ইয়াসিন গ্রামে বেগিনের নেতৃত্বে চালানো গণহত্যার কথা উল্লেখ করা হয় যাতে ২৪০ ফিলিস্তিনি আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নিহত হয়েছিলেন। ওই চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে নোবেলজয়ী ইহুদি পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইনও ছিলেন।
মোনাচিম বেগিন ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে সবগুলো ইহুদিবাদী ডানপন্থি দলের সমন্বয়ে লিকুদ পার্টি গঠন করে এবং ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে এই দল অপ্রত্যাশিতভাবে বিজয় হয়।
নির্বাচনে বেগিন বিজয়ী হওয়ার পর বিশ্ব ইহুদিবাদী চক্র ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে তার সন্ত্রাসী চরিত্রকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। তারা তাকে একজন নীতিবান রাজনীতিবিদ, স্পষ্টবাদী এবং সৎ ব্যক্তি হিসাবে তুলে ধরতে থাকে।
৫- শান্তিতে নোবেল
শান্তিতে অবদান রাখা ব্যক্তিদের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার চালু করা হলেও একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, পুরস্কারটি এখন গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ‘নিরপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
মহাত্মা গান্ধীর মতো ব্যক্তিত্বরা যখন নোবেল পুরস্কার পাননি তখন এই শান্তি পুরস্কার গণমানুষের রক্তে রঞ্জিত হাতগুলোতে তুলে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে হেনরি কিসিঞ্জার থেকে শুরু করে মোনাচিম বেগিনের মতো সন্ত্রাসীর কথা উল্লেখ করা যায় যারা এই পুরস্কার পেয়েছে।
১৯৭৮ সালে মিশরের সঙ্গে কথিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করায় মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে বেগিন। তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ায় বিশ্বব্যাপী এর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়।
৬- রাজনৈতিক জীবনের অবসান ও মৃত্যু
১৯৮১ সালের নির্বাচনে বেগিন আবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয় কিন্তু বয়সের ভারে আক্রান্ত বেগিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮২ সালের ৯ মার্চ তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।#
পার্সটুডে/এমএমআই/জিএআর/১০