দেখব ঘুরে ইরান এবার: গিলানের ইকো-মিউজিয়াম
আবহাওয়া কিংবা অঞ্চলভেদে গিলানের একেক অঞ্চলের গ্রামীণ স্থাপত্যগুলোর ডিজাইন একেক রকমের। এখানে বহু সংস্কৃতি ও গোত্রের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে একসাথে বসবাস করে। সেজন্যে প্রকৃতির মাঝেও এসেছে অনেক বৈচিত্র। এইসব বৈচিত্র থেকেই অনুমান করা যায় সে সময় এখানকার কোন কোন অধিবাসীর জীবন যাপন পদ্ধতি কীরকম ছিল। গিলানের গ্রামীণ ঐতিহ্যের সর্বপ্রথম নিদর্শন হলো এখানকার ইকো-মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামেই উন্মুক্ত পরিবেশে কাটানো তখনকার জনজীবন ও তাদের সংস্কৃতির ধরণ বা ইতিহাসের পরিচয় সংক্ষেপে হলেও জানা যায়।
এই মিউজিয়ামটি দুই শ ষাট হেক্টর ভূমির ওপর গড়ে উঠেছে। রাশত তেহরান মহাসড়ক থেকে আঠারো কিলোমিটার দূরে সারাভন বনানী পার্কের ভেতর অবস্থিত এই যাদুঘরটি। এই যাদুঘর নিয়ে প্রাথমিক গবেষণার কাজ এরিমধ্যে শুরু হয়েছে। গিলানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংস্থা ইউনেস্কো এবং নৃতাত্ত্বিক ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষকদের সহযোগিতায় ২০০২ সাল থেকে এই গবেষণার কাজ শুরু হয়েছে।
নৃতাত্ত্বিক গবেষণা এবং স্থাপত্য বিষয়ক গবেষণায় আলোকে গিলানের সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যের ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক ৯টি বিভাগ করা হয়েছে। মিউজিয়াম কমপ্লেক্সের ভেতরেই প্রতিটি বিভাগের জন্যে আলাদাভাবে গবেষণা সেলের আয়োজন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে গবেষণার কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে সেফিদ রুদের পূর্বাঞ্চলীয় সমতল ভূমির স্থাপত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট ২৭ টি কাঠামো এবং কেন্দ্রিয় সমতল ভূমির স্থাপত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট ১৪টি কাঠামো নিয়ে কাজ চলছে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গিলানের বিভিন্ন এলাকার মূল্যবান স্থাপনাগুলোকে গবেষকগণ নির্বাচন করেছেন। গিলানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পক্ষ থেকে কিনে নেওয়ার পর ভবনগুলোর বিভিন্ন সরঞ্জাম বা পার্টসের ওপর নম্বর দিয়ে দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। এরপর মিউজিয়াম এলাকায় মূল নকশা অনুযায়ী এগুলোকে পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণে মূল কাঠামো অক্ষুন্ন রয়ে গেছে। সেইসাথে যতোটা সম্ভব হয়েছে নির্মাণ সামগ্রীও মূল স্থাপনার সাথে মিল রেখেই কেনা হয়েছে। তাই ভবনগুলোকে তার আগের মতো অস্তিত্ব বজায় রেখেই পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার মতো, তা হলো এখানকার পুরোণো স্থাপনাগুলোর প্রতিটি ভবন পুনরায় নির্মাণ করার ক্ষেত্রে এখানকার প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকেই বেশিরভাগ কাজে লাগানো হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে প্রতিরোধ করার জন্যে কিংবা আবহাওয়া অর্থাৎ আর্দ্রতার মতো দিকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে সেই পুরোণো আমলেও ব্যবস্থা ছিল। পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে সেই সিস্টেমগুলোকেও অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। একইভাবে আরো একটি জিনিস লক্ষ্য করা যাবে এই বাড়িগুলোতে। সেটা হলো সামাজিক মর্যাদা বা শ্রেণীভেদে গিলানের গ্রামীণ অধিবাসীদের জীবনযাপনের ধরন বা পদ্ধতির বিষয়টিও সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় ভবনগুলোর কাঠামোগত বৈচিত্র থেকে।

এখানকার যেসব ভবনকে পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোর বয়স বা প্রাচীনত্ব হবে দেড় শ বছরের মতো। এইসব বাসাবাড়ির মালিক যারা ছিলো তাদের অনেকেরই ছবি বাসার ভেতরে নজরে পড়বে। এইসব বাড়ির জিনিসপত্র বা সরঞ্জাম তাদের মালিকদের কাছ থেকে কিনে নেওয়া হয়েছে এবং মিউজিয়াম বিশেষজ্ঞগণ ঘরের সাজসজ্জার সামগ্রীসহ কৃষি সরঞ্জামেরও বহু উপাদান সংগ্রহ করেছেন। এগুলোর বাইরেও গ্রামের অধিবাসীরা যেসব জিনিসপত্র ব্যবহার করতেন সেগুলোর বেশিরভাগই গ্রামবাসীরা ঐ মিউজিয়ামে দান করে দিয়েছেন।
সবোর্পরি বলা যায় গিলানের গ্রামীণ ঐতিহ্য মিউজিয়ামে চেষ্টা করা হয়েছে গিলানের সংস্কৃতি এবং রীতি নীতি, আচার প্রথাগুলোকে তুলে ধরতে। সেখানকার মানুষেরা কীভাবে চাষাবাদ করতো, কী ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করতো, কৃষিকাজের বাইরে পশুপাখি পালন করা, রেশম গুটির চাষ করা ইত্যাদির একটা রূপও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে এই যাদুঘরে। গিলানের খাবার দাবারের ঐতিহ্যটিও ফুটিয়ে উঠেছে যাদুঘরে সংরক্ষিত সামগ্রীতে। গিলানের মূল খাবার হচ্ছে ভাত। তবে ভাতের পাশাপাশি বিচিত্র শাকসব্জি, ডিম, দুগ্ধজাত পণ্য, পাখির মাংস, নদী কিংবা সামুদ্রিক মাছের সমাহার তো রয়েছেই। কতো রঙীন এবং বিচিত্র এখানকার খাবার দাবার একবার ভেবেই দেখুন।

গিলানের অধিবাসীদের দ্বিতীয় প্রধান খাবার হলো রুটি। এই রুটি এলাকাভেদে বিভিন্ন রকমের। প্রস্তুত প্রণালীও আলাদা আলাদা। গমের আটা, চালের আটা, মুরগির ডিম, লাউ, দুধ, চিনি এবং প্রাকৃতিক আরো অনেক উপাদান ব্যবহার করে বিচিত্র ডিজাইনের রুটি তৈরি করা হয় গিলানে। গিলানের ইকো মিউজিয়ামে গিলানের বহু খাবার দাবারের নমুনা এবং চকলেট জাতীয় বিচিত্র মিষ্টি সামগ্রীর নমুনা প্রদর্শনীর জন্যে রাখা হয়েছে।
শ্রোতাবন্ধুরা! গিলান প্রদেশটিতে জন্ম নিয়েছেন সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং শিক্ষাবিদ বহু ব্যক্তিত্ব। কালক্রমে স্বনামখ্যাত বহু মনীষী আর পণ্ডিতের লালনভূমি ছিল এই গিলান। আয়াতুল্লাহ বাহজাত (রহ) তেমনি একজন মহান ব্যক্তিত্ব এই প্রদেশের। ফিকাহ এবং কালাম শাস্ত্রে ব্যাপক প্রজ্ঞা অর্জনের পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও ছিলেন অনেক উঁচু মর্যাদার।
আলেম ওলামা এবং শিক্ষকদের মাঝে যেমন তেমনি জনগণের মাঝেও তাঁর জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা ছিল অপরিসীম। তাঁকে নিয়ে চলুন খানিকটা পরিচিতিমূলক বর্ণনা দেওয়া যাক। তাঁর পুরো নাম ছিল মুহাম্মাদ তাকি বাহজাত ফুমানি। শিয়া মুসলমানদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বা মারজায়ে তাকলিদ ছিলেন তিনি। ১৯১৫ সালে তিনি গিলানের ফুমান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ফুমানের মক্তব খানায় তিনি প্রাথমিক পড়ালেখা শেষ করেন। এরপর ফুমানেই ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি ইরাকে যান এবং কারবালায় গিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যান। আয়াতুল্লাহ বাহজাত এরপর পবিত্র নাজাফে যাযন এবং সেখানকার বড়ো বড়ো ওস্তাদদের তত্ত্বাবধানে থেকে ইসলামের প্রয়োজনীয় জ্ঞানগুলো অর্জন করেন। পড়ালেখা শেস করে তিনি ১৯৪৫ সালে ইরানে ফিরে আসেন।
কিছুদিন ফুমানে কাটিয়ে কোমে চলে যান এবং আরো পড়ালেখা করেন। সেখানেই তিনি বড়ো আলেম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং কোমের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন।বহু মর্যাদা সম্পন্ন ছাত্র এবং গবেষক তৈরি করে গেছেন তিনি।২০০৯ সালের মে মাসের মাঝামাঝিতে তিনি এই পৃথিবীর মায়অ ছেড়ে প্রিয় স্রষ্টার সান্নিধ্যে চলে যান।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/১৪/৬৫