মার্চ ২৮, ২০২৪ ০৯:৩৬ Asia/Dhaka
  • হলিউডের যুদ্ধ-উদ্দীপক উপাখ্যান/ বিশ্বব্যাপী মার্কিন হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করার হাতিয়ার
    হলিউডের যুদ্ধ-উদ্দীপক উপাখ্যান/ বিশ্বব্যাপী মার্কিন হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করার হাতিয়ার

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর মার্কিন চলচ্চিত্র শিল্প তার এজেন্ডায় একটি নতুন কৌশল প্রয়োগ করে, যা ছিল হলিউডের পূর্ববর্তী কৌশলগুলির সংমিশ্রণ। ওই কৌশলটির লক্ষ্য ঘৃণা এবং ইসলাম-ভীতি ছড়ানো ছাড়া আর কিছু ছিল না।   

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের আগে আমেরিকার বিদেশি শত্রুরা কখনও কল্পনাতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারত না।  আমেরিকার ‘শত্রু’ যুদ্ধের সময় বিভিন্ন শহরকে ধ্বংস করছে এবং শীতল যুদ্ধের সময় শহরগুলিকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে- এমন একটি আবহ সিনেমায় তৈরি করা হতো। কিন্তু সিনেমার এসব দৃশ্য সংঘটিত হতো কোনো দূরদেশে, সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে।  হলিউডের সিনেমায় এসব উপস্থাপনা যদিও ভয় এবং আতঙ্ক তৈরি করত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতে আমেরিকার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তবে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার সে প্রবল ধারনাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় এবং দেশটির পক্ষ থেকে আগের চেয়ে আরও বেশি নিরাপত্তা ও সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পথ প্রশস্ত করে।

এ সময়, ১১ সেপ্টেম্বরের আগে ইসলাম-ভীতি ছড়ানোর কাজে ব্যবহৃত সমস্ত বাণী-বক্তব্যকে একত্রিত করে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই’ শিরোনামের নীচে জড়ো করা হয়। এই পূর্ববর্তী বাণী-বক্তব্যগুলোর শিরোনাম ছিল মোটামুটি এরকম- ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করা’, ‘শীতল যুদ্ধের সময়কার গুপ্তচরবৃত্তির টানাপড়েন’ এবং ‘শীতল যুদ্ধের সমাপ্তির পর ১১ সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত আর্মাগেডন-কেন্দ্রীক আলোচনা।’ ‘আর্মাগেডন’ হলো নিউ টেস্টামেন্টে উল্লেখিত বিচার দিবসের আগে ভালো ও মন্দের মধ্যে শেষ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ।

এই মতাদর্শগত পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, আমেরিকানরা নিজেদের মধ্যে ‘অভ্যন্তরীণ’ এবং ‘বহিরাগত’ শিরোনামের দু’টি আলাদা মেরু তৈরি করেছিল এবং কথা বলার সময় ‘আমরা’ এবং ‘তারা’ সর্বনাম ব্যবহার করত।

যদি বলা যায় যে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এজেন্ড তিনটি মূল উপাদান অর্থাৎ,সন্ত্রাসী হামলার শিকার, সন্ত্রাসী এবং বীর (যোদ্ধা) নিয়ে গঠিত; তাহলে আমরা এই নতুন এজেন্ডায় অতীতের তিনটি উপাদানকেই খুঁজে পেতে পারি।

হলিউডের সিনেমায় হামলার শিকার জনগোষ্ঠীকে নতুন বৈশ্বিক ভূমিকা পালনের ভূমিকায়, সন্ত্রাসীকে গুপ্তচরবৃত্তির খেলায় এবং আর্মাগেডনকে নায়কের (যোদ্ধা) ভূমিকায় ফিরিয়ে আনা হয়। এখন এটা দেখতে হবে যে, হলিউডের সিনেমা কীভাবে এই সকল এজেন্ডাকে একত্রিত করে সবগুলোকে কথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঝাণ্ডাতলে সমবেত করতে এবং তা সকলের কাছে বিশ্বাসোগ্য করাতে সক্ষম হয়েছে।

১- শিকারের প্রতিনিধিত্ব

১১ সেপ্টেম্বরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনা হলো, হামলার শিকার ব্যক্তিদের তুলে ধরা এবং তাদের কষ্ট ও বেদনাকে ফলাও করে প্রচার করা। এক্ষেত্রে ওই হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের ঘনিষ্ঠজনদের ভুক্তভোগী হিসেবে দেখানোর পাশাপাশি যারা আহত অবস্থায় বেঁচে গেছেন তাদেরকে সরাসরি ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এর মাধ্যমে, ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত কষ্টকে গোটা দেশবাসীর কষ্টে পরিণত করা এবং কিছু মানুষের শোককে জাতীয় শোকে পরিণত করা হয়।

গণমাধ্যমে ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার প্রচার করা ছিল ব্যক্তিগত দুর্ভোগকে জাতীয় শোকে পরিণত করার একটি সহজ উপায়। এভাবে যে কাউকে ভুক্তভোগী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব।  যারা ‘এক্সট্রিমলি লাউন্ড অ্যান্ড ইনক্রেডিবলি ক্লোজ’ (২০১১) সিনেমাটি দেখেছেন তারা সেখানে সমাজতন্ত্র তুলে ধরার বিষযটি মনে করতে পারবেন এবং সিনেমাটিতে যুদ্ধকালীন সময়ের মতোই সমাজতন্ত্রের উপর জোর দেয়া হয়েছে।

 ‘এক্সট্রিমলি লাউন্ড অ্যান্ড ইনক্রেডিবলি ক্লোজ’ সিনেমার একটি দৃশ্য

২- শত্রুকে তুলে ধরা (বহিরাগত)

৯/১১ পরবর্তী সিনেমায় ‘বহিরাগত’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আরব/মুসলিম চিত্রায়ন করা হয়। বডি অফ লাইজ (২০০৮), চার্লি উইলসন'স ওয়ার (২০০৭), রেন্ডিশন (২০০৭), হিডালগো (২০০৪), সিরিয়ানা (২০০৫) এবং ম্যান আয়রন (২০০৮) এর মতো অসংখ্য চলচ্চিত্র সমস্ত আরব বা মুসলিম চরিত্রগুলিকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয় যেখানে দেখানো হয় যে, এসব মুসলিম সন্ত্রাসবাদী মার্কিন নাগরিক সেজে আমেরিকায় হামলা চালিয়েছে। এমন সময় ব্যাপকভাবে এই দৃশ্য দেখানো হয় যখন বাস্তব জগতের কথিত মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো অহিংস এবং অ-সন্ত্রাসবাদী ইসলামী আন্দোলনগুলোর তুলনায় নিতান্তই একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী।

৩- নায়কের প্রতিনিধিত্ব

৯/১১ পরবর্তী সিনেমাগুলোতে সন্ত্রাসবাদ তুলে ধরার ক্ষেত্রে নায়কের (যোদ্ধা) সুপারহিরোইক এবং অপরাজেয় গুণ দেখানো হয়নি বরং তবে একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ প্রকাশ করার জন্য শুধুমাত্র লক্ষণগুলো স্পষ্ট করা হয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী হলিউডের সিনেমাগুলোতে সকল নায়কের মাধ্যমে যে আদর্শটি প্রচার করা হয় তা ছিল দেশের জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ ও আত্মত্যাগ। আল-কায়েদা নেটওয়ার্কের সাবেক প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার কাহিনী নিয়ে নির্মিত ‘থার্টি মিনিটস আফটার মিডনাইট (২০১২)’ মুভির নাম ভূমিকায় একজন সাধারণ কিন্তু অবিচল নারীকে দেখানো হয় যার মধ্যে তীব্র প্রতিশোধস্পৃহ ও দেশপ্রেমের বোধ কাজ করে।

এই তিনটি উপাদানকে একত্রিত করার মাধ্যমে, ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে ব্যবহার করে আমেরিকার কাঙ্ক্ষিত উপাখ্যান ও ঘটনাপ্রবাহ প্রস্তুত করা হয়। একটি উপাখ্যান যা প্রধানত আরব/মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করার পাশাপাশি সন্ত্রাসবিরোধী আলোচনার একটি আবহ তৈরি করে যা আমেরিকার কাঙ্ক্ষিত ইসলাম-আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আর এতসব কিছু করা হয় মুসলিম বিশ্বে আমেরিকা ও পশ্চিমাদের ক্রমাগত হস্তক্ষেপ, যুদ্ধ-উন্মাদনা, সম্প্রসারণবাদ এবং ক্রমাগত হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়ার সুদূরপ্রসারি লক্ষ্যে। এই আলোচনাটি “রিপ্রেজেন্টেশন অব ‘আদার’ ইন হলিউড সিনেমা আফটার দ্যা ইভিনিং অব ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১” শীর্ষক নিবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে যা মিডলইস্ট স্টাডিজের সাইন্টিফিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।#

পার্সটুডে/এমএমআই/২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ