এপ্রিল ১৫, ২০২৪ ১৯:০৩ Asia/Dhaka

ইহুদি-বিদ্বেষ এবং ইসলাম-ভীতি (ইসলামোফোবিয়া) একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু ইউরোপীয় নেতারা দু'টি বিষয়কেই অপব্যবহার করছেন। তারা ইহুদি বিদ্বেষ মোকাবেলার নামে ইসলামোফোবিয়াকে উসকে দিচ্ছেন। গাজায় ৩০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইহুদিবাদী (জায়নবাদী) ইসরাইল। ইউরোপীয় নেতারা ইহুদি বিদ্বেষের ধুয়া তুলে এই গণহত্যাকে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন।

বাস্তবতা হলো শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের বর্ণবাদী কল্পনায় ইহুদি বিদ্বেষ এবং ইসলামভীতি যমজ ভাইয়ের মতোই দু'টি বিষয়। ইতিহাস বিশ্লেষণেও দেখা যায়, ইউরোপীয় বর্ণবাদীরা ইউরোপকে পুরোপুরি খ্রিস্টান শ্বেতাঙ্গ মানুষদের মহাদেশে পরিণত করতে চান, এ কারণে তারা ইউরোপ থেকে থেকে মুসলমান এবং ইহুদিদেরকে বিতাড়িত করার পক্ষে। শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থিদের এই যে অন্য ধর্মের প্রতি চরম ঘৃণা এবং অবমাননা এটা নতুন কিছু নয়। হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড চরম সাম্প্রদায়িক শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টানদের অন্তর্নিহিত ঘৃণার ফলেই ঘটতে পেরেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইহুদিবাদী (জায়নবাদী) ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করার পর বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টানদের ঘৃণার লক্ষ্যবস্তুর পরিবর্তন ঘটেছে। তারা ইহুদিবাদীদেরকে তাদের আপন সমাজে গ্রহণ করে নিয়েছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করার প্রকল্পটি ছিল একটি ইহুদিবাদী (জায়নবাদী) প্রকল্প, এর পেছনে ছিল ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ। জায়নবাদী ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা জুডিও-খ্রিষ্টান সভ্যতা নামে নতুন এক তত্ত্বের জন্ম দিয়েছেন যার মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলামের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদ (জায়নবাদ) ও চরমপন্থি খ্রিষ্টানদের ঐক্যবদ্ধ করা। 

১৯৪৮ সালের দখলদার ইসরাইলে ইহুদিদের জোর করে পাঠানো হয়

জায়নবাদের বিরোধিতা মানে ইহুদি বিদ্বেষ নয়

ইহুদিবাদ বা জায়নবাদের বিরোধিতা মানে ইহুদি ধর্মের বিরোধিতা নয়। ইহুদি বলতে একটি ধর্মকে বোঝায় আর ইহুদিবাদ বা জায়নবাদ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দর্শন। খুব সংক্ষেপে বলা যায়, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে স্বাধীন সার্বভৌম ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নামই হচ্ছে জায়নবাদ। ইহুদিবাদী (জায়নিস্ট) হতে হলে ইহুদি ধর্মের অনুসারী হতে হবে এমন কথা নেই, একজন খৃস্টানও জায়নিস্ট হতে পারে। আবার ইহুদি ধর্মের অনুসারী হয়েও অনেকে ইহুদিবাদী বা জায়নবাদী নাও হতে পারেন। এখনও অনেক ইহুদি রয়েছেন যারা জায়নবাদী নন, তারা দখলদার ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধী।

তবে পশ্চিমারা এখন জায়নবাদ বা ইহুদিবাদের বিরোধিতাকেই ইহুদি বিরোধিতা (অ্যান্টি-সেমিটিজম) হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। যেমন জার্মানির বহু রাজনৈতিক দল ২০১৯ সালে বিডিএস আন্দোলনের মতো আন্দোলনকে ইহুদি বিদ্বেষী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আসলে ২০০৫ সালে দেশে দেশে সরকারগুলোকে আন্তর্জাতিক আইন মানার বাধ্যবাধকতার আলোকে ইসরাইল নামক ইহুদিবাদী বা জায়নবাদী অবৈধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করতে চাপ দেওয়ার জন্য যে জনমত গঠনের আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটির নাম ছিল ‘বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট, স্যাঙ্কশন (বিডিএস) মুভমেন্ট’।

এরও আগে ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট রিমেব্রেন্স (স্মরণ) অ্যালায়েন্স বা ইহরা বিশ্বজুড়ে অ্যান্টি-সেমিটিজম নিয়ে যে সংজ্ঞা প্রদান করেছে, সে সংজ্ঞা ইহুদিবাদী ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের অ্যাকাডেমিক সমালোচনাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ইহরা নামক এই ইহুদিবাদী জোট গাজায় চলমান ইসরাইলি গণহত্যার বিরোধিতাকেও অ্যান্টি-সেমিটিজম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।

বেলজিয়ামে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবন

৭ই অক্টোবরের ঘটনা এবং ইসলাম বিরোধিতা

গত বছরের ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর ইউরোপের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে ঐ মহাদেশে ইহুদি বিদ্বেষের পাশাপাশি ইসলামোফোবিয়া বেড়েছে। ইসলামোফোবিয়া বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন ইউরোপের সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা। অনেক ইউরোপীয় সরকার ইসরাইলে আক্রমণের জন্য হামাসের সমালোচনা করলেও গাজায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে চলমান গণহত্যাকে মেনে নিয়েছে। ইউরোপীয় সরকারগুলো তাদের জাতীয় স্থাপনা এবং সরকারি ভবনগুলোতে ইসরাইলি পতাকা উড়িয়ে সংহতি প্রকাশ করলেও খোদ সেদেশের জনগণকেও গাজায় নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশে বেগ পেতে হচ্ছে। 

ইসরাইল-বিরোধীদের দমন

ইউরোপীয় রাজনৈতিক নেতাদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে আক্রমণের সময় দখলদার ইসরাইলে এক হাজার ৪০০ জনের মৃত্যু এবং আরও কয়েকশ' ব্যক্তি বন্দী হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক ও সমবেদনা জানালেও  তারা গাজা এবং পশ্চিম তীরে ৩০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যুতে পুরোপুরি নীরব। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো তারা ৩০ সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুতে সহানুভূতি প্রকাশকে এক ধরণের অপরাধ হিসেবে গণ্য করছে। লেখকদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় আদানিয়া শিবলির মতো লেখকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয় না। সামাজিক গণমাধ্যমে ফিলিস্তিনের পক্ষে লেখার দায়ে আনোয়ার আল গাজির মতো ফুটবলারকে বরখাস্ত হতে হয়। এর আগে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা না মানলে বিদেশী নাগরিকদের পরিকল্পিতভাবে ফ্রান্স ত্যাগ করানো হবে। 

ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন

 

গত ১২ অক্টোবর জেনিন শরণার্থী ক্যাম্পভিত্তিক ফিলিস্তিনি গ্রুপ ফ্রিডম থিয়েটারের একটি নাটক বাতিল করেন ফরাসি শহর চোইসি-লে-রোইয়ের মেয়র। ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ করার জন্য বিক্ষোভকারীদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে।

ব্রিটেনের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যানও 'ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি'—এই স্লোগান দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। যদিও এর মানে হলো ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ইহুদি শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাবে। জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এলাকায় আর জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ থাকবে না। ফিলিস্তিন একদিন স্বাধীন হবে। অথচ স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবিতে সোচ্চার মানুষের এই স্লোগানের ভিন্ন একটা পাঠ হাজির করেছে পশ্চিমারা। জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই স্লোগানকে ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের স্লোগান হিসেবে আখ্যা দিয়ে এই স্লোগান উচ্চারণকে 'হেইল হিটলার' (হিটলার দীর্ঘজীবী হোক) বলার সমতুল্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করছে।

ফিলিস্তিনের সমর্থনে ফরাসিদের মিছিল

 

এসবের মাধ্যমে পশ্চিমারা আসলে একটা বিপজ্জনক বার্তা দিচ্ছে, আর তাহলো ফিলিস্তিনিদের জীবন ইসরাইলিদের জীবনের চেয়ে কম মূল্যবান। ইউরোপীয় নেতারা হলোকাস্ট থেকে যে প্রধান শিক্ষাটি গ্রহণের দাবি করেন তাহলো 'হলোকাস্ট আর কখনও ঘটবে না'। কিন্তু তাদের বাস্তব আচার-আচরণে এটা স্পষ্ট, কেবল ইহুদিদেরই বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে এবং ইহুদিদের প্রাণ বাঁচানোই তাদের দায়িত্ব। অন্যদের প্রাণের মূল্য নেই, অন্যরা যেন মানুষের কাতারেই পড়েন না!#

পার্সটুডে/এসএ/১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন

ট্যাগ