এপ্রিল ২৯, ২০২৪ ২১:০৯ Asia/Dhaka
  • দাসপ্রথার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আদালত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা
    দাসপ্রথার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আদালত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা

ব্রিটেনের 'দ্যা গার্ডিয়ান' পত্রিকার লেখক রিচার্ড সুদান তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, পশ্চিমারা যেদিন দাসপ্রথার করুণ শিকার ব্যক্তিদের উত্তরাধিকারীদেরকে ক্ষতিপূরণ দেবে কেবল তখনই বিশ্বজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়গুলো সত্যিকারভাবে মুক্ত হবে।

দাসপ্রথার শিকার ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা এবং আধুনিক বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয়টি অবশ্য নতুন কোনো বিষয় নয়।

মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ 'জর্জ ফ্লয়েড'কে পুলিশ জনসম্মুখে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পর, 'কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও গুরুত্বপূর্ণ'-এই শ্লোগানে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন তীব্র হয়েছে এবং ন্যায়বিচারের দাবি আগের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

দাসদেরকে ব্যবহার করে এবং তাদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালিয়ে গড়ে ওঠা পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারে প্রতিনিধিত্বকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিলম্বিত করছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার শিকার ব্যক্তিদের উত্তরাধিকারীদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে কয়েক দশক আগে HR-40, (ফোরটি) নামে একটি প্রস্তাব কংগ্রেসে পর্যালোচনার জন্য উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু সম্ভবত তা আর কখনই আইনে পরিণত হবে না এবং দশকের পর দশক ধরে আলোচনার জন্য প্রস্তাবটি আটকে আছে।

ব্রিটেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ক্রীতদাস ব্যবসায়ী দেশ। কিন্তু তারপরও দাসপ্রথায় তাদের ভূমিকা থাকার বিষয়টি স্বীকার করতে চায় না। এমনকি শ্রেণীকক্ষেও শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় যে ১৮০৭ সালে দাসপ্রথার অবসান ঘটানো প্রথম দেশ ছিল ব্রিটেন। অথচ দাসপ্রথার অবসানে প্রথম দেশ ছিল হাইতি এবং সেটা ছিল ১৮০৪ সালে।

এটা স্পষ্টভাবে বলা যায় যেব্রিটেনে বিজ্ঞান ও শিল্প বিপ্লব এবং এই দেশটির উন্নতিতে কেবল আফ্রিকার দরিদ্রতা ও দাসপ্রথার  কারণেই সম্ভব হয়েছিল।

আফ্রিকার কালো চামড়ার লোকদের ওপর শোষণ-নির্যাতনের উপর নির্ভর করে শক্তিশালী ও উন্নত ব্রিটেন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দাসপ্রথা শুধু যে ব্রিটিশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে গিয়েছিল তাই নয় একই সাথে এটি ছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান জ্বালানী।

দাস ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার অভাব সত্ত্বেও, সৌভাগ্যবশত দাসত্বের ক্ষত বহনকারী অনেক দেশ এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

গত এপ্রিল মাসের শুরুতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের আদলে বর্তমান আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে একটি প্রস্তাব বা পরিকল্পনা জেনেভায় আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষের স্থায়ী পরিষদের তৃতীয় অধিবেশনে আলোচনার জন্য উত্থাপিত হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত দাসপ্রথার শিকার উত্তরাধিকারীদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য একটি আইনি কাঠামো তৈরি এবং জাতিসংঘে ঐকমত্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের জোরালো সমর্থন নিয়ে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে।

ট্রান্সআটলান্টিক দাসপ্রথা ছিল আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপরাধ। লক্ষ লক্ষ আফ্রিকানকে তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং আটলান্টিকের দুই পাড়ের পশ্চিমা দেশগুলোতে শ্রমিকের কাজ করার জন্য তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল। অথচ এতোটা বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তাদেরকে সমান নাগরিক হিসাবে দেখা হয় না।

এ অবস্থায়, দাসপ্রথার শিকার উত্তরাধিকারীদের জন্য ক্ষতিপূরণ আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন হলে অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবেলায় অনেকটাই সহায়তা করতে পারে। অন্তত এর মাধ্যমে দাসপ্রথার কারণে সৃষ্ট কয়েক প্রজন্মের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে।

যদিও এ ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ ও বাধাবিপত্তি রয়েছে। কিন্তু তারপরও এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালতের পদক্ষেপ থেকে বোঝা যায়, এ বিষয়ে সংলাপ চলছে। যদি প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈষম্য না থাকে তাহলে এ ব্যাপারে একটি ইতিবাচক ফল বেরিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়। 

দুর্ভাগ্যবশত, ক্যারিবীয় দেশগুলো বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো ঔপনিবেশিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অধীনে রয়েছে।

এটা আমাদের সবার জানা আছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশের এখন যে সহিংস আচরণ আমরা লক্ষ্য করি তার মূলে রয়েছে দাসত্ব-যুগের ইতিহাস এবং এটা তারই ধারাবাহিকতা। মার্কিন কারাগার ব্যবস্থাকে দাসপ্রথার নতুন রূপ বলা যায়। আমেরিকার কারাগারে আটকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গরা। তারা খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছে এবং প্রায়ই সস্তা শ্রমিক হিসাবে তাদেরকে খাটানো হয়। আর এ থেকে লাভবান হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি ।

আমরা আরো দেখতে পাই যে, ব্রাজিলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আফ্রিকান ক্রীতদাস কিভাবে অমানবিক আচরণের সম্মুখীন হয়েছিল।

এছাড়াও আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে যা আমরা একে একে তুলে ধরতে পারি।

পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক দলগুলো কৌশলে এ সংক্রান্ত বিতর্ক এড়িয়ে যায়। উদারপন্থী বলে দাবিদাররা ইহুদি সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য ন্যায়বিচারকে সমর্থন করছে, কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের বিষয়ে কার্যত নীরব রয়েছে।

সর্বোপরি, তারা অকার্যকর তথা লোক দেখানো বর্ণবাদ বিরোধী নানান কথাবার্তা বলছে এবং কখনও কখনও পুলিশের আচরণ সংশোধনের জন্য বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে।

কৃষ্ণাঙ্গদের অপমান অপদস্থ করতে ডানপন্থীরাও এগিয়ে। তারা কিছু ক্ষেত্রে এমন হাস্যকর যুক্তিও দেখিয়েছে যে দাসপ্রথা ব্যবস্থা আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের বরং অনেক উপকারই করেছে।

কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইউরোপের উন্নতির পেছনে অব্যাহত সস্তা শ্রমিক ব্যবহারে দাসপ্রথা বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।

যাইহোক, বর্তমান আফ্রিকানরা এবং পাশ্চাত্যে বসবাসরত আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গরা যদিও সেসব নিয়ে কিছু বলছে না তবে তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউরোপীয় দেশগুলোকে যদি কোনোভাবে এগিয়ে যেতে হয় তাহলে তাদেরকে বুঝতে হবে ক্ষতিপূরণ দেয়া কোনো আর্থিক সহযোগিতা নয় বরং এটি ঋণ যা তাদেরকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। 

ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আদালতের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া আফ্রিকান এবং ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর জন্য একটি ভাল চিন্তা। নিহত হওয়ার আগে ম্যালকম এক্স এমনটাই ভেবেছিলেন। একটি ভালো দিক হচ্ছে, ক্ষতিপূরণ চাওয়া সম্প্রদায়গুলো ক্রমেই সংগঠিত হচ্ছে এবং এই বিষয়ে তাদের মধ্যে ঐক্য জোরদার হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত খ্রিস্টানদের চার্চ অতীত ভুলের খেসারত হিসাবে দশ কোটি পাউন্ড দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তাই, বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচারকামী এবং স্বাধীন সমাজের এই ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবির প্রতি সমর্থন জানানো উচিত। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ