প্রতারণা হতে সাবধান! ক্রীড়া অঙ্গনও পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক খেলার হাতিয়ার
আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা আমেরিকান ন্যাশনাল ফুটবল লিগের ফাইনাল খেলা, যেটি কিনা 'সুপার বোল' হিসেবে খ্যাত।
কিছুদিন আগে, 'সুপার বোল ২০২৪' খেলার মাঝখানে বিরতির সময় ইসরাইল ৩০ সেকেন্ডের একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করে যেখানে গাজায় গণহত্যার যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা চালানো হয়। এই বিজ্ঞাপনটি যে মুহূর্তে জনসম্মুখে প্রচার করা হয় ঠিক তখনই দখলদার ইসরাইলি সেনারা রাফাহ শহরে গণহত্যায় লিপ্ত ছিল যেখানে বহু সংখ্যক ফিলিস্তিনি শহীদ হয়।
এই বছরের সুপার বোল ফাইনাল খেলার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শক ছিল যাদের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৩০ লাখ। যদিও ইসরাইলের এই উদ্দেশ্যমূলক বিজ্ঞাপনে জনগণের প্রতিক্রিয়া ছিল দুর্বল, তবুও এ প্রশ্ন উঠে এসেছে যে, মার্কিন রাজনীতিবিদরা প্রায়ই খেলাধুলা ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখার যে দাবি করে থাকেন তার কি হবে?
কার জন্য?
এর উত্তর হল, রাজনীতি এবং খেলাধুলার বিষয়টিকে আলাদা করে দেখার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও বাস্তবে, খেলাধুলা সবসময় মার্কিন রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। অর্থাৎ ইসরাইলের মতো মার্কিন মিত্ররা যখন কোনো ইস্যুতে একই কাতারে থাকে তখন খেলাধুলাকেও তারা রাজনীতিকরণ করে, এমনকি ইসরাইল যদি আমেরিকার করদাতাদের অর্থে ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালায় তবুও।
মার্কিন সমর্থন ও সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে ইসরাইল সাত মাস ধরে গাজা উপত্যকায় বোমাবর্ষণ কোরে এ পর্যন্ত ৩৩ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষকে আহত করেছে। এ ছাড়া ২০ লাখেরও বেশি মানুষকে তারা বাস্তুচ্যুত করেছে। ইসরাইল নজিরবিহীন অপরাধযজ্ঞ চালালেও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া মহল এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে এবং দ্বৈত নীতি গ্রহণ করেছে।
প্রতিবাদ ও শাস্তির জন্য ক্রীড়া:
খেলাধুলা সবসময়ই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে। সম্ভবত ক্রীড়া ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, ফিল্ড অ্যাথলেটে টমি স্মিথ এবং জন কার্লোসের প্রতিবাদের ঘটনা যারা মেক্সিকো সিটিতে ১৯৬৮ সালের অলিম্পিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। প্রথমে তারা পুরস্কার বা পদকপ্রদান মঞ্চের উপরে দাঁড়ায় এবং এরপর হাঁটু গেড়ে বসে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তোলে। তবে, এ উভয় ক্রীড়াবিদকে শেষ পর্যন্ত অলিম্পিক গেম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই তার শত্রুদের শাস্তি দেওয়ার জন্য খেলাধুলাকে ব্যবহার করেছে। ১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করার পর, ১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৬৫টি দেশকে মস্কোতে আয়োজিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস বয়কট করতে বাধ্য করে। এর প্রতিশোধ নিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ওয়ারশ চুক্তির অন্যান্য সদস্যরাও লস অ্যাঞ্জেলেসে ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক বয়কট করেছিল।
কথা ও কাজের মধ্যে ব্যবধান:
এসব ঘটনার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, খেলাধুলা এবং রাজনীতিকে আলাদা করে দেখার যে প্রবণতা ছিল সেটাকে কীভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। জর্ডানের জাতীয় বাস্কেটবল দলের খেলোয়াড় জারেহ নাজ্জারের মতে, 'একটি আদর্শ বিশ্বে খেলাধুলা ও রাজনীতি সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে এবং খেলার প্রতি ভালবাসা তৈরির জন্য ক্রীড়াবিদদের প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু তারপরও আমরা দেখতে পাচ্ছি, খেলাধুলা প্রায়ই রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে কাজ করে কিংবা বলা যায় ক্রীড়াঙ্গনক অপব্যবহার করা হচ্ছে'।
দ্বিমুখী আচরণ:
পাশ্চাত্য বিশেষ করে আমেরিকার দ্বৈত আচরণ আরও বেশি দৃশ্যমান হয় যখন আমরা ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের আক্রমণের সাথে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিষয়ে পাশ্চাত্যের প্রতিক্রিয়ার তুলনা করি। এখানেই প্রমাণিত হয় পাশ্চাত্য কিভাবে খেলাধুলা এবং রাজনীতিকে একে অপরের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে। তারা ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করে। তাদের হৈচৈ-এ প্রভাবিত হয়ে বিশ্বের পেশাদার ক্রীড়া সংস্থাগুলোও পশ্চিমাদের অনুসরণ করা শুরু করে এবং অত্যন্ত জোরালোভাবে ইউক্রেনকে সমর্থন দেয়া শুরু করে। অথচ এই পাশ্চাত্য সরকারগুলোই ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি প্রদর্শন করাকে ক্রীড়া জগতে নিষিদ্ধ করেছে এবং এই নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রয়েছে।
ক্রীড়ার বিরুদ্ধে ইসরাইলের অবস্থান:
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে চালানো হামলায় ইসরাইল ২৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল যা জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ওই বছর ছিল ভয়ানক মৃত্যুর বছর। কিন্তু তারপরও বিশ্বের ক্রীড়া সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব ছিল।
এমনকি ৭ অক্টোবর থেকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ইসরাইলি ওই হামলায় গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরের প্রায় ৮৫ জন ফিলিস্তিনি ক্রীড়াবিদ নিহত হয়েছিল। ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবেদনে বলা, নিহতদের মধ্যে ৫৫ জন ফুটবলার এবং অন্যান্য খেলার আরো ৩০ জন খেলোয়াড় অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনি ক্রীড়াবিদদের, বিশেষ করে ফুটবল খেলোয়াড়, ক্লাব সভাপতি, ম্যানেজার এবং রেফারিদের লক্ষ্যবস্তু করেছে।
ইসরাইল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনের নয়টি ক্রীড়া কমপ্লেক্স ধ্বংস করেছে, এর মধ্যে চারটি পশ্চিম তীরে এবং পাঁচটি গাজা উপত্যকায়। এতে বোঝা যায়, ফিলিস্তিনি ক্রীড়াবিদদের টার্গেট করে তাদের হত্যা করা ও ক্রীড়া স্থাপনা ধ্বংস করা ইসরাইলের সহিংস কর্মকাণ্ডের অন্যতম নীতি।
ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে দখলদার ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞ নিয়ে বিশ্বের ক্রীড়া সম্প্রদায় নীরব থাকলেও তারা ইসরাইলের প্রতি ঠিকই জোরালো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। গত ৮ অক্টোবর আমেরিকান ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন (এনবিএ) এক বিবৃতিতে ইসরাইলিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এবং নিজেদের ভূমি ফিরিয়ে নিতে সংগ্রামরত ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডে সন্ত্রাসবাদের লেবেল এঁটে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের নিন্দা জানায়।
সাহসীরা বেঁচে আছে:
যাইহোক, ফিলিস্তিনকে সমর্থন করা থেকে বিরত রাখার জন্য ব্যাপক চাপ ও ঝুঁকি সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদেরও ক্রীড়া জগতে সমর্থক এবং মিত্র রয়েছে। নারী বাস্কেটবল তারকা নাতাশা ক্লাউডের মতো ব্যক্তি, যিনি ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন।
পরিশেষে, এই বিষয়টি সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, রাশিয়ার ক্রীড়া দলগুলোকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু গাজায় ব্যাপক গণহত্যা চালানোর পরও ইসরাইলের ক্রীড়া দলগুলোকে কোনো পরিণতি ভোগ করতে হয়নি বা নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীনও হতে হয়নি।
এ অবস্থায় যেহেতু খেলাধুলাকেও রাজনৈতিকীকরণ করার চেষ্টা চলছে তাই সময় এসেছে স্বাধীন সরকার ও জাতিগুলোকে ইসরাইলি ক্রীড়াবিদদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বয়কটের ডাক দেয়া উচিত। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।