এপ্রিল ২৩, ২০২৪ ২১:১৮ Asia/Dhaka
  • কিমি সাবা,  আফ্রিকায় উপনিবেশবাদ বিরোধী নেতৃবৃন্দের অন্যতম
    কিমি সাবা,  আফ্রিকায় উপনিবেশবাদ বিরোধী নেতৃবৃন্দের অন্যতম

আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের ঘটনা-প্রবাহ পশ্চিমা আধিপত্যের ক্রমাবনতি এবং রাশিয়া, ইরান ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব তুলে ধরছে, যা নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠারই সুসংবাদ দিচ্ছে।

আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে পাশ্চাত্যের পুতুল সরকারগুলোর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে এবং মালি, বুর্কিনাফাসো এবং নাইজার সহ সাহেলীয় অঞ্চলের দেশগুলির জোট আফ্রিকান প্রতিরোধের অক্ষ গঠনের অগ্রগামী শক্তি হতে পারে৷

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিরোধের নানা অক্ষ বা জোট গড়ে ওঠার ঘটনা এক দীর্ঘ-মেয়াদি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল যা কয়েক মেরুকেন্দ্রীক নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করছে। পশ্চিমা আধিপত্যবাদের মোকাবেলায় প্রতিরোধ এবং কয়েক মেরু-কেন্দ্রীক নয়া বিশ্ব-ব্যবস্থার অভ্যুদয় পুরোপুরি পরস্পরের পরিপূরক। বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ায় আরব ও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যে প্রতিরোধ-অক্ষ রয়েছে তা আফ্রিকার সাহেলীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য প্রতিরোধের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। আফ্রিকার এইসব দেশের মধ্যে গোটা পশ্চিম থেকে পূর্ব আফ্রিকার নানা দেশ যেমন, সেনেগাল, মালি, বুর্কিনাফাসো ও নাইজার থেকে চাদ, সুদান ও ইরিত্রিয়ার নাম উল্লেখযোগ্য।

আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সেনেগালে নির্বাচন অনুষ্ঠান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নাইজারের বিপরীতে এখানে পরিবর্তন এসেছে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে। অন্যদিকে নাইজারে নব্য-উপনিবেশবাদের মোকাবেলায় ক্ষমতার পরিবর্তন এসেছিল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।

গত ২৪ মার্চ সেনেগালের সাধারণ নির্বাচনে ৪৪ বছর বয়সী বাসিরো দিওমাই ফায়ের ভূমিধস বিজয় দেশটিতে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। দেশটির সাবেক কর-পরিদর্শক সম্প্রতি দুই সপ্তাহ জেলে ছিলেন। তিনি আফ্রিকার বঞ্চিত বা দরিদ্র শ্রেণীর সমর্থক নেতা হিসেবে ফ্রান্সের ক্রীড়ণক ম্যাকি স্যালকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হন।

সেনেগালের রাষ্ট্রপতি এখন বুরকিনা ফাসোর ৩৬ বছর বয়সী ইব্রাহিম ট্রাওরে, ইথিওপিয়ার ৪৬ বছর বয়সী আবি আহমেদ, মাদাগাস্কারের ৪৮ বছর বয়সী আন্দ্রে রাজোলিনা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ৪৪ বছর বয়সী জুলিয়াস মালেমার সাথে যোগ দিয়ে এই মহাদেশে পরিবর্তনের নতুন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেন। এভাবে আফ্রিকার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুগুলোতে নিজেদের অবস্থান সংহত করছে সেখানকার যুব-প্রজন্ম।

দৃশ্যত এই পরিবর্তন জিও-ইকোনমিক বা ভূ-অর্থনৈতিক। সেনেগাল তেল ও গ্যাস উৎপাদক গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ফায়ে এখন খনিজ ও জ্বালানি বিষয়ক চুক্তিগুলোর বিষয়ে নতুন করে আলোচনা করতে চান ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম ও অ্যান্ডেভার মাইনিং কোম্পানিসহ নানা কোম্পানির সঙ্গে। এ ছাড়াও তিনি ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণাধীন ফরাসি মুদ্রা ফ্রান্ক ও ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রিত ঔপনিবেশিক সিএফএ নামক মুদ্রা-সিস্টেম থেকে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছেন যা ১৪টি আফ্রিকান দেশে প্রচলিত। এমনকি তিনি ফ্রান্সের নব্য-উপনিবেশবাদের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে নতুন মুদ্রা চালু করারও চিন্তাভাবনা করছেন। উল্লেখ্য ফ্রান্সের প্রধান বাণিজ্য শরিক হল সেনেগাল। ফায়ে চীনের সঙ্গেও উইন-উইন তথা সমান দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের ভিত্তিতে বাণিজ্য শরিক হতে আগ্রহী।

ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে নাইজারের ঘনিষ্ঠতায় ওয়াশিংটনের আতঙ্ক

সেনেগালের প্রেসিডেন্ট এখনও স্পষ্ট করেননি যে তিনি তার দেশ থেকে ফরাসি সেনাদের বের করে দিতে চান কিনা। তিনি যদি তা করেন তাহলে তা হবে ফ্রান্সের জন্য নজিরবিহীন আঘাত। কারণ এমানুয়েল ম্যাক্রন ও ফ্রান্সের কাঠামো নাইজার, মালি ও বুরকিনাফাসোর ক্ষেত্রে সেনেগালকেই আসল খেলোয়াড় বলে মনে করে যারা অনেক আগেই ফ্রান্স থেকে দূরে সরে গিয়েছে।  

সম্প্রতি এই তিনটি দেশ সাহেলীয় সরকারগুলোকে নিয়ে একটি ঐক্যজোট গড়ে তুলেছে যা প্যারিসের জন্য একের পর এক বেশ কয়েকটি অপমানজনক বিপর্যয়ের ধারায় বড় ধরনের নতুন দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এই জোট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও মাথা-ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এটা স্পষ্ট হয়েছে নাইজারের সঙ্গে মার্কিন সামরিক সহযোগিতার লক্ষ্যনীয় ব্যর্থতার ঘটনায়।

স্বাভাবিকভাবেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশপাশের দেশগুলি রাশিয়া এবং আফ্রিকার মধ্যে ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়নি, যার মধ্যে সাহেল থেকে শুরু করে নতুন জোট BRICS-এর আফ্রিকান সদস্য, মিশর এবং ইথিওপিয়া পর্যন্ত সমস্ত মূল খেলোয়াড়ই রয়েছে৷দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় মার্কিন সরকার এখন নাইজার থেকে তার সেনা সরিয়ে নেয়ার সময়সীমা ঘোষণা করতে বাধ্য এই দেশটির সঙ্গে তার সামরিক সহযোগিতার চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ায়। পেন্টাগন সামরিক প্রশিক্ষণের অজুহাত দেখিয়ে এ অঞ্চলে আর সেনা উপস্থিতি বজায় রাখতে পারবে না। এ অঞ্চলের দু'টি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে মার্কিন সরকার ব্যয় করেছিল ১৫০ মিলিয়ন তথা ১৫ কোটি ডলার। নাইজার থেকে খুব শিগগিরই এক হাজার মার্কিন সেনা সরিয়ে নেয়ার জন্য চাপের মুখে রয়েছে ওয়াশিংটন। এ দু'টি ঘাঁটি হাতছাড়া করার অর্থ হল ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে নাইজারের ঘনিষ্ঠতা এবং বাবুল মান্দাব প্রণালীর ওপর নজরদারির জন্যও যা ছিল বেশ জরুরি। গত জানুয়ারি মাসে নাইজারের এক বিশাল প্রতিনিধি দল মস্কো সফর করেছে।

ফ্রান্সের অবমাননায় সম্ভাব্য মার্কিন প্রতিক্রিয়া  

আফ্রিকা মহাদেশে পাশ্চাত্যের পুতুল সরকারগুলো ক্ষমতা হারাতে থাকায় এবং কয়েকটি নতুন দেশে নতুন সরকারের নেতৃত্বে প্রতিরোধ অক্ষ ও সাহেল জোট গড়ে ওঠার পাশাপাশি রাশিয়ার কূটনৈতিক ও চীনের বাণিজ্যিক তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মেরু-কেন্দ্রীক বিশ্ব-ব্যবস্থা জোরদারের পথ সুগম হচ্ছে।

কিমি সাবা সম্প্রতি  কয়েক মেরু-কেন্দ্রীক বিশ্ব-ব্যবস্থা সংক্রান্ত মস্কো সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তিনি প্যান-আফ্রিকান বলয়ের একজন ক্যারিজমাটিক নেতা। এ অঞ্চলে ফ্রান্সের সর্বাত্মক অপমানের সম্ভাব্য কারণগুলো হল ইউক্রেনে ফরাসি সেনা পাঠানোর হুমকি এবং আর্মেনিয়ায় রাশিয়া সম্পর্কে ভীতি ছড়ানোর ব্যাপারে ম্যাক্রনের ভূমিকা।

অতীতকাল থেকেই আফ্রিকার দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে বেশি নমনীয় ও তাদের স্বার্থের অধিকতর সহযোগী হিসেবে দেখে এসেছে। এখন চীন সম্পর্কেও তাদের মনোভাব এমনই। সাহেল নামক জোট এখন আঞ্চলিক ঐক্যের শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। সেনেগালও এ জোটে যোগ দিতে পারে। গিনি তার ভৌগলিক সুবিধা ও সাগর উপকূলের অধিকারী হিসেবে এই জোটের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এই জোট ECOWAS ইকোয়াস নামক পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রিত জোটের মৃত্যু ঘটাতে পারে।

তবে পাশ্চাত্যের আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর শেকড়গুলোর ব্যাপারে উদাসীন থাকা ঠিক হবে না, যদিও সন্ত্রাসের হুমকির মার্কিন শ্লোগান আর সাহেল অঞ্চলকে ধোকা দিতে সক্ষম নয়।  মার্কিন সরকার এ অঞ্চলে চীন, ইরান ও রাশিয়ার প্রভাব ঠেকানোর জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। এ অঞ্চলে আইভরি কোস্ট ওয়াশিংটনের জন্য চাদের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর অবস্থান সাহেল অঞ্চলের অনেক বেশি কাছে। আইভরি কোস্টে ফ্রান্সের সামরিক ঘাটিতে যেসব মার্কিন সন্ত্রাসী ড্রোন রয়েছে সেগুলো এ অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে পারে। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

           

ট্যাগ