মে ২৬, ২০২৪ ১৮:৩৩ Asia/Dhaka
  • ফান্সের বিরুদ্ধে সংগ্রাম; নিউ ক্যালেডোনিয়ার জনগণকে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে
    ফান্সের বিরুদ্ধে সংগ্রাম; নিউ ক্যালেডোনিয়ার জনগণকে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফরাসিদের নিয়ন্ত্রিত নিউ ক্যালেডোনিয়া এলাকায় নতুন নির্বাচনি আইন বাস্তবায়নে ফরাসি সরকারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে বড় ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটেছে। বলা হচ্ছে, ১৯৮০ এর দশকের পর এটিই সবচেয়ে মারাত্মক সহিংস ঘটনা।

নিউ ক্যালেডোনিয়ার সহিংসতা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে সেখানকার আদিবাসী, উপনিবেশবাদীদের বংশধর এবং নবাগতদের মধ্যে এতোদিনের আড়ালে থাকা মতপার্থক্যের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে।

সম্প্রতি ফ্রান্সের পার্লামেন্টে ওই অঞ্চলের নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তনের বিষয়টি অনুমোদনের পর নিউ ক্যালেডোনিয়ায় ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। কেননা এই আইন অনুযায়ী ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে সেখানে বসবাসকারী ফরাসিরা ভোট দেয়ার অনুমতি পাবে।

নিউ ক্যালেডোনিয়া কোথায়?

নিউ ক্যালেডোনিয়া হল ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরের পাঁচটি ফরাসি নিয়ন্ত্রিত দ্বীপ অঞ্চলের একটি। এটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং প্রশান্ত মহাসাগরে প্যারিসের প্রভাব বাড়ানোর জন্য ওই দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোনের বেশ কিছু  পরিকল্পনা রয়েছে।

এই দ্বীপপুঞ্জে তিন লাখেও বেশি মানুষ বসবাস করে। এটি অস্ট্রেলিয়া ও ফিজির মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এবং বিদেশে ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রিত বৃহত্তম অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। এ ছাড়া প্রশান্ত মহাসাগরে প্যারিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত। ফরাসি মালিকানাধিনে থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় কানাক আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে ফরাসি ঔপনিবেশের প্রতি অসন্তুষ্ট এবং তারা নিজেরা নিজেদের ভূখন্ডের অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করে আসছে।

প্রকৃতপক্ষে, ফ্রান্স ১৮৫৩ সালে ওই দ্বীপপুঞ্জটি দখল করার পর স্থানীয় জনসংখ্যার কাঠামোয় পরিবর্ত আনার জন্য প্যারিস উদ্দেশ্যমূলকভাবে ওই অঞ্চলকে ফরাসি নাগরিকদের দিয়ে পূর্ণ করে। তাই, ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য নিউ ক্যালেডোনিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন ও উত্তেজনা চলে আসছে।

কেন নিউ ক্যালেডোনিয়া ফ্রান্সের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

আফ্রিকায় সাবেক উপনিবেশগুলোতে ফ্রান্সের প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং অনেক এলাকাকে তারা হাতছাড়া করেছে। এ অবস্থায় নিউ ক্যালেডোনিয়ায় একটি শক্তিশালী ঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে চাইছে তারা যাতে সমগ্র ওই অঞ্চলের ওপর নজরদারি ও খবরদারি করা যায়।

প্যারিস এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রাখার পাশাপাশি ফরাসি কোম্পানিগুলোর স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লাইনগুলোর উপরও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। ফ্রান্স নিজেকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা নিরসনে একটি মধ্যস্ততাকারী শক্তি হিসাবে দেখে। বিশেষ করে তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে উত্তেজনা নিরসনে ফ্রান্সের ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে তারা মনে করে এই অঞ্চলে একটি স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি দরকার যাতে কোনো সংঘাত বাধলে ফ্রান্স ভূমিকা রাখতে পারে।

পলিনেশিয়া, ওয়ালিস, ফোটোনা এবং ক্লিপারটন হল প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য ফরাসী নিয়ন্ত্রিত বিদেশী অঞ্চল। এ ছাড়া, মায়োট ও রিইউনিয়নসহ অন্য আরো কয়েকটি দ্বীপ ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। এই এইসব দ্বীপের জনসংখ্যা এক কোটি ৬৫ লাখ।

নিউ ক্যালেডোনিয়া দ্বীপের জনগণ ফ্রান্সের পক্ষে সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যে সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের ব্যাপক প্রতিবাদ করেছে এবং সেখানে সহিংসতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যাইহোক, স্বাধীনতাকামী কানাক আদিবাসী এবং ঔপনিবেশিক শক্তি হিসাবে ফরাসিদের বংশধরদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে উত্তেজনা চলে আসছে।  আদিবাসীরা চায় ফরাসি প্রভাবমুক্ত হতে কিন্তু ফরাসিরা চায় ওই এলাকার ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এবং ফ্রান্সের অংশ হয়ে থাকতে। এ অবস্থায় ফরাসি সরকারের নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল নিউ ক্যালেডোনিয়া প্রাদেশিক নির্বাচনের জন্য ভোটারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যাতে স্বাধীনতার স্বপক্ষের আন্দোলন নির্মূল করা যায়। এ কারণেই স্থানীয়রা এমন কোনো নির্বাচন চায় না যাতে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন ধ্বংস হয়ে যায়।   

নিউ ক্যালেডোনিয়ার বিক্ষোভের একজন নেতা বিশ্বাস করেন যে আজ যদি দেশে সহিংসতা হয় তবে এটি প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিক আমল থেকে এই ভূমিতে যে বৈষম্যের বীজ বপন করা হয়েছিল এটা তারই প্রতিক্রিয়া।

নিউ ক্যালেডোনিয়ান দ্বীপপুঞ্জের যুবকরা মনে করে ফরাসিদের ঔপনিবেশ এখনো বজায় রয়েছে এবং তারা বহু ক্ষেত্রে ফ্রান্সকে তাদের সুযোগ হারানোর কারণ হিসেবে দেখছে।

নিউ ক্যালেডোনিয়ায় বিক্ষোভের জেরে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন নিহত হয় এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এই ভূখণ্ডে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন।

নিউ ক্যালেডোনিয়া ১৮৬০-এর দশকে একটি ফরাসি উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। এরপর ১৮৭৮ সালে এই ভূখণ্ডে ফরাসি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ সংঘটিত হয়, যার ফলে কমপক্ষে ৮০০ জন নিহত হয়েছিল এবং হাজার হাজার স্থানীয় আদিবাসী নির্বাসিত হয়েছিল। এমনকি কিছু স্থানীয় উপজাতিও এই বিক্ষোভের পর মানচিত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

ফ্রান্স সরকার নিউ ক্যালেডোনিয়াকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন  তো দূরের কথা বরং  জনগণের প্রতিবাদ  ও  তাদের ন্যায্য দাবিগুলো সহিংসতার মাধ্যমে দমন করা হয়েছে।

অবশেষে, ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স নিউ ক্যালেডোনিয়ার সাথে একটি ২০-বছর মেয়াদি ঔপনিবেশ মুক্ত অঞ্চল গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যা ওই অঞ্চলের জনগণ সমর্থন করে।

কিন্তু এখন নিউ ক্যালেডোনিয়া হয়ে উঠেছে খনিজ নিকেল সমৃদ্ধ এলাকা। নিউ ক্যালেডোনিয়ায় বিশ্বের ৩০ শতাংশ নিকেল মজুদ রয়েছে, যা স্টেইনলেস স্টীল এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ব্যবহৃত ব্যাটারি তৈরিতে একটি অপরিহার্য উপাদান।

২০১৯ সালের আদমশুমারি অনুসারে, নিউ ক্যালেডোনিয়ার জনসংখ্যার ৪১শতাংশেরও বেশি স্থানীয় কানাক গোত্রের লোকজন এবং ২৪ শতাংশ  হচ্ছে ইউরোপীয়। স্থানীয়রা নিম্ন মজুরির কাজ করে এবং দারিদ্র্যের হারসহ অনেক বেশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন। এ কারণে অনেক বিশ্লেষক ক্যালেডোনিয়ার জনগণকে ফিলিস্তিনের মতো পরিণতি ভোগের বিষয়ে চিন্তিত।

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ