নিশুমারু: ইরান ও জাপানের যৌথ উদ্যোগে একটি উপনিবেশবাদ-বিরোধী গল্প
(last modified Wed, 21 Aug 2024 03:35:50 GMT )
আগস্ট ২১, ২০২৪ ০৯:৩৫ Asia/Dhaka
  • নিশুমারু: ইরান ও জাপানের যৌথ উদ্যোগে একটি উপনিবেশবাদ-বিরোধী গল্প

পার্সটুডে- ইরানের তেল শিল্প জাতীয়করণ করার পর ব্রিটেন এক রাষ্ট্রীয় বিবৃতিতে ঘোষণা করে, যদি কোনো দেশ ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি করে তাহলে সেই দেশের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে লন্ডন। তবে জাপান ব্রিটিশ সরকারের এই আধিপত্যবাদী ঘোষণায় কান দেয়নি।

পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়ার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে জাপান ও ইরান সব সময় নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এই সম্পর্কের ইতিহাস ১৫০০ বছরের বেশি।

প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণা থেকে জানা যায়, ইরানে সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের শাসনামলে তথা সিল্ক রোডের যুগে ইরান ও জাপানের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সম্পর্কে এক বাক্যে বলা যায়: যুগে যুগে ইরানের ঘনিষ্ঠতম মিত্র দেশগুলোর একটি ছিল জাপান।

পার্সটুডের আজকের এই নিবন্ধে আমরা ইরানে তেল শিল্প জাতীয়করণের সময়কার একটি ঘটনা তুলে ধরব যখন নিশুমারু নামক জাপানি তেল ট্যাংকারের কারণে তেহরান ও টোকিওর সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও তার মিত্রদের ভয়াবহ হামলা বিশেষ করে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে মার্কিন এটম বোমা হামলার কারণে জাপান ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাপানিরা তাদের দেশের পুনর্গঠনের কাজে মনযোগী হয়। এ সময় জাপানের প্রচণ্ড রকমের জ্বালানী তেলের প্রয়োজন পড়ে এবং টোকিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমন একটি দেশের সন্ধানে নামে যার কাছ থেকে সে নির্বিঘ্নে যতটা প্রয়োজন তেল কিনতে পারে। ঠিক ওই সময় আমেরিকা ও ব্রিটেনের কবল থেকে মুক্ত করে ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণের ঘোষণা দেয় তৎকালীন মোসাদ্দেক সরকার। এই ঘটনা ওয়াশিংটন ও লন্ডন মেনে নিতে পারেনি। তারা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ইরানের তেল শিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

ইরানের তেল শিল্প জাতীয়করণ করার পর ব্রিটেন এক রাষ্ট্রীয় বিবৃতিতে ঘোষণা করে, যদি কোনো দেশ ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি করে তাহলে সেই দেশের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে লন্ডন। ইরানের তেল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে দেশটির অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়া ছিল ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য। সমসাময়িক ইতিহাসে সেটি ছিল ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত প্রথম নিষেধাজ্ঞা।

ওদিকে ওই সময় জাপানের ইদে মিতসু কোম্পানি দেশটির তেল শিল্প বিশেষ করে তেল শোধনাগারগুলো পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেয়। তারা ইঙ্গো-মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে ইরানের কাছ থেকে সরাসরি তেল আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ইদে মিতসু কোম্পানির মালিক এক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি ইরানের মোসাদ্দেক সরকারের সঙ্গে তেল কেনার বিষয়ে আলাপ করার জন্য সাংবাদিকের ছদ্মবেশে নিজের ছোট ভাই কেই সুকে’কে ইরানে পাঠান। ১৯৫৩ সালের ২৩ মার্চ জাপানি তেল ট্যাংকার নিশুমারু ৫৫ জন ক্রুসহ দেশটির কুবে বন্দর ত্যাগ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে জাহাজটির গন্তব্য সৌদি আরব বলে ঘোষণা করা হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটিকে পাঠানো হয় ইরানের আবাদান বন্দরে।

ইদে মিতসু কোম্পানির তেল ট্যাংকারটি পারস্য উপসাগরে মোতায়েন ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলে আসে এবং ১০ এপ্রিল ভোররাতে ইরানের আবাদান বন্দরের ১৯ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করে। জাহাজটি নোঙ্গর করার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এতে তেল তোলার কাজ শুরু হয় এবং দুই দিনের মধ্যে ট্যাংকারটিতে তেলে ভরে যায়। ইরানের পক্ষ থেকে জাহাজটির ক্যাপ্টেন তাতসু নিইতাকে বিশেষ পুরস্কারের ভূষিত করা হয়। ১৫ এপ্রিল জাপানি তেল ট্যাংকারটি ইরানি তেল নিয়ে চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজগুলোকে ফাঁকি দিয়ে ইরান উপকূলের অগভীর সমুদ্র দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। নিশুমারু নামক তেল ট্যাংকারটি সব উদ্বেগ উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে ১৯৫৩ সালের ২৯ এপ্রিল জাপানের কাওয়াসাকি বন্দরে পৌঁছে যায় এবং এভাবে ইরানের ওপর আরোপিত নিপীড়ণমূলক নিষেধাজ্ঞা প্রথমবারের মতো লঙ্ঘন করা হয়।

জাপানের ইদে মিতসু কোম্পানি সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয় যে, এখন থেকে তারা প্রকাশ্যে ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি করবে। আর ওই ঘোষণার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানের ওপর আরোপিত ব্রিটিশ নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর হয়ে পড়ে।

জাপানিদের এই সাহসিকতা দেখে ইরানের তৎকালীন সরকার জাপানের জন্য তেল ট্যাংকারের এক চালান তেল টোকিওকে বিনামূল্যে দেয়ার ঘোষণা দেয়।

ব্রিটিশ সরকার এ সময় দাবি করে ইরানের কাছ থেকে তেল কেনার অধিকার ব্রিটেন ছাড়া অন্য কোনো দেশের নেই। লন্ডন আন্তর্জাতিক আদালতে জাপানের ইদে মিতসু কোম্পানির বিরুদ্ধে দুই দফা অভিযোগ দায়ের করে। প্রথম মামলার রায় ইদে মিতসু কোম্পানির পক্ষে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্বিতীয় অভিযোগটি প্রত্যাহার করে ইদে মিতসু কোম্পানির কাছে ক্ষমা চায় ব্রিটিশ সরকার। 

এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি নিশুমারু ঘটনা হিসেবে পরিচিতি পায় যা ইরান ও জাপানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে রয়েছে। ইরান ও জাপানের কর্মকর্তারা এখনও দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে ওই ঘটনা স্মরণ করে। #

পার্সটুডে/এমএমআই/জিএআর/ ২১

ট্যাগ