ওয়াশিংটন বৈঠক:
ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করে চীনকে মোকাবেলায় অগ্রাধিকার দিতে চান ট্রাম্প
-
ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক
পার্সটুডে: ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সোমবার ওয়াশিংটনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অংশ নেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং ইউরোপীয় কয়েকজন নেতা, যেমন ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালি, ফিনল্যান্ডের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো প্রতিনিধিরা।
ওয়াশিংটন বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল- ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও টেকসই শান্তির পথ খোঁজা। এই বৈঠকটি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিনের (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট) মধ্যে আলাস্কায় সম্প্রতি হওয়া আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কোনো চূড়ান্ত সমঝোতা না হলেও, অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির বদলে স্থায়ী শান্তি চুক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল।
এবারের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি মেনে নিতে রাজি করানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে:
প্রথমত, ট্রাম্প ক্ষমতায় ফেরার আগে থেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি বিশ্বের কিছু সংঘাতের ইতি টানবেন। ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানকে তিনি নিজের অন্যতম প্রধান কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে চান। ট্রাম্পের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে থাকলে মার্কিন স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং এটি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা দরকার, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মোকাবেলায় মনোনিবেশ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা প্রদানে যে বিপুল ব্যয় হচ্ছে, তা কমানোর চাপ বাড়ছে। মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সসহ অনেকে মনে করছেন, এই বোঝা ইউরোপের ওপরই প্রধানত বর্তানো উচিত।
তৃতীয়ত, মার্কিন সরকার এখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, পশ্চিমা দেশগুলোর ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে হারানোর সম্ভাবনা নেই। সুতরাং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। তবে পশ্চিমা দেশগুলো শান্তিচুক্তির আলোচনায় ইউক্রেনকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে—একদিকে যাতে কিয়েভ রাশিয়ার কাছে কিছু ভূখণ্ড ছাড়তে রাজি হয়, অন্যদিকে ভবিষ্যতে নতুন সংঘাত ঠেকানো যায়।
ওয়াশিংটন বৈঠকের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল- ইউক্রেনকে এমন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া, যা ন্যাটোর অনুচ্ছেদ-৫ (সমষ্টিগত প্রতিরক্ষা)–এর মতো কার্যকর হবে। অর্থাৎ ইউক্রেন আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোতে যোগ না দিলেও দেশটির ওপর আক্রমণ হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা সম্মিলিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে। মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকাফ দাবি করেন, আলাস্কার বৈঠকে পুতিন এই নিশ্চয়তায় সম্মতি জানিয়েছেন। জেলেনস্কি একে 'ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত' আখ্যা দিয়ে বলেন, নিশ্চয়তাগুলো কার্যকর, নির্ভরযোগ্য ও স্থল, আকাশ এবং সমুদ্রপথে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

ইউরোপীয় নেতারাও প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেছেন, তবে তারা ইউরোপের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে ১৯৯৪ সালের ব্যর্থ নিরাপত্তা নিশ্চয়তার অভিজ্ঞতা পুনরাবৃত্তি না হয়। তবে মনে করা হচ্ছে, এসব নিশ্চয়তার বিনিময়ে ইউক্রেনকে কিছু ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতে হবে।
আগে ইউক্রেন ভূখণ্ড ছাড়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকলেও এখন তারা নানা কারণে আপসের পথে হাঁটছে—
প্রথমত, যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা বলছে, ক্রিমিয়া বা দোনবাসের কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। ট্রাম্প স্পষ্ট বলেছেন, ক্রিমিয়া ফেরত পাওয়া সম্ভব নয় এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আশা ছাড়তে হবে।
দ্বিতীয়ত, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও সামরিক সম্পদের ঘাটতি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা সীমিত হওয়ায় কিয়েভ শান্তি আলোচনার প্রতি আগ্রহী হয়েছে।
তৃতীয়ত, ইউরোপীয় নেতারা এখন সমন্বিতভাবে শান্তির আহ্বান জানাচ্ছেন। জেলেনস্কি মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উপস্থিতিতে বহুপাক্ষিক আলোচনাই ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সবচেয়ে কার্যকর পথ। তাই তিনি জোর দিয়েছেন যে যেকোনো চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
সবমিলিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতাদের অংশগ্রহণে ওয়াশিংটন বৈঠক ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান চেষ্টায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের ইতি চায়; অপরদিকে ইউক্রেন শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিনিময়ে ভূখণ্ড ছাড়তে রাজি হতে পারে। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা নির্ভর করবে—রাশিয়ার দাবির সঙ্গে ইউক্রেনের প্রত্যাশার মধ্যে ভারসাম্য আনা সম্ভব হয় কি না তার ওপর। তা না হলে, ইউক্রেনে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা বর্তমানের চেয়েও কঠিন হয়ে উঠবে।#