লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী লড়াই; কেন চীন-রাশিয়ার নাম আসছে?
https://parstoday.ir/bn/news/world-i154040-লাতিন_আমেরিকায়_যুক্তরাষ্ট্রের_মাদকবিরোধী_লড়াই_কেন_চীন_রাশিয়ার_নাম_আসছে
পার্সটুডে- পশ্চিম গোলার্ধে মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের শ্লোগান তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 'মনরো ডকট্রিন' পুনরুজ্জীবিত করছে এবং মাদকবিরোধী অভিযানকে এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।     
(last modified 2025-11-15T09:01:27+00:00 )
নভেম্বর ১৪, ২০২৫ ২০:৫৬ Asia/Dhaka
  • মার্কিন যুদ্ধমন্ত্রী
    মার্কিন যুদ্ধমন্ত্রী

পার্সটুডে- পশ্চিম গোলার্ধে মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের শ্লোগান তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 'মনরো ডকট্রিন' পুনরুজ্জীবিত করছে এবং মাদকবিরোধী অভিযানকে এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।     

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ সামাজিক মাধ্যম "এক্স"-এ এক পোস্টে পশ্চিম গোলার্ধে মাদকবিরোধী সামরিক অভিযানের তীব্রতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে স্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো আঞ্চলিক নীতি 'মনরো তত্ত্ব' পুনরায় তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, “পশ্চিম গোলার্ধ আমেরিকার পিছনের আঙিনা এবং আমরা এটিকে রক্ষা করব।”

এই বক্তব্য শুধু “পেছনের আঙিনা রক্ষা” নীতির প্রতিধ্বনি নয়, বরং চীন এবং রাশিয়ার মতো বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্যও একটি স্পষ্ট বার্তা।

সিএফআরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলো এই খবরটি ফলাও করে প্রচার করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধরনের আক্রমণাত্মক মোড়—যেখানে মাদকবিরোধী অভিযানকে আঞ্চলিক প্রভাব পুনরুদ্ধারের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত যুক্তি হলো—মাদকসংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলা।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তথ্য অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকা থেকে কোকেন ও ফেন্টানিল চোরাচালান হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসছে এবং এর ফলে বছরে এক লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প প্রশাসন এই সমস্যাকে “নারকো টেররিজম” এর পর্যায়ে উন্নীত করে, যা সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে অভিহিত করা হয়।

২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে ট্রাম্প কলম্বিয়া, মেক্সিকো ও ভেনেজুয়েলার মতো গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট দেশগুলোকে লক্ষ্য করে একটি নির্বাহী নির্দেশে সই করেন এবং সামরিক অভিযানের জন্য বিপুল বাজেট বরাদ্দ দেন। হ্যাগসেথ ২০২৫-এর নভেম্বরে “সাউদার্ন স্পিয়ার” অপারেশন ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে ড্রোন, সমুদ্র-রোবট এবং বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করে লাতিন আমেরিকায় “নারকো-সন্ত্রাসী” নির্মূলের পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে তারা ঘোষণা দিয়েছে।

মার্কিন গোয়েন্দা পোর্টাল স্ট্র্যাটফোরের পূর্বাভাস অনুযায়ী- ২০২৬ সালে এসব অভিযান ক্যারিবিয়ান ও দক্ষিণ আমেরিকার আরও বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই বলে সতর্ক করেছে যে, এসব পদক্ষেপ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অজুহাত হয়ে দাঁড়াতে পারে বিশেষ করে ভেনেজুয়েলায় এই হস্তক্ষেপ বাড়তে পারে। ভেনিজুয়েলার নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র মাদক কার্টেলগুলোর পৃষ্ঠপোষক বলে অভিযুক্ত করে আসছে। কিন্তু মাদুরো সরকার এই অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।

কিন্তু আমেরিকার এই নীতির আরেকটি গভীরতর স্তর রয়েছে ভূরাজনীতি অর্থাৎ লাতিন আমেরিকায় চীন ও রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিহত করা। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে অঞ্চলটি বৈশ্বিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র এরিমধ্যে ঐ এলাকায় তার ঐতিহ্যবাহী প্রভাব অনেকটাই হারিয়েছে, কিন্তু এখন দেশটি মাদকবিরোধী পদক্ষেপ তথা অভিযানের নামে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করতে চাইছে।

২০২৫-এর অক্টোবরে পেন্টাগন ক্যারিবিয়ানে একটি অ্যান্টি-নারকোটিক স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠন করে, যা একই সঙ্গে কার্টেলগুলোর নেটওয়ার্ক ও চীন–রাশিয়ার প্রভাব বিশ্লেষণ করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। মার্কিন যুদ্ধমন্ত্রী হ্যাগসেথ সাংবাদিকদের বলেন—লাতিন আমেরিকায় রাশিয়া, চীন ও ইরানের প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এটি তাদের দৃষ্টিতে “আমেরিকার পিছনের আঙিনা রক্ষা” করার কৌশলের অংশ।

এদিকে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীন এই অঞ্চলের সঙ্গে ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। চীনা কাস্টমসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানের সঙ্গে চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে—যা আগের বছরের তুলনায় ১৪% বেশি। ২০২৫ সালে এটি বেড়ে ৫১৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চীন এখন অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।

২০২৪ সালে লাতিন আমেরিকায় চীনের সরাসরি বিনিয়োগ ছিল ১৪.৭১ বিলিয়ন ডলার, যা মূলত অবকাঠামো, জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে কেন্দ্রীভূত।

যুক্তরাষ্ট্র এই অর্থনৈতিক উপস্থিতিকে নিরাপত্তা-হুমকি হিসেবে দেখছে। এ কারণে “মাদকবিরোধী নিষেধাজ্ঞা” ব্যবহার করে বেইজিং–ঘনিষ্ঠ দেশগুলোর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।

রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রভাব তুলনামূলক কম হলেও মস্কো সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অঞ্চলে অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০২৪ সালে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য ১.২ বিলিয়ন ডলার ছিল, যার বেশিরভাগই ছিল অস্ত্র  খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এসআইপিআরআই'র তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রি কমেছে, কিন্তু কিউবা, নিকারাগুয়া ও ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বহাল আছে।

২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভেনেজুয়েলা তার ৮৫% এর বেশি সামরিক সরঞ্জাম রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে—যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবিমান, ট্যাংক এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সিএসআইএস'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে রাশিয়া লাতিন আমেরিকায় তার সামরিক কূটনীতি আরও বাড়িয়েছে।

এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র মাদক কার্টেল নির্মূল অভিযান তীব্রতর করেছে এবং মাদকবিরোধী অভিযান বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে মনরো তত্ত্ব পুনরুজ্জীবিত করছে।  তারা ক্রমেই সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে, যদিও একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে পশ্চিম গোলার্ধ এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশ মনরো তত্ত্ব ঘোষণার সময়কার পরিস্থিতির তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন।#

পার্সটুডে/এসএ/১৪