যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল: পুরোনো সাম্রাজ্যবাদের নতুন মোড়ক
-
ডোনাল্ড ট্রাম্প
পার্সটুডে : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নথি প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে ওয়াশিংটন তার দীর্ঘদিনের আধিপত্যবাদী নীতিকে নতুন ভঙ্গিতে পুনর্ব্যক্ত করেছে।
পার্সটুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন সদ্য প্রকাশিত “জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল ২০২৫”-এ ইরানকে কেন্দ্র করে পুরোনো অভিযোগগুলো পুনরায় উত্থাপন করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী ভূমিকাকে আঞ্চলিক ভূমিকায় রূপান্তরিত করার এবং লাতিন আমেরিকায় প্রভাব বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে।
নথির ভূমিকায় ট্রাম্প দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের “মিডনাইট হ্যামার” ইরান তার পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ ক্ষমতা হারিয়েছে। তবে এ দাবি আমেরিকার নিজস্ব নিরাপত্তা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। জুলাইয়ের ঘটনায় ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। আইএইএ মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি-ও ২০২৫ সালের নভেম্বরে বলেন, “ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংসের কথা বললেও, ইরানের প্রযুক্তিগত জ্ঞান নষ্ট হয়নি। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে ব্যবহারযোগ্য সেন্ট্রিফিউজগুলো পুনর্নির্মাণযোগ্য।”
ট্রাম্প আরও দাবি করেন, মাত্র আট মাসে যুক্তরাষ্ট্র আটটি আন্তর্জাতিক সংঘাত সমাধান করেছে- যার মধ্যে কম্বোডিয়া–থাইল্যান্ড, কসোভো–সার্বিয়া, কঙ্গো–রুয়ান্ডা, পাকিস্তান–ভারত, ইসরায়েল–ইরান, মিশর–ইথিওপিয়া, আর্মেনিয়া–আজারবাইজান এবং গাজা যুদ্ধ। তবে এসব দাবির বেশ কয়েকটি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোই অস্বীকার করেছে। বিশেষ করে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ১২ দিনের আক্রমণের ক্ষেত্রে কোনো আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা ছিল না; কেবল হামলা স্থগিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নথি ট্রাম্পের নিয়মভঙ্গকারী “আমেরিকা ফার্স্ট” দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছে। যার অর্থ হলো- মার্কিন স্বার্থকে সব সিদ্ধান্ত ও নীতির শীর্ষে রাখতে হবে।
নথিটি ট্রাম্পের “আমেরিকা প্রথম” নীতির ব্যাখ্যা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক নেতৃত্বের বদলে পশ্চিম গোলার্ধে প্রভাব বিস্তারে মনোযোগ দেবে। পাশাপাশি চীনকে এখনও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ, ন্যাটো ও ইউরোপের ওপর চাপ বৃদ্ধি, ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি অব্যাহত রাখা- এসবই নথিতে মার্কিন আধিপত্যবাদের ধারাবাহিকতা প্রতিফলিত করে। এতে মনরো নীতির পুনর্জাগরণেরও ইঙ্গিত রয়েছে।
লাতিন আমেরিকাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অবস্থান নথিতে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন লাতিন আমেরিকায় প্রভাব বিস্তারে বিশেষ গুরুত্ব দেবে, বামপন্থী সরকারগুলোর বিরোধিতা করবে এবং পানামা খালের মতো কৌশলগত অঞ্চলে নজরদারি বাড়াবে। পাশাপাশি মাদকচক্র দমনের নামে নিরাপত্তা উপস্থিতি জোরদারের কথাও উল্লেখ রয়েছে।
নথির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো অভিবাসন বিষয়ে কঠোর অবস্থান। এতে বলা হয়েছে, “বৃহৎ পরিসরের অভিবাসনের যুগ শেষ হওয়া উচিত” এবং সীমানা নিরাপত্তাকে জাতীয় নিরাপত্তার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ইউরোপ ও ন্যাটো প্রসঙ্গে নথির ভাষা সমালোচনামূলক। এতে দাবি করা হয়েছে, ইউরোপীয় সভ্যতা হুমকির মুখে রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সমর্থন করবে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ইউরোপের ওপর মার্কিন চাপ বাড়ানোর কৌশল এবং নেটোকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা।
পশ্চিম এশিয়া প্রসঙ্গে নথিতে গাজা যুদ্ধের অবসান এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া হলেও, ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সামরিক আক্রমণকে ন্যায়সঙ্গত বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা কমে গেছে বলে যে দাবি করা হয়েছে, তা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে বিভিন্ন পক্ষ উল্লেখ করেছে।
সার্বিকভাবে, ২০২৫ সালের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নথি যুক্তরাষ্ট্রের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির ধারাবাহিক বহিঃপ্রকাশ। বৈশ্বিক আধিপত্য থেকে সরে আসার দাবি জানালেও নথির ভেতরকার নীতি–অবস্থান থেকে স্পষ্ট যে, ওয়াশিংটন এখনও বিশ্বের কৌশলগত অঞ্চলগুলোতে নিজেদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আগ্রহী।#
পার্সটুডে/এমএআর/৬