ইসরাইলের পতনের নানা লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে: ইরানের সর্বোচ্চ নেতা
(last modified Sat, 25 Feb 2017 12:47:08 GMT )
ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭ ১৮:৪৭ Asia/Dhaka
  • ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী
    ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী

সম্প্রতি (২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭) তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়েছে 'ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদা বা গণ-সংগ্রামের প্রতি সমর্থন' শীর্ষক ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক সম্মেলন।

এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী। 

এখানে তার ওই ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তুলে ধরা হল:

[আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শুরু করার আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন মুসলমানদের নেতা ম্যালকম এক্সকে  শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এবং সম্মেলনে উপস্থিত সবাইকে অনুরোধ করেন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শহীদ এই নেতার ৫২ তম শাহাদত-বার্ষিকী উপলক্ষে (২১ ফেব্রুয়ারি,১৯৬৫) একবার সুরা ফাতিহা ও সুরা তাওহিদ বা ইখলাস তিলাওয়াত করেন।  এই বিপ্লবী বীরকে বর্ণবাদী সন্ত্রাসীরা নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে বর্ণবাদ বিরোধী বক্তব্য রাখার সময় খুব কাছ থেকে ১৫টি গুলিবিদ্ধ করে শহীদ করেছিল।]

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী  তাঁর বক্তব্য শুরু করেন পবিত্র কুরআনের সুরা আলে ইমরানের ১৩৯ ও সুরা মুহাম্মাদের ৩৫ নম্বর আয়াত আয়াত দিয়ে, যেখানে মহান আল্লাহ ইমানদার মুসলমানদেরকে কষ্টকর সংগ্রাম অব্যাহত রাখার অনুপ্রেরণা যোগাতে তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন:

‘আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে।’ ‘অতএব, তোমরা হীনবল হয়ো না এবং শত্রুদের কাছে নতজানু-সুলভ সন্ধির আহবান জানিও না, আর তোমরাই বিজয়ী হবে। আল্লাহই তোমাদের সাথে আছেন। তিনি কখনও তোমাদের ভালো কাজগুলোর প্রতিফল তথা সওয়াব কমাবেন না’।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ফিলিস্তিনি জাতির সংগ্রামের চড়াই-উৎরাইয়ের কথা তুলে ধরে বলেছেন, ধৈর্যশীল, বীর ও সংগ্রামী ফিলিস্তিনিরা মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে মজলুম জাতিতে পরিণত হয়েছে এবং তাদের অশেষ দুঃখ-দুর্দশা প্রত্যেক মুক্তিকামী, সত্যান্বেষী ও ন্যায়বিচারকামী মানুষকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। তারা সবচেয়ে মজলুম এ কারণে যে, ইতিহাসে আর কখনও এমনটি ঘটেনি যে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের আওতায় একটি দেশকে পুরোপুরি জবর-দখল করা হয়েছে এবং ওই জাতিকে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে অন্য এক গোষ্ঠীর লোকদেরকে সারা বিশ্ব থেকে দলে দলে সেখানে পাঠানো হয়েছে। আর এভাবে সেখানকার প্রকৃত অধিবাসীদের অস্তিত্বকে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং সেখানে বসানো হয়েছে ভুয়া ও অবৈধ অধিবাসীদেরকে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এরপর দৃঢ় আশাবাদ তুলে ধরে বলেছেন, ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী ইসরাইল সৃষ্টি করা ইতিহাসের অন্যতম অপবিত্র অধ্যায় যার অবসান ঘটবে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাঁর সহায়তায়। কারণ, অতীতেও  মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ও সহায়তায় অবসান ঘটেছে এ জাতীয় অপবিত্র অধ্যায়ের।  মহান আল্লাহ সুরা আসরার ৮১ নম্বর আয়াতে বলেছেন, বলুন: সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই মত বিষয়। এ ছাড়াও সুরা আম্বিয়ার ১০৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

‘আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাহরাই অবশেষে পৃথিবীর রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হবে।’

আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী আরও বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনকে সহায়তা দেয়ার বিষয়ে তেহরানের এই সম্মেলন সবচেয়ে কঠিন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কারণ আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মোকাবেলায় লড়াইরত ফিলিস্তিনি জাতির সব সময়ের সাহায্যদাতা আমাদের এই অঞ্চল এখন নানা সংকট ও অশান্তির শিকার হয়েছে’। 

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, কয়েকটি মুসলিম দেশের চলমান সংকটের কারণে ফিলিস্তিন ও পবিত্র কুদসকে মুক্ত করার সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ম্লান হয়ে পড়েছে। আর এইসব সংকটের ফলে লাভবান হচ্ছে সেইসব শক্তি যারা এ অঞ্চলে ইসরাইলকে জন্ম দিয়েছে। এইসব সংকটকে দীর্ঘকাল ধরে জিইয়ে রেখে তারা এ অঞ্চলের শান্তি ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি মুসলিম জাতিগুলোর শক্তি কমাতে চায় এবং তাদেরকে ভুলিয়ে দিতে চায় ফিলিস্তিনি জাতির স্বপ্ন-সাধ বাস্তবায়ন তথা তাদের অধিকার ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গটি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দৃষ্টিতে মুসলিম জাতিগুলো যেন ফিলিস্তিন প্রসঙ্গটিকে আর অগ্রাধিকার না দেয় এটাও এইসব সংকট সৃষ্টির অন্যতম অশুভ উদ্দেশ্য।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেন, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে শত্রুদের মদদে এবং উদাসীনতার কারণে সৃষ্ট কৃত্রিম ও স্বাভাবিক কিছু মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও ফিলিস্তিন প্রসঙ্গটি মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত। মুসলিম বিশ্ব ছাড়াও ন্যায়বিচারকামী ও সত্যান্বেষী সব মহলের পক্ষ থেকেই ফিলিস্তিন ইস্যুকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেছেন, ‘ ইসরাইলি শাসকগোষ্ঠী ফিলিস্তিনিদের ওপর চালাচ্ছে নৃশংস দমন-অভিযান, তাদেরকে বন্দি করছে ব্যাপক হারে এবং তাদেরকে বঞ্চিত করছে মানবীয় প্রাথমিক অধিকারসহ সব অধিকারগুলো থেকে। এ ছাড়াও ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ, লুণ্ঠন ও এই জাতির ভূখণ্ডগুলো জবর-দখল করে সেখানে অবৈধ উপশহর নির্মাণ, পবিত্র শহর কুদস ও মসজিদুল আকসাসহ ইসলামের এবং খ্রিস্ট ধর্মের নানা পবিত্র স্থানের পরিচিতি বদলে দেয়ার চেষ্টাসহ সেখানে নানা অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী। আর এইসব অপরাধ ঘটছে মার্কিন ও কয়েকটি পশ্চিমা সরকারের সর্বাত্মক মদদে এবং দুঃখজনকভাবে বিশ্ব এসব অপরাধের ব্যাপারে উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না।’

 অবশ্য ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মনে করেন ইসরাইলের পতনের নানা লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ইসরাইলের প্রধান মিত্রগুলো, বিশেষ করে মার্কিন সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং বিশ্ব-সমাজ ক্রমেই ইসরাইলের নানা অবৈধ পদক্ষেপ, নৃশংসতা ও অমানবিক পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে ক্রমেই।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ফিলিস্তিনি জাতির প্রশংসা করে বলেছেন, পবিত্র শহর বায়তুল মুকাদ্দাস ও আল-আকসা মসজিদকে রক্ষার মহতী দায়িত্বটি পালন করছেন ফিলিস্তিনিরা যা মহান আল্লাহ তাদের ওপর ন্যস্ত করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, অধিকৃত ফিলিস্তিনে এখন যে তৃতীয় দফা ইন্তিফাদা বা ইসলামী গণ-জাগরণ শরু হয়েছে তা অতীতের দুই ইন্তিফাদার চেয়ে বেশি মজলুম, তবে তা গতিশীলতার দিক থেকে প্রোজ্জ্বল ও আশায় ভরপুর এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছায় এই ইন্তিফাদা সংগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের সূচনা করবে ও তা দখলদার ইসরাইলের ওপর আরও একটি বড় পরাজয় চাপিয়ে দেবে। 

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে কথিত বাস্তবতার অজুহাত দেখিয়ে  ইসরাইলের সঙ্গে আপোষ করা ও ফিলিস্তিনিদের বেলায় ন্যূনতম অধিকার রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না। ইহুদিবাদী ইসরাইলের অবৈধ অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে ফিলিস্তিনি জাতির পরিচিতি ও অস্তিত্বকে ক্রমেই ধ্বংস করতে হবে। আর এইসব কারণেই ফিলিস্তিনি জাতির সমস্ত পরিচিতি ও নিদর্শন রক্ষা করা জরুরি ও তা এক পবিত্র জিহাদ। 

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে গত তিন দশকে আপোষ প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা ও পবিত্র বীরত্বপূর্ণ ইন্তিফাদার ব্যাপক সাফল্যও স্পষ্ট হয়ে গেছে। দখলদারদের সঙ্গে  আপোষের পক্ষপাতী কোনো কোনো মুসলিম সরকার প্রতিরোধের নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। কিন্তু আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মনে করেন এটা স্পষ্ট যে প্রতিরোধের মাধ্যমে গোটা ফিলিস্তিনকে এখনও দখলমুক্ত করা সম্ভব না হলেও এর ফলে ফিলিস্তিন ইস্যু এখনও জীবন্ত রয়েছে। প্রতিরোধের কারণেই গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্রসহ ইসরাইলের নানা আগ্রাসী ষড়যন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিরোধের কারণেই দক্ষিণ লেবানন ও গাজাকে ইসরাইলের দখল থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিরোধের কারণেই গাজা ও লেবাননের কয়েকটি যুদ্ধে ইসরাইল পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মনে করেন মজলুম ফিলিস্তিনি জাতিকে সহায়তা দেয়ার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু আদায় করার মানসিকতা থাকা উচিত নয়। তার মতে সাহায্যগুলোকে কেবল ফিলিস্তিনি জনগণের কল্যাণে ও তাদের প্রতিরোধ শক্তিশালী করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা- কেবল সেটাই দেখা উচিত। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যারা যত বেশি প্রতিরোধকামী ইসলামী ইরান তাদেরকে তত বেশি ঘনিষ্ঠ মনে করছে ও তাদেরকে ততই বেশি মাত্রায় সাহায্য দিচ্ছে। 

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে ফিলিস্তিনি জাতির মধ্যে ঐক্য ও সংগ্রামের ধারা এমনই হওয়া উচিত যে কখনও যদি কোনো গোষ্ঠী শত্রুদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সংগ্রামের পথ ছেড়ে দেয় তখন যেন তাদেরই অন্য গোষ্ঠী সংগ্রামের পতাকা হাতে তুলে নিতে পারে। সবশেষে ফিলিস্তিন বিষয়ক তেহরান-সম্মেলন মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের বড় সোপান হবে এবং মুসলিম জাতিগুলো সব মত-বিরোধের সমাধান করে ঐক্যবদ্ধ হবে বলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী আশা প্রকাশ করেছেন।   #

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/২৫

 

ট্যাগ