ইমাম জাওয়াদের (আ) দৃষ্টিতে শয়তান-পূজারী, বিশ্বাসঘাতক ও বিশ্বাসীর পরিচয়
যিলক্বদ মাসের শেষ দিবস মশহুর (প্রসিদ্ধ) অভিমত অনুসারে মহানবী (সা:)-এর পবিত্র আহলুল বাইত (আ:)-এর নবম মাসুম (নিষ্পাপ) ইমাম মুহাম্মাদ তাকী আল-জাওয়াদ (আ:)-এর শাহাদাত দিবস। মশহুর বর্ণনা ও অভিমত মোতাবেক আব্বাসীয় খলিফা মামূনের মৃত্যুর আড়াই বছর পরে আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিমের নির্দেশে ইমাম জাওয়াদকে বাগদাদে বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করা হয়। বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় এই মহান ইমামের শাহাদাত-বার্ষিকী
ইমাম জাওয়াদ (আ:) আব্বাসীয় খলিফা মামূনের মাধ্যমে এতটা নির্যাতন ও জুলুমের শিকার হয়েছিলেন যে তিনি (আ:) মৃত্যুবরণের মাঝেই শ্বাসরুদ্ধকর এ অবস্থা থেকে তাঁর মুক্তিলাভের একমাত্র উপায় বলে অভিহিত করেছিলেন তাঁর এ কথার মধ্য দিয়ে:–
اَلفَرَجُ بَعدَ المَأمُونِ بِثَلَاثِینَ شَهرَاً
“মামূনের মৃত্যুর পর ৩০ মাসের মধ্যেই মুক্তি (আসছে)”
ইমাম জাওয়াদ (আ:)-এর পিতা ৮ম মাসুম (নিষ্পাপ) ইমাম হযরত আলী ইবনে মূসা আর রিযা (আ:)ও আব্বাসীয় খলিফা মামূনের পক্ষ থেকে খিলাফতের উত্তরাধিকারী ( ওয়ালী-ই আহদ) ঘোষিত হওয়ার পর খলিফা মামূনের নির্দেশে বিষ প্রয়োগে তাঁর শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত উক্ত আব্বাসীয় খলিফার (মামূন) মাধ্যমে এ ধরণের নির্যাতন,উৎপীড়ন,যাতনা,জুলুম ও কষ্টের শিকার হয়েছিলেন। আর অবস্থা ও পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ও দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি (ইমাম রিযা আ:)ও প্রতি শুক্রবার জামে মসজিদ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ঘর্মাক্ত ও ধুলোমাখা মলিন বদনে মহান আল্লাহ পাকের দরগাহে দু-হাত তুলে দুআ করে বলতেন: ‘হে ইলাহী, আমার মৃত্যুর মাঝেই যদি মুক্তি নিহিত থাকে তাহলে এখনই আমার মৃত্যু দিন।’ আর ইমাম রিযা (আ:) শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত সর্বদা নির্যাতন, দুঃখ,কষ্ট ও যাতনার মধ্যেই ছিলেন। ইমাম মুহাম্মাদ তাকী আল-জাওয়াদ (আ:) যখন শহীদ হন তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ২৫ বছর কয়েক মাস। তাঁকে বাগদাদ নগরীর কাযিমাইনের পবিত্র মাযারে তাঁর পিতামহ ৭ম মাসুম ইমাম মূসা ইবনে জাফার আল-কাযিম (আ:)-এর পাশে সমাহিত করা হয়।
এই মাসুম ইমামের শাহাদত দিবসে তাঁর কিছু অমিয় বাণীর অনুবাদ পেশ করছি:
بسم الله الرّحمن الرّحیم
১. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: যে ব্যক্তি যে কোন কথক (বক্তা) বা আহ্বানকারীর কথা (যাচাই বাছাই না করে) শ্রবণ করবে সে আসলে তারই ইবাদত করল, তাই উক্ত কথক বা বক্তা (নাতিকنَاطِق) অর্থাৎ আহ্বানকারী যদি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে (মনোনীত ও নিযুক্ত) হয় তাহলে এমতাবস্থায় উক্ত শ্রবণকারী ব্যক্তি মহান আল্লাহরই ইবাদত করেছে। আর উক্ত কথক (বক্তা) বা আহ্বানকারী যদি ইবলিস শয়তানের ভাষায় কথা বলে তাহলে সে (শ্রবণকারী) ইবলিসেরই ইবাদত করল। (দ্র: তুহাফুল উকূল, পৃ: ৪৫৬০)
مَن أَصغَی إِلَی نَاطِقٍ فَقَد عَبَدَهُ ، فَإِن کَانَ النَّاطِقُ عَنِ اللهِ فَقَد عَبَدَ اللهَ ، وَ إِن کَانَ النَّاطِقُ یَنطِقُ عَن لِسَانِ إِبلِیسَ فَقَد عَبَدَ إِبلِیسَ.
২. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: মুমিন তিন জিনিসের প্রতি মুখাপেক্ষী। আর সেগুলো হচ্ছে: ১.মহান আল্লাহ প্রদত্ত সাফল্য ও সামর্থ্য (তৌফিক) ২. তার নিজ অন্তরের অন্তঃস্থলের উপদেশদাতা অর্থাৎ তার অন্তর (বিবেক) তাকে হিতোপদেশ প্রদান করবে এবং সে তা শুনবে এবং ৩. উপদেশদাতার হিতোপদেশ মেনে চলার সামর্থ্য ও ক্ষমতা (তুহাফুল উকূল,পৃ: ৪৫৭)।
اَلمُؤمِنُ یَحتَاجُ إِلَی تَوفِیقٍ مِنَ اللهِ ، وَ وَاعِظٍ مِن نَفسِهِ ، وَ قَبُولٍ مِمَّن یَنصَحُهُ.
৩.ইমাম জাওয়াদ (আ:)বলেন: যে ব্যক্তি মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার ও সদাচরণ করা থেকে বিরত থাকবে অপছন্দনীয় বিষয় (দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ) তার নিকটবর্তী হবে (অর্থাৎ সে দুঃখ-কষ্টে আপতিত এবং বিপদগ্রস্ত হবে)। (দ্র: বিহারুল আনওয়ার, খ:৭৮, পৃ: ৩৬৮)
مَن هَجَرَ المُدَارَاةَ قَارَبَهُ المَکرُوهُ.
৪. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: যে ব্যক্তি খোদার রাহে ভাইকে ব্যবহার করবে (যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের ভাই হবে এবং তার সাথে ভ্রাতৃত্বের আদব-কায়দা ও নিয়ম-কানুন মেনে চলবে ও রক্ষা করবে) বেহেশতে সে একটি গৃহ (বসত-বাড়ি) পাবে। (শেখ আব্বাস কুমী প্রণীত ১৪ মাসুম (আ:)-এর জীবনের প্রতি দৃকপাত, পৃ: ৪১৫)।
مَنِ استَفَادَ أَخَاً فِی اللهِ فَقَدِ استَفَادَ بَیتَاً فِی الخَتَّةِ .
৫. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে সে আসলে তার শত্রুর আশা-আকাঙ্ক্ষারই বাস্তবায়ন করে। (দ্র: প্রাগুক্ত,পৃ: ৪১৫)
مَن أَطَاعَ هَوَاهُ أَعطَی عَدُوَّهُ مُنَاهُ.
৬. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: যে ব্যক্তি নিজ রিপু ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার উপর আরোহণ করে আসলে সে পতিত ও পদস্খলিত হওয়ার পর উঠে দাঁড়়াতে পারে না। (দ্র: প্রাগুক্ত)
رَاکِبُ الشَّهَوَاتِ لَا یُقَالُ عَثرَتَهُ .
৭. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: মহান আল্লাহর প্রতি আস্থা মহামূল্যবান সব জিনিস ও বিষয়ের মূল্য এবং সকল সুউচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার সোপান স্বরূপ। (দ্র: প্রাগুক্ত)
اَلثِّقَةُ بِاللهِ ثَمَنٌ لِکُلِّ غَالٍ وَ سُلَّمٌ إِلَی کُلِّ عَالٍ .
৮. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: মুমিনের সম্মান ও মর্যাদা হচ্ছে অন্য সকল মানুষের কাছে তার মুখাপেক্ষী না হওয়া। (দ্র: প্রাগুক্ত )
عِزُّ المُؤمِنِ غِنَاهُ عَنِ النَّاسِ .
৯. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: প্রকাশ্যে মহান আল্লাহর বন্ধু এবং গোপনে তাঁর শত্রু হয়ো না। (দ্র: প্রাগুক্ত)
لَا تَکُن وَلِیَّ اللهِ فِی العَلَانِیَّةِ عَدُوَّاً لَهُ فِی السِّرِّ .
১০. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: (কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য) আন্তরিকতা সহকারে মহান আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ (তাওয়াজ্জুহ) কর্মগুলো সম্পাদন করার মাধ্যমে (শারীরিক) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে ক্লান্ত-শ্রান্ত করার চেয়েও উত্তম। (দ্র: প্রাগুক্ত)
اَلقَصدُ فِی اللهِ بِالقُلُوبِ أَبلَغُ مِن إِتعَابِ الجَوَارِحِ بِالأَعمَالِ .
১১. ইমাম জাওয়াদ (আ:)বলেন: একজন ব্যক্তির খায়েন (বিশ্বাসঘাতক) হওয়ার জন্য কেবল এতটুকুই যথেষ্ট যে সে বিশ্বাসঘাতকদের কাছে বিশ্বস্ত (আমীন) হবে। (দ্র: প্রাগুক্ত,পৃ: ৪১৬)
کَفَی بِالمَرءِ خِیَانَةً أَن یَکُونَ أَمِینَاً لِلخَوَنَةِ .
১২. ইমাম জাওয়াদ (আ:)বলেন: পাপাচারী দুর্বৃত্ত ( দুষ্ট,দুষ্কৃতিকারী)দের সাথে উঠাবসা ও সাহচার্য পরিহার ও বর্জন করবে।কারণ এ ধরণের ব্যক্তি নাঙা তলোয়ারের মতো যা বাহ্যত: দেখতে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন হলেও কুফল ও কুপ্রভাব বিস্তার করে। (দ্র: প্রাগুক্ত,পৃ: ৪১৬)
إِیَّاکَ وَ مُصَاحَبَةَ الشَّرِیرِ فَإِنَّهُ کَالسَّیفِ المَسلُولِ ، یُحسَنُ مَنظَرُهُ وَ یُقبَحُ آثَارُهُ .
১৩. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: ঐ ব্যক্তি তোমার সাথে শত্রুতা প্রদর্শন করেছে যে নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে উন্নতি ও প্রবৃদ্ধির পথ (এখানে হিদায়েত) তোমার থেকে গোপন রেখেছে। (দ্র: প্রাগুক্ত,পৃ: ৪১৬)
قَد عَادَاکَ مَن سَتَرَ عَنکَ الرُّشدَ إِتِّبَاعَاً لِمَا یَهوَاهُ .
১৪. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: যে ব্যক্তি অমুখাপেক্ষী হবে (অমুখাপেক্ষিতার বৈশিষ্ট্যাধিকারী হবে) সে নিজ পরিবারের কাছে সম্মানিত ও প্রিয়পাত্র (আযীয) হবে। অতঃপর তাঁকে (ইমাম জাওয়াদ) বলা হল: পরিবারের বাইরে অন্যান্য লোকের কাছেও কি সে সম্মানের পাত্র হবে? তখন তিনি (ইমাম জাওয়াদ) বললেন: না, তবে সে যদি তাদের কোনো উপকার সাধন করে তাহলে সে তাদের কাছে প্রিয় ও সম্মানের পাত্র হবে। (দ্র: প্রাগুক্ত,পৃ: ৪১৬)
مَنِ استَغنَی کَرُمَ عَلَی أَهلِهِ ، فَقِیلَ لَهُ وَعَلَی غَیرِ أَهلِهِ ، قَالَ : لَا، إِلَّا أَن یَکُونَ یَجدِی عَلَیهِم نَفعَاً .
১৫. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: ঐ ব্যক্তি কিভাবে ধ্বংস হবে মহান আল্লাহ হচ্ছেন যার জিম্মাদার ? ঐ ব্যক্তি কিভাবে নাজাত (মুক্তি) পাবে স্বয়ং মহান আল্লাহ যাকে খুঁজছেন? আর যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে অন্য সত্ত্বার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে (এবং তার শরণাপন্ন হয়েছে) মহান আল্লাহ তাকে তার নফসের (প্রবৃত্তি) কাছে হস্তান্তর করেছেন। আর যে ব্যক্তি জ্ঞান ও পরিচিতি ছাড়াই কাজ করে সে কাজকর্ম সঠিকভাবে আঞ্জাম দেয়ার চাইতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাজ নষ্ট করে ফেলে। (দ্র: প্রাগুক্ত,পৃ: ৪১৬)
کَیفَ یَضِیعُ مَنِ اللهُ کَافِلُهُ ، کَیفَ یَنجُو مَنِ اللهُ طَالِبُهُ ، وَ مَنِ انقَطَعَ إِلَی غَیرِ اللهِ وَکَلَهُ اللهُ إِلَیهِ وَ مَن عَمِلَ عَلَی غَیرِ عِلمٍ أَفسَدَ أَکثَرَ مِمَّا یُصلِحُ.
১৬. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: ঐ বিষয় যা তুমি করতে পছন্দ কর না কিন্তু তোমাকে সত্যের পথে দৃঢ়পদ রাখবে তোমার উচিৎ ধৈর্য সহকারে তা আঞ্জাম দেয়া। আর ঐ বিষয় যা তুমি করতে পছন্দ কর অথচ তোমাকে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার দিকে পরিচালিত করে তোমার উচিৎ ধৈর্যের সাথে তা বর্জন করা। (দ্র: প্রাগুক্ত,পৃ: ৪১৬)
اِصبِر عَلَی مَا تَکرَهُ فِیمَا یَلزِمُکَ الحَقُّ، وَاصبِر عَمَّا تُحِبُّ فِیمَا یَدعُوکَ الهَوَی.
১৭. ইমাম জাওয়াদ (আ:) বলেন: দৃঢ় ও মজবুত হওয়ার আগে বস্তু বা বিষয়কে প্রকাশ করা হচ্ছে ঐ বস্তু বা বিষয়ের জন্য ধ্বংসাত্মক। (দ্র: তুহাফুল উকূল,পৃ: ৪৫৭)
إِظهَارُ الشَّئِ قَبلَ أَن یُستَحکَمَ مَفسَدَةٌلَهُ
১৮. ইমাম জাওয়াদ (আ:) তাঁর কোনো এক অনুসারীর কাছে লিখেছিলেন: তবে এই দুনিয়ায় আমরা মহানবীর (সা:)-এর আহলুল বাইত (আখেরাতের জন্য) অঞ্জলী ভরে (পুণ্য) নিয়ে থাকি। কিন্তু যার আশা-আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে তার সঙ্গীর আশা-আকাঙ্ক্ষার অনুরূপ এবং যার ধর্মমত হচ্ছে নিজ সঙ্গীর ধর্মমতের ভিত্তিতে তার সঙ্গী যেখানে থাকবে সেও সেখানে থাকবে (অর্থাৎ যাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আদর্শ ও দ্বীন-ধর্ম হবে আহলুল বাইতের আশা-আকাঙ্ক্ষা,আদর্শ ও দ্বীন-ধর্মের অনুরূপ এবং আহলুল বাইতকে (আ:) ভালোবাসে আহলুল বাইত যেখানে থাকবেন সেখানে তারাও থাকবে)। আর আখেরাত হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাসস্থল (দারুল কারার)। (দ্র: তুহাফুল উকূল,পৃ: ৪৫৬)
وَ کَتَبَ إِلَی بَعضِ أَولِیَائِهِ : أَمَّا هذِهِ الدُّنیَا فَإِنَّا فِیهَا مُغتَرِفُونَ وَلکِنَّ مَن کَانَ هَوَاهُ هَوَی صَاحِبِهِ وَ دَانَ بِدِینِهِ فَهُوَ مَعَهُ حَیثُ کَانَ وَالآخِرَةُ هِیَ دَارُ القَرَارِ.
ইমাম জাওয়াদ (আ:)-এর অমিয় বাণীগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তৌফিক কামনা করছি মহান আল্লাহর কাছে। (মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান) #
পার্সটুডে/এমএএইচ/১২
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন