হাঞ্চব্যাক অব নটরডেম, হিজবুল্লাহ ও অপরূপার অঙ্গে বিস্ফোরণ
ড. সোহেল আহম্মেদ: ‘২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর সোমবার। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ির সঙ্গে রাজধানী তেহরানে বৈঠকে বসেছেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ বৈঠক। লেবাননের পরিস্থিতি নিয়ে কথার এক ফাঁকে ফ্রান্সের রোমান্টিক লেখক ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত উপন্যাস দ্য হাঞ্চব্যাক অব নটরডেমের প্রধান নারী চরিত্র এসমেরালদার নাম উচ্চারণ করলেন ইরানের সুপ্রিম লিডার, বললেন-উপন্যাসটি নিশ্চয় পড়েছেন!
একটু ভরকে গেলেন সাদ হারিরি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। সরাসরি জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলেন। আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি থামলেন না। তিনি বললেন, উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এসমেরালদা ছিলেন প্যারিসের সবচেয়ে সুন্দরী। তার প্রতি অনেকেরই লোলুপ দৃষ্টি ছিল। এ কারণে এসমেরালদা নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় সব সময় একটি অত্যন্ত ধারালো খঞ্জর সঙ্গে রাখতেন। লেবানন হচ্ছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের এমনি এক অপরূপা কনে, যার প্রতি অনেকের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে। আর তাদের মোকাবেলায় লেবাননের রক্ষাকবচ হচ্ছে হিজবুল্লাহর অস্ত্র। ইসরাইল এর আগে লেবাননের বৈরুত ও ত্রিপোলি পর্যন্ত এসেছিল, তারা সুযোগ পেলে লেবানন দখলে নিয়ে সিরিয়াকে ঘিরে ফেলবে।’
এভাবেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে সাদ হারিরির সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করেছেন লেবাননের সাবেক সংস্কৃতি ও তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ড. তারিক মিত্রি। তিনি সেদিনের বৈঠকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আরও বলেছেন, 'বৈঠকে হিজবুল্লাহর অস্ত্রকে লেবাননের প্রধান সমস্যা হিসেবে তুলে ধরে বক্তব্য রাখতে চেয়েছিলেন সাদ হারিরি। কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়নি।'
লেবানন অনেক আগে থেকেই সাজানো-গোছানো সুন্দর একটি দেশ। এ জন্য লেবাননকে মধ্যপ্রাচ্যের ‘অপরূপা কনে’ বলে অভিহিত করা হয়। ইরানের শীর্ষ নেতা এ কারণেই সুন্দরী এসমেরালদার সঙ্গে দেশটির তুলনা করেছেন। বহু বছর ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল লেবানন। দীর্ঘ সংগ্রামের পরিক্রমায় ১৯৪৩ সালে ফরাসিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এর কয়েক বছর পরই পাশের ভূখণ্ডেই দখলদারদের মাধ্যমে গড়ে ওঠে ইহুদিবাদী ইসরাইল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে লেবাননে দেখা দেয় গৃহযুদ্ধ। এই সুযোগে ১৯৮২ সালে লেবাননেরও বিশাল ভূখণ্ড দখল করে নেয় ইসরাইলি বাহিনী। ১৯৮৫ সালে ইসরাইলি আগ্রাসন ঠেকাতে ও নিজদের ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে গঠিত হয় হিজবুল্লাহ। মাত্র ১৫ বছরের সংগ্রামে দক্ষিণ লেবানন মুক্ত করতে সক্ষম হয় তারা। এরপর লেবাননের সর্বত্রই মুসলিম (শিয়া-সুন্নি) ও অমুসলিম সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হিজবুল্লাহ।
২০০৬ সালে হিজবুল্লাহকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধে নামে ইসরাইল। সেই যুদ্ধে ৩৩ দিনের বেশি টিকতে পারেনি তারা। এটি জুলাইয়ের যুদ্ধ নামেও পরিচিত। এই যুদ্ধে ২০টি মেরকাভা ট্যাঙ্ক ধ্বংস হওয়ার কথা স্বীকার করেছে তেল আবিব। এর আগ পর্যন্ত মেরকাভা ট্যাঙ্ককে অপরাজেয় যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে দাবি করতো ইসরাইল।মাত্র ৩৩ দিনের মধ্যেই ইসরাইলের যুদ্ধের খায়েশ মিটে যাবে তা কেউ ভাবতেও পারেনি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমি নিজেও ভাবতে পারিনি হিজবুল্লাহ এত স্বল্প সময়ে ইসরাইলকে কাবু করতে পারবে। তবে একটাই ভরসা ছিল আমার-যেহেতু হিজবুল্লাহর ঈমানি শক্তি প্রবল এবং তারা প্রকাশ্য দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়ছে, নিশ্চয়ই আল্লাহর বিশেষ রহমত আসবে। সাধারণ কোনো সামরিক-বেসামরিক হিসাব-নিকাশেই ইসরাইলের এমন আত্মসমর্পণ মেলানো যায় না। আমি নিজেও মেলাতে পারিনি। কারণ ইউরোপ ও আমেরিকার কাছ থেকে সব ধরণের সামরিক-বেসামরিক সহযোগিতা পাচ্ছিল ইসরাইলি বাহিনী।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে সাফল্যের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগের কারণে হিজবুল্লাহর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। ভোটেও এর প্রভাব পড়ছে। সংসদেও শক্তিশালী অবস্থান গড়েে উঠেছে হিজবুল্লাহর। তবে তারা অতি প্রয়োজন ছাড়া সব সময় মন্ত্রিসভার বাইরে থাকার চেষ্টা করেছে। এছাড়া অনেকটা অপ্রকাশ্যে থেকে বিশাল সামরিক বাহিনী ও সংগঠন পরিচালনা করে বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছেন এর মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ। ব্যক্তি হিসেবে গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছেন তিনি।
ইসরাইল ২০০৬ সালের পরাজয়ের পর সরাসরি আর যুদ্ধে না জড়িয়ে সামরিক-বেসামরিক নানা উপায়ে লেবাননের ক্ষতি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে সম্প্রতি বৈরুত বিস্ফোরণে ইসরাইলের হাত থাকার আশঙ্কা অনেকের মনেই উকি দিয়েছে। আমারও এমন আশঙ্কা হয়। বৈরুত বিস্ফোরণের আগের ও পরের কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এই আশঙ্কা সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
২০ জুলাই সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর যোদ্ধা আলী কামেল মোহসেন নিহত হন। এরপর হিজবুল্লাহ ঘোষণা করে তারা এর প্রতিশোধ নেবে। এতে ইসরাইলে অস্থিরতা দেখা দেয়। অস্থিরতা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে, ইসরাইলি সেনাদের মধ্যে ভুলক্রমে গুলি ছোড়ার মতো ঘটনাও ঘটে। ভুলে নিজেদের ড্রোনও ভূপাতিত করে তারা। ভীত-সন্ত্রস্ত ইসরাইল হিজবুল্লাহর কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলে- 'আমরা আপনাদের যোদ্ধাকে মারতে চায় নি। ঘটনাস্থলে আপনাদের যোদ্ধার উপস্থিতি সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য ছিল না।'
হিজবুল্লাহর পাল্টা আঘাতের খবরের অপেক্ষায় যখন গোটা বিশ্ব ঠিক তখনি বৈরুত বন্দরে ঘটে যায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণের উত্তাপে ভেঙে পড়েছে লেবাননের বৈধ সরকার। এই সরকারের প্রতি হিজবুল্লাহর সমর্থন ছিল। এই ডামাডোলের মধ্যে দখলদার ইসরাইল ও আরব আমিরাত পরিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তি সইয়ের ঘোষণা দিয়েছে।
বৈরুত বিস্ফোরণের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রনের উসকানিমূলক বক্তব্যেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। ট্রাম্পতো প্রথমে বলেই ফেলেছিলেন- এটা বোমা হামলা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় ট্রাম্পও এক ধরণের অস্থিরতার মধ্যে রয়েছেন। তার এই অস্থিরতা ৩ নভেম্বরের আগে আরও অনেক অঘটনের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
বিস্ফোরণের আগে ও পরের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, এগুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে! যাইহোক বৈরুত বিস্ফোরণের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে ইসরাইলের কোনো সম্পৃক্ততা বেরিয়ে এলে সমপরিমাণ আঘাতের হুমকি দিয়ে রেখেছেন হিজবুল্লাহ মহাসচিব নাসরুল্লাহ। এর আগে তিনি ইঙ্গিতে হাইফা বন্দরকে টার্গেট করার কথা বলেছেন। নাসরুল্লাহ বলেছেন, 'আমরা দখলদার ইসরাইলের হাইফা বন্দরকে বৈরুত বন্দরের চেয়েও বেশি চিনি।' হাইফা হচ্ছে ইসরাইলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর এবং সেখানে রয়েছে বিস্ফোরক বা দাহ্য পদার্থের ব্যাপক মজুদ।
তবে বৈরুতের ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড নিছক একটি দুর্ঘটনাও হতে পারে। এমন বড় দুর্ঘটনা বিরল কিছু নয়। ভিক্টর হুগোর হাঞ্চব্যাক অব নটরডেম উপন্যাসের সেই নটরডেম গির্জাও গত বছর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে দুর্ঘটনায়। ফ্রান্সের উন্নত প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম আগুন থেকে তাদের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে রক্ষা করতে পারেনি।
নটরডেম গির্জা ফ্রান্সের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্যারিসকে বুঝাতে আইফেল টাওয়ারের সঙ্গেই উচ্চারিত হয় নটরডেম গির্জার নাম। অবশ্য সেই ফ্রান্সেরই প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রন বৈরুত বিস্ফোরণের পর তড়িঘড়ি করে বিস্ফোরণস্থলে এসে লেবাননি নেতাদের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সংস্কার না হলে লেবানন ডুবতেই থাকবে। এই বিস্ফোরণ থেকে নতুন যুগের সূচনা হওয়া উচিত।’ তিনি যখন বৈরুতে দাঁড়িয়ে এসব উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখনও লেবাননের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটামুটি সরকারের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। বিস্ফোরণ পরবর্তী সংকটে লেবাননের মন্ত্রীদের একের পর এক পদত্যাগের পেছনে ফরাসি প্রেসিডেন্টের উসকানি কতটা ভূমিকা রেখেছে তাও খতিয়ে দেখা দরকার।#
লেখক: রেডিও তেহরানের সিনিয়র সাংবাদিক।