অক্টোবর ১৭, ২০২০ ২১:২৬ Asia/Dhaka
  • প্রেম-ভালোবাসা, মাওলানা রুমী ও আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি

ড. সোহেল আহম্মেদ: ইউরোপ ও আমেরিকায় আধ্যাত্মিকতার আলো একেবারেই নিভু নিভু। যারা এই আলো পুরোপুরি নিভে যেতে দেননি তাদেরই একজন হলেন মুসলিম কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রুমী সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি হিসেবে পরিচিত। সেখানে তার কবিতার বই-ই বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। মাওলানা রুমীকে নিয়ে চর্চা হয় ইউরোপেও।

আর মুসলিম বিশ্বে তাঁর কদর সব সময় ছিল, এখনও আছে। এই মহাকবির শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ফার্সি ভাষায় লেখা মসনবী। মাওলানা রুমীর কবিতা পড়লে স্পষ্টই বুঝা যায় তার চিন্তা-চেতনা জুড়ে ছিল সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কুরআনের গভীর প্রভাব। বস্তুবাদী পাশ্চাত্য-সমাজে পরোক্ষভাবে কুরআন তথা আধ্যাত্মিকতার বার্তাই পৌঁছে দিচ্ছে রুমীর সাহিত্য।

মাওলানা রুমীর লেখায় বারবারই এসেছে প্রেমের কথা। অবশ্য ইদানীং প্রেম-ভালোবাসা শব্দ দু’টি ব্যবহার করতে ভয় হয়। কারণ এ দু’টি শব্দ শুনলেই সাধারণ মানুষের মনে আবেগপ্রবণ তরুণ-তরুণীর বিয়েপূর্ব এক অবৈধ সম্পর্কের দৃশ্য ভেসে ওঠে। রুমী এমন প্রেমে উৎসাহ দেননি। যেমনটি ইসলাম ধর্মেও তা বৈধ নয়। তাহলে মাওলানা রুমী কি শুধুই আল্লাহর প্রতি প্রেম ও ভালোবাসার কথা বলেছেন? মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম-ভালোবাসার কি কোনো মূল্য নেই?

মানুষের প্রতি প্রেম-ভালোবাসার গুরুত্ব অস্বীকার করেননি রুমী বরং তিনি পার্থিব জগতের প্রেম-ভালোবাসাকে ঐশী প্রেমের সোপান বা সিঁড়ি হিসেবে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, প্রেমিকের যাত্রা শুরু হয় মানুষকে ভালোবেসেই। মানুষকে ভালোবেসেই এক সময় সে হয়ে ওঠে খাঁটি প্রেমিক। মানুষের প্রতি প্রেম-ভালোবাসাই তাকে আল্লাহর প্রতি প্রেমাতুর করে তোলে। আপনি নিজের স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করছেন, এর অর্থ হলো আপনি আল্লাহর সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসার বন্ধন তৈরির অনুশীলন করছেন। মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি তথা মানুষের প্রতি প্রেম-ভালোবাসাকে তিনি দেখেছেন আল্লাহর প্রতি প্রেম-ভালোবাসার অনুশীলন হিসেবে। রুমী লিখেছেন-

গযি বে দাস্তে পুরে খোদ শামশিরে চুবিন মি দেহাদ/ ত দার অন উস্তা শাবাদ শামশির গিরাদ দার গাযা'

এশ্‌কি কে বার এনসন বুবাদ শামশিরে চুবিন অন বুবাদ/ অন এশ্‌ক ব রাহমন শাবাদ চুন অখার অয়াইদ এবতেলা'

এসব পঙক্তির সার কথা হলো, একজন সফল যোদ্ধা তার সন্তানের হাতে প্রথমেই ধাতব তলোয়ার তুলে দেন না, সন্তানকে প্রথমে দেন কাঠের তলোয়ার। তা দিয়ে অনুশীলন করতে করতে যখন সে দক্ষ হয়ে ওঠে তখন তার হাতে তুলে দেওয়া হয় ধাতব তলোয়ার। পৃথিবীতে মানুষের প্রতি যে প্রেম-ভালোবাসা তা এই কাঠের তলোয়ারের মতো, এটা কেবলি খোদাপ্রেমের অনুশীলন মাত্র। একই ভাবে মাওলানা রুমী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, প্রকৃত আল্লাহ-প্রেমিককেও প্রেমের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। 

সৃষ্টির প্রতি প্রকৃত প্রেম-ভালোবাসার চর্চা মানুষকে তার স্রষ্টার প্রতি ক্রমেই প্রেমপাগল করে তোলে। সৃষ্টিই হয়ে ওঠে স্রষ্টাকে পাওয়ার মাধ্যম। তাই মানুষের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে হবে ঐশী প্রেম। ঐশী প্রেমের সামনে সব কিছু ম্লান। ঐশী প্রেম সব কঠিনকে সহজ করে তোলে, খুলে যায় মুক্তির দুয়ার। এ প্রসঙ্গে রুমীর কবিতায় ইউসুফ-জুলেখার ঘটনা এসেছে। হজরত ইউসুফ (আ.)-কে নিজ ঘরে ডেকে নিয়ে সব দরজা বন্ধ করে অবৈধ প্রেমের প্রস্তাব দেন জুলেখা। ইউসুফ নবী অবৈধ প্রেম প্রত্যাখ্যান করে ছুটতে থাকেন ঐশী প্রেমের টানে। পাপ তাকে স্পর্শ করার আগেই ঐশী প্রেমের টানে খুলে যায় বন্ধ দরজা। আরও এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ইউসুফ (আ.)।

রুমীর কবিতায় সস্তা ও পোশাকি প্রেমের বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। এক রাজা ও এক যুবতী দাসীর গল্প রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে রুমীর এক কবিতায় যেখানে এ বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট। রাজার যুবতী ও সুন্দরী দাসী দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ। রাজ দরবারের চিকিৎসকদের কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছে না, ক্রীতদাসী ক্রমেই আরও বেশি অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়ছেন। অলৌকিকভাবে নতুন এক চিকিৎসক হাজির। নানা প্রসঙ্গে কথা বলার সময় যুবতীর হৃৎস্পন্দন মেপে চিকিৎসক বুঝতে পারলেন সুন্দরী ক্রীতদাসী মনের অসুখে ভুগছেন। সামারকান্দের (বর্তমানে উজবেকিস্তানের একটি প্রদেশ) এক স্বর্ণকার যুবকের প্রেমে পড়েছেন তিনি। সেই প্রেম-রোগ তাকে ধুকে ধুকে শেষ করে দিচ্ছে। এটা বুঝতে পেরে রাজাকে বুঝিয়ে যুবককে আনার ব্যবস্থা করেন চিকিৎসক। স্বর্ণকার যুবককে জানানো হয়, সেখানে গেলে রাজা তাকে বিপুল অর্থ-সম্পদ দেবেন। এই লোভে স্বর্ণকার যুবক নিজের স্ত্রী-সন্তান ফেলে রাজার প্রাসাদে চলে আসেন। সেখানে যুবকের সঙ্গে যুবতী ক্রীতদাসীর বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় যুবতী সুস্থ হয়ে ওঠে। এবার চিকিৎসক ওই যুবককে বিশেষ এক শরবত খাওয়ান যাতে যুবকের সৌন্দর্য ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়। শরবত খাওয়ার পর থেকেই যুবকের সৌন্দর্য নষ্ট হতে থাকে। এতে তার প্রতি যুবতীর প্রেম-ভালোবাসাও ফুরিয়ে যেতে থাকে। স্বর্ণকার যুবকের সঙ্গে ওই ক্রীতদাসী যুবতীর প্রেমের প্রতি ইঙ্গিত করে রুমী লিখেছেন,

এশ্কহয়ি কায পেইয়ে রাঙ্গি বুবাদ/ এশ্‌ক নাববাদ অকেবাত নাঙ্গি বুবাদ

এখানে বলা হচ্ছে বাহ্যিক চেহারা বা রঙ ও চাকচিক্যের মোহে যে প্রেম হয় তা আসলে কোনো প্রেম নয়, এমন প্রেমের পরিণতি ও প্রাপ্তি কেবলি অপমান ও যাতনা।

বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এখন পোশাকি বা সস্তা প্রেমের ছড়াছড়ি। অনেকে ধর্ষণসহ নানা অপরাধের জন্য সমাজে প্রচলিত এই প্রেমকেও দায়ী বলে মনে করেন। রুমীর প্রেমতত্ত্বে এমন অবৈধ সম্পর্ক পরিত্যাজ্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে আল্লাহ প্রেম জাগিয়ে তোলা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি। #

লেখক: রেডিও তেহরানের সিনিয়র সাংবাদিক।

[email protected]

ট্যাগ