ইরানের বিরুদ্ধে আজারবাইজানের ভূমি ব্যবহার করছে ইসরাইল
আজারবাইজানকে ইরান সমর্থন দিয়ে এলেও যে কারণে সম্পর্কের এতো অবনতি
সম্প্রতি কারাবাখ নিয়ে দ্বিতীয় যুদ্ধে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজান বিজয় লাভের পর তেহরান ও বাকুর মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছিল। কিন্তু ইহুদিবাদী ইসরাইলের উস্কানির কারণে হঠাৎই তেহরান-বাকু সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি হয় এবং শেষ পর্যন্ত শত্রুতায় গিয়ে গড়ায়। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অবনতির কারণ ও আজারবাইজানের ব্যাপারে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি নিয় কথা বলব। আশা করি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাব।
প্রকৃতপক্ষে, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট এলহাম আলিয়েভ গত ২৭ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় কারাবাখ যুদ্ধের প্রথম বিজয় বার্ষিকীতে দেয়া ভাষণে ইরানকে তার দেশের সরকার ও জনগণের প্রধান শত্রু হিসেবে অভিহিত করেন। এরপরই তেহরানও প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং দুদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ভ্রাতৃপ্রতিম এ দুই মুসলিম দেশের সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ। আজারবাইজানের প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন বিশেষ করে কারাবাখ নিয়ে দ্বিতীয় যুদ্ধে ওই দেশটির বিজয়ের পেছনে ইরানের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু ইরানের সঙ্গে আজারবাইজানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ইসরাইলকে সুযোগ করে দেয়ায় ইসরাইল সেই সুযোগের অপব্যবহার করেছে। ইসরাইল এমনভাবে প্রভাব খাটিয়েছে যাতে প্রতিবেশী ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে গভীর শত্রুতা তৈরি হয়। অথচ মাত্র এক মাস আগেও তেহরান ও বাকু দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার ও সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিরাজমান সীমাবদ্ধতা অপসারণেও পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু হঠাতই আজারবাইজানের কর্মকর্তারা ইরানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন বক্তব্য দেয়া শুরু করেন।
সম্প্রতি আজারবাইজানে বিদেশী নির্ভর কিছু গণমাধ্যম সেদেশে ইসলামপন্থী ও ইরানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করেছে। এমন কি এ ক্ষেত্রে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে গত তিন দশকে বাকুর সরকার ও দেশটির মুসলিম জনগণের প্রতি ইরানের সমর্থনের বিষয়টিকেও সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। ইরান গত তিন দশক ধরে আজারবাইজানের অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকসহ সব ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সাহায্য সমর্থন দিয়ে এসেছে। কিন্তু তারপরও ওই দেশটির স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইলি কূটনীতিকদের ইন্ধনে আজারবাইজানের কোনো কোনো গণমাধ্যম ইরানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে ভ্রাতৃপ্রতিম এ দুই মুসলিম দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও শত্রুতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট এলহাম আলিয়েভ গত ছয় মাস আগেও ইরান সীমান্ত পরিদর্শন করে এই প্রথমবার এ দুই দেশের সীমান্তকে বন্ধুত্বের সীমান্ত বলে অভিহিত করেছিলেন। এ ছাড়া কয়েক মাস আগেও তিনি ইরানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতে দুদেশের সীমান্তকে বন্ধুত্বের সীমান্ত বলে অভিহিত করেছিলেন।
সম্প্রতি কারাবাখ এলাকার মালিকানা নিয়ে চলা দ্বিতীয় যুদ্ধে আজারবাইজান আর্মেনিয়ার দখলে থাকা কারাবাখ এলাকা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট উদ্ধারকৃত এলাকা পরিদর্শন করে যুদ্ধের পরপরই দুদেশের যৌথ সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারে পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ইরানের সঙ্গেও আমাদের সীমান্ত হচ্ছে বন্ধুত্বের সীমান্ত।
বাকুতে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভি ইরান সীমান্ত সংলগ্ন কারাবাখ এলাকা উদ্ধারের বিষয়ে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'ইরান ও আজারবাইজানের সীমান্ত সবসময়ই বন্ধুত্বের সীমানা হিসেবে পরিচিত ছিল এবং এখানে শান্তি ও নিরাপত্তা সবসময়ই বজায় থাকবে।' এক টুইটবার্তায় প্রেসিডেন্ট এলহাম আলিয়েভকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরো বলেছেন, বিদেশিদের হস্তক্ষেপ ও তাদের উপস্থিতি ছাড়াই প্রতিবেশী এ দুই দেশের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকবে।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট চলতি বছর এপ্রিলে ইরানের ব্যাপারে গঠনমূলক ও ইতিবাচক বক্তব্য দিলেও গতমাসে হঠাৎ তিনি ইরানের বিরুদ্ধে বিষদগার শুরু করেন। বলা যায়, দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি সেদেশের গণমাধ্যমে ইরানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেন এবং এ দেশটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন। এভাবে তিনি ইসরাইলকে বিরাট সুযোগ করে দিলেন। সম্প্রতি বিদেশীদের মাধ্যমে প্রভাবিত আজারবাইজানের গণমাধ্যমগুলো ওই দেশটির মুসলিম জনগণের কাছে ইরান সম্পর্কে খারাপ ধারনা তৈরির জন্য ইরানের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার শুরু করেছে। এসব গণমাধ্যম ইরানের বিরুদ্ধে নানা কৌশলে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেও ওই দেশটির চিন্তাশীল মহল বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি এবং তারা এলহাম আলিয়েভ সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছে। আজারবাইজানের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও জমিয়তে দ্বীনি সংগঠনের নেতা ইলকার ইব্রাহিম ওগলু বলেছেন, আজারবাইজান সরকারের উচিত হবে না অযথা কোনো দেশের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া।
প্রকৃতপক্ষে, আজারবাইজানের সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ও রাজনৈতিক মহল মনে করেন, আলিয়েভ সরকার ইরানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন এবং ইরান বিরোধী অপপ্রচার চালানোর জন্য দখলদার ইসরাইলকে সেদেশের মাটি ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছে। তবে প্রেসিডেন্ট আলিয়েভসহ দেশটির অন্যান্য কর্মকর্তারা এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও বাস্তবতা হচ্ছে বেশ কিছু ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে সেদেশে ইসরাইলের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে এবং তারা ইরান বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এ থেকে বোঝা যায় ইরানসহ অন্যান্য মুসলিম দেশের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরাইল সব দিক থেকে পরাজিত হয়ে এখন ইরানকে আঘাত হানার জন্য সর্বশেষ ঘাঁটি হিসেবে আজারবাইজানের ভূমি ব্যবহার করছে।
তবে ইসরাইলের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে আজারবাইজান সরকার ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও ইরান কখনোই ওই মুসলিম দেশকে শত্রু মনে করেনি। বিভিন্ন সময়ে আজারবাইজানের সরকার ও জনগণের জন্য ইরানের সাহায্য সহযোগিতা ভুলে যাবার মতো নয়। বলা যায়, ওই দেশটির সরকার ও উত্তরাঞ্চলীয় আরাস এলাকার জনগণের জন্য ইরানের সাহায্য এতোটাই চোখে পড়ার মতো ছিল যে ওই দেশটির কর্মকর্তারাও তা স্বীকার কোরে ইরানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। এমনকি গত বছর অক্টোবর মাসে আজারবাইজানের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেনারেল মহররম আলিয়েভ সেদেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ইরানের সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপক প্রশংসা করেছিলেন। তিনি 'সিয়াজ' বার্তা সংস্থাকে দেয়া সাক্ষাতকারে ইরানকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করে বলেছিলেন, আজারবাইজানের 'নাখজাবন' এলাকা যখন শত্রু দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল তখন ইরান ব্যাপক সাহায্য করেছিল ও আজারবাইজানের ওই দুঃসময়ে তেহরানের ভূমিকাকে বাকু কখনোই ভুলে যাবে না।
তার ওই বক্তব্যের মাত্র একদিন আগে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট এলহাম আলিয়েভ সিএনএনকে দেয়া সাক্ষাতকারে সম্প্রতি কারাবাখ নিয়ে দ্বিতীয় যুদ্ধে ইরানের অবস্থান ছিল খুবই ন্যায়সঙ্গত।
কিন্তু এতো ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশের পরও ইসরাইলি প্রভাবের কারণে ইরানের ব্যাপারে আজারবাইজানের কর্মকর্তাদের নীতি অবস্থানে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে তাদের এ অবস্থান নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর। কেননা ইসরাইলের মতো দখলদার শক্তির ওপর ভর কোনো দেশে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।