ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আদর্শে মুক্তিকামিতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রবণতা
ইসলামী বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে ‘আলোকোজ্জ্বল দশ প্রভাত শীর্ষক’ বিশেষ ধারাবাহিক আলোচনার আজকের পর্বে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আদর্শে মুক্তিকামিতা ও খোদামুখিতা তথা আধ্যাত্মিকতার প্রবণতা সম্পর্কে আলোচনা হল:
স্বাধীনতা ও মুক্তিকামিতা ইরানি জাতির সংগ্রামগুলোর ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিজাতীয় হস্তক্ষেপ ও দেশীয় স্বৈরাচার- এ দুইয়ের কোনোটিই কখনও তাদের ধাতে সয়নি।
ইরানের বিপ্লবী জনগণ মার্কিন সরকারের দয়ার ওপর নির্ভরশীল শাহের স্বৈরশাসন এবং জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল জনগণের পছন্দসই শাসন-ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে। আর তাদের এই চেতনার উৎস ছিল খোদামুখিতা ও আধ্যাত্মিকতা। এ দুই উৎস থেকেই ইরানিদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হত স্বাধীনতাবোধ ও মুক্তিকামিতা। ফলে তারা বিজাতীয়দের হাতের পুতুল কোনো সরকারের কর্তৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তাই আড়াই হাজার বছরের পুরনো রাজতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থা ধ্বসে পড়ে ইসলামী বিপ্লবের এ দুই মূল্যবোধের অপরাজেয় শক্তির কাছে। এভাবে ইরানের ইতিহাসে ইসলামী চেতনাই প্রথমবারের মত এনে দিয়েছে রাজতান্ত্রিক শোষণ ও বিজাতীয়-নির্ভরতার অক্টোপাশের বন্ধন থেকে জনগণের প্রকৃত মুক্তি ও স্বাধীনতা।
কোনো বিপ্লব ও আন্দোলনের চালিকা শক্তিগুলোর মূল চেতনা যদি হয় ধর্মীয় মূল্যবোধ-ভিত্তিক তখন সেই আন্দোলন বা বিপ্লব থেকে উদ্ভুত রাষ্ট্রও যে ধর্মীয় রঙ্গে রঙ্গীন হয়ে ওঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর ইসলাম হচ্ছে এমন এক ধর্ম যাতে রয়েছে সবচেয়ে বড় মানবিক মূল্যবোধগুলোর উৎস। তাই কোনো জাতির প্রকৃত পূর্ণতা ও উন্নয়ন ইসলামী আদর্শের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া ছাড়া সম্ভব নয়।

ইসলামী আদর্শ ও ইরানের ইসলামী বিপ্লব মনে করে স্বাধীনতা ও মুক্তিকামিতা হচ্ছে মহান আল্লাহর দেয়া এক বড় অনুগ্রহ যা মানুষের পূর্ণতা আর উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। অন্যান্য বস্তুবাদী মতাদর্শের বিপরীতে ইসলাম মনে করে স্বাধীনতা ও মুক্তি আধ্যাত্মিক মুক্তি ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। আধ্যাত্মিক বা আত্মিক মুক্তি মানুষকে লোভ-লালসা, ক্রোধ ও হিংসা-বিদ্বেষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা ও মুক্তি কেবলই সামাজিক জীবনের গন্ডিতে সীমিত নয়। স্বাধীনতা ও মুক্তি একইসঙ্গে পারলৌকিক সৌভাগ্যের জন্যেও অপরিহার্য। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা ও মুক্তি নিজের এবং সমাজের অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু দায়িত্ব পালনের ওপর নির্ভরশীল। স্বাধীনতার মানে যা-খুশি তা করার অবাধ অনুমোদন বা লাইসেন্স নয়।
একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও মুক্তির অর্থ হল দেশটিকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতি ও ভৌগলিক দিক থেকে পুরোপুরি স্বাধীন এবং সার্বভৌম শক্তির অধিকারী হতে হবে। কোনো দেশের ভৌগলিক অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা যখন বিপন্ন হয় তখন দেশটিতে বিজাতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। আর এই বিজাতীয় কর্তৃত্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রেই হতে পারে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হয়ে পড়েন বিজাতীয় শক্তির ক্রীড়নক। আর এ অবস্থায় জাতির সব ধরনের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়।
কোনো সরকারের যখন জনসমর্থন থাকে না তখন সেই সরকারের ওপর বিজাতীয় শক্তিগুলোর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সহজ হয়ে পড়ে। আর সরকারগুলো কেবল তখনই জনপ্রিয়তা হারায় যখন তারা জনগণের মুক্তি, আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
অনেক সময় স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলো নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে জনগণের স্বাধীনতাকে সীমিত করে। আবার কখনও কখনও নানা দল বা গোষ্ঠী স্বাধীনতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে বিপদাপন্ন করে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এ দু’টি ত্রুটি থেকে মুক্ত।
ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার যদি কোনও সংকটাপন্ন অবস্থায় বা জাতীয় দুর্যোগের সময় জনগণের চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে চায় তাহলে সরকারকে জনগণের প্রতিনিধি তথা সংসদ থেকে অনুমতি নিতে হবে।
ইরানের ইসলামী রাষ্ট্রে যুদ্ধের মত জাতীয় সংকটের সময়ও কখনও কোনো নির্বাচন বন্ধ থাকেনি। কারণ জনগণের ভোটের অধিকার বা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার কেড়ে নেয়ার কোনো ক্ষমতা সরকারের নেই।

ইসলামী ইরানের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিক ও দলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কোনো বিশেষ মতামতের কারণে কারো ওপর কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপকে ইসলামী ইরানের সংবিধানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইরানের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো এ বিধানের আলোকেই পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং অবাধে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করছে।
ইরানের সংসদ মজলিশে শুরায়ে ইসলামীতে রয়েছে ইহুদি, খ্রিস্টান ও জরাথ্রুস্ট ধর্মের প্রতিনিধি। ইরানের সংবিধানে একত্ববাদী ধর্মগুলোকে খোদায়ী ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যদিও রাষ্ট্রধর্ম হল ইসলাম এবং রাষ্ট্রীয় মাজহাব হল ১২ ইমামি শিয়া মুসলিম মাজহাব।
ইসলামী ইরানের সব মুসলিম মাজহাব ও ধর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে সম্প্রীতির সম্পর্ক। ইরানের ইসলামী বিপ্লবে ও প্রতিরক্ষার যুদ্ধে সব ধর্ম এবং মাজহাবের অনুসারীদের অংশগ্রহণই এর বড় প্রমাণ। ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাগত কারণে ইরানের নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে কোনো তারতম্যও নেই। ইসলামী ইরানের সংবিধানে ইরানি জাতি ও ধর্মগুলোর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
ইরানের পত্র-পত্রিকাগুলোয় সরকারের নানা তৎপরতার সমালোচনামূলক প্রবন্ধ এবং এমনকি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক লেখাও ছাপা হয়। ইরানি টেলিভিশন ও রেডিওতে সরকারের নানা দুর্বলতাকে ব্যঙ্গ করে পরিহাসমূলক নাটকও প্রচার করা হয়। আর এ থেকেই বোঝা যায় ইসলাম এবং ইসলামী বিপ্লব বাক-স্বাধীনতার বিরোধী নয়।#
পার্সটুডে/মু. আ. হুসাইন/আশরাফুর রহমান/৯