নভেম্বর ২২, ২০২১ ১৮:০২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যে শয়তান পূজার প্রবণতা এবং এর কারণ নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি।

আজকের বিষয় পাশ্চাত্যে বর্ণবাদ। অনেকেই ভাবতে পারেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বর্তমান যুগে বর্ণবাদী চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির দাপট কমে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে ইউরোপের কোনো কোনো দেশে বর্ণবাদে বিশ্বাসী ডানপন্থীদের প্রভাব বেড়েছে এবং কোনো কোনো দেশে তারা ক্ষমতায়ও এসেছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বর্ণবাদী ব্যক্তিত্বদের প্রভাব ও দাপট বৃদ্ধি থেকেও এটা স্পষ্ট যে,পাশ্চাত্যে বর্ণবাদীদের তৎপরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সমমনারা প্রকাশ্যেই বর্ণবাদ ও শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের কথা বলে থাকেন। এ কারণে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বর্ণবাদী তৎপরতা অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া পাশ্চাত্যের অন্য দেশগুলোতেও বর্ণবাদীরা নানা অজুহাতে সহিংস তৎপরতা বাড়িয়ে চলেছে। পাশ্চাত্যে বিদেশি বিদ্বেষ ও চরম জাতীয়তাবাদের উত্থান এখন এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা।

ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রান্টয ফ্যানন মনে করেন, উপনিবেশবাদীরা নিজেদেরকে অন্যান্য জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে এবং এই অহংবোধই তাদেরকে বর্ণবাদী করে তোলে। ফ্যানন তার 'বর্ণবাদ ও সংস্কৃতি' শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, উপনিবেশবাদীরা সব সময় মনে করে তারা উন্নত সভ্যতার অধিকারী কারণ তারা জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠ। আসলে পিছিয়ে থাকা জাতির অবমাননা করা এবং মানবীয় মর্যাদাকে অস্বীকার করার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বর্তমানে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর নীতি নির্ধারকেরা মুখে মানুষের মধ্যে সমতা এবং বৈষম্যহীনতার কথা বলে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু পাশ্চাত্যের বর্তমান ও অতীত অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,তারা সব সময় বর্ণবাদকে লালন করেছে। প্রাচীন গ্রিকরা সব সময় অ-গ্রীক মানুষকে ঘৃণ্য ও নীচ বলে মনে করত। তাদের মনে করত, অ-গ্রীকরা স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারই রাখে না। পরবর্তীতে দেখা যায়,দাস ব্যবসায়ীরা আমেরিকাকে সব সুযোগের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য  আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের জোর করে ধরে জাহাজ ভরে আমেরিকায় নিয়ে এসেছে এবং তাদেরকে  দাস হিসেবে জীবনযাপনে বাধ্য করেছে।

বর্তমানেও আধুনিক পুঁজিপতি ও দাম্ভিক শক্তি আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে আধুনিক দাস বানানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশ্চাত্যে বর্ণবাদ সব সময় ছিল,এখনও আছে। তবে গত কয়েক দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুনকরে বর্ণবাদের উত্থান ঘটছে। এই উত্থান উত্তর ইউরোপীয় দেশ নরওয়ে থেকে শুরু করে দক্ষিণ ইউরোপের গ্রিসেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনকি স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে দাবিদার ফ্রান্সেও বর্ণবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণ কমিটি বা সিইআরডি'র সদস্যরা ফ্রান্সে বর্ণবাদী তৎপরতা বৃদ্ধিকে বিপজ্জনক হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন,ফ্রান্সে বর্ণবাদী তৎপরতা সংক্রান্ত প্রতিবেদন পড়ে তারা সবাই বিস্মিত হয়েছেন। এই কমিটি ফ্রান্সে বর্ণবাদের ক্রমবর্ধমান বিস্তার এবং এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশটির সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছে।

বর্ণবাদ বলতে সাধারণত একজন ব্যক্তির প্রতি জাতিগত কারণে বিদ্বেষ, বৈষম্য ও ঘৃণাকে বোঝায়, শুধু গায়ের রঙের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয়তা, ভাষা এবং ধর্ম ও মাজহাবের মতো বিষয়গুলোও  বর্ণবাদী তৎপরতার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন ফ্রান্সে ৫০ লাখের বেশি মুসলমান থাকা সত্ত্বেও সেখানে মুসলমানরা সবসময় ফরাসি বর্ণবাদীদের মাধ্যমে নির্যাতিত। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ফ্রান্সের জনমত জরিপ সংস্থা আইফোপ পরিচালিত এক জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ফ্রান্সের ৪২ শতাংশ মুসলমান ইসলাম ধর্ম অনুসরণের কারণে জীবনে অন্তত একবার বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এছাড়া, ফ্রান্সের ৪০ শতাংশ মুসলমান এবং ১৭ শতাংশ অমুসলিম পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত একবার বৈষম্যমূলক ও বর্ণবাদী আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন। এই জরিপের ফলাফলে আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারী-পুরুষ এবং পর্দানশীন মহিলারাই সবচেয়ে বেশি বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন। যদিও ইসলাম ধর্ম হচ্ছে ফ্রান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম।

ইউরোপের অনেক দেশেই হিজাব এবং মাথায় স্কার্ফ পরা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে মুসলমানদের স্বাধীনভাবে পোশাক পরার অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ফিনল্যান্ডের মুসলিম গবেষক লিন্ডা হিয়াক্কি বলেছেন, এই বিষয়টি পাশ্চাত্য সমাজের দ্বিমুখী নীতি থেকে উৎসারিত বলেই মনে হয়। কারণ একদিকে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ব্যক্তি কেন্দ্রিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে সব সময় প্রচার চালানো হচ্ছে। তারা বলছে ব্যক্তি স্বাধীনতাই সব। কিন্তু অন্যদিকে তারা সমাজে কয়েকজন পর্দানশীন নারীর উপস্থিতিও সহ্য করতে পারছে না। বলা হচ্ছে একজন ব্যক্তি কীভাবে পোশাক পরবে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু যখনি ইসলাম ধর্মের পোশাকের কথা আসছে তখনি তারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, সেটা নিয়ে সমস্যা পাকাচ্ছে। আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি, ইসলাম ধর্মে বহুবিবাহের বিষয় রয়েছে। ইসলাম ধর্মে বহুবিবাহের বিষয়টিকে তারা সহজভাবে নেয় না। কিন্তু তারা প্রেমের আধুনিক ধারণার কথা ঠিকই প্রচার করছে। কয়েকজনের সঙ্গে প্রেমের বিষয়টিকে তারা ভালো মনে করছে, সহজভাবে নিচ্ছে। কিন্তু যখনি ধর্মের প্রসঙ্গ আসছে তখনি তা তাদের কাছে অসহনীয় বলে মনে হচ্ছে। আসলে ইউরোপের সমস্যা ধর্মের সঙ্গে।

ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্যে বর্ণবাদের উত্থান এখন একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট ২০১৬ সালে এক প্রতিবেদনে তিন হাজারের বেশি ব্রিটিশ পুলিশের সহিংস ও বর্ণবাদী আচরণের তথ্য ফাঁস করেছে। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্ণবাদী ও সহিংস আচরণের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এসব পুলিশ দায়িত্বে বহাল রয়েছে। অবশ্য তাদের অপরাধের বিষয়ে তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। এসব অপরাধের মধ্যে যৌন সহিংসতাও রয়েছে।  এরপরও এসব পুলিশের মধ্যে মাত্র দুই শতাংশকে দায়িত্ব থেকে আপাতত সরিয়ে রাখা হয়েছে, অন্য ৯৮ শতাংশকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে যা ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক। এই পত্রিকার  গবেষণা বিভাগ তাদের গবেষণার ভিত্তিতে জানিয়েছে,সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং বর্ণবাদ, ব্রিটিশ পুলিশ বিভাগের সাধারণ আচরণ ও সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। এশীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকরাই শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের তুলনায় পুলিশের মাধ্যমে বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অভিযোগকারীদের তালিকা থেকেও এটা স্পষ্ট।

দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট আরও জানিয়েছে,ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বর্ণবাদী ঘটনা ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বর্ণবাদী আচরণ মোকাবেলায় ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন মনোভাবের কারণে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হওয়ার পরও অনেকেই তা কর্তৃপক্ষকে জানায় না, কারণ তারা মনে করে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না।  ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব ব্রিটিশ স্টুডেন্টস এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্ণবাদী আচরণ প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সেখানে দুই বছরে এ ধরণের আচরণ দ্বিগুণ বেড়েছে। এই সংস্থাটি বর্ণবাদী আচরণ বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, তারা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এ ধরণের আচরণের শিকার হওয়ার বিষয়ে তথ্য চেয়েছিল। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যে একশ'র বেশি শিক্ষার্থী ধর্মীয় কারণে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হওয়ার তথ্য দিয়েছেন। তবে এ সময় তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ