নভেম্বর ২৮, ২০২১ ২০:১২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বর্ণবাদ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, বর্ণবাদ বলতে সাধারণত একজন ব্যক্তির প্রতি জাতিগত কারণে বিদ্বেষ, বৈষম্য ও ঘৃণাকে বোঝায়, শুধু গায়ের রঙের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নয়।

এ ক্ষেত্রে জাতীয়তা, ভাষা এবং ধর্ম ও মাজহাবের মতো বিষয়গুলোও বর্ণবাদী তৎপরতার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন ফ্রান্সে ৫০ লাখের বেশি মুসলমান থাকা সত্ত্বেও সেখানে মুসলমানেরা সবসময় ফরাসি বর্ণবাদীদের মাধ্যমে নির্যাতিত। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ফ্রান্সের জনমত জরিপ সংস্থা আইফোপ পরিচালিত এক জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ফ্রান্সের ৪২ শতাংশ মুসলমান ইসলাম ধর্ম অনুসরণের কারণে জীবনে অন্তত একবার বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এছাড়া, ফ্রান্সের ৪০ শতাংশ মুসলমান এবং ১৭ শতাংশ অমুসলিম পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত একবার বৈষম্যমূলক ও বর্ণবাদী আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন। আজকের আসরে আমরা আমেরিকায় বিদ্যমান বর্ণবাদ নিয়ে আলোচনা করব। আশাকরি শেষ পর্যন্ত সঙ্গেই আছেন।                                                                         

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা বিলুপ্তির ১৫০ বছরেরও বেশি সময় পরও সেখানে বর্ণবাদী আচরণ বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে যে মারাত্মক গুলির ঘটনা ঘটছে তা চরমপন্থী জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত সহিংসতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতারই প্রতিফলন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেও সেখানে বর্ণবাদ ছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পেয়ে বর্ণবাদীরা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। উগ্র শেতাঙ্গদের শিরায় যেন নতুন রক্ত প্রবেশ করতে শুরু করে। মার্কিন বংশোদ্ভূত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রেস টিভির উপস্থাপক মারজিয়া হাশেমি ২০১৯ সালে আমেরিকায় যাওয়ার পর গ্রেপ্তার হন এবং ১১ দিন মার্কিন কারাগারে ছিলেন। বার্তাসংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস বা এপি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তখন বলেছিলেন, সাংবাদিকতা এবং ধর্মবিশ্বাসের কারণেই তাকে আটক করা হয়েছিল। মারজিয়া হাশেমির মতে, মার্কিন সরকার হয়রানির মাধ্যমে তাকে এক ধরণের হুমকি দিয়েছে।

মার্কিন বংশোদ্ভূত এই মুসলিম সাংবাদিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের নাম হচ্ছে 'এ ড্রেড স্কট নেশন বা ড্রেড স্কট জাতি'। এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, মার্কিন সমাজে বৈষম্য এবং অসমতা। এই ডকুমেন্টারিতে মার্কিন পুলিশ তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও অবিচারের একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ডকুমেন্টারিটি শুরু হয়েছে মার্কিন হাইকোর্টে ড্রেড স্কট নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ দাসের মুক্তির আবেদনের প্রসঙ্গ দিয়ে। এটি ১৮৫৭ সালের ঘটনা। আদালতের প্রধান বিচারক সে সময় কৃষ্ণাঙ্গ ঐ দাসের আবেদনের জবাবে বলেছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গরা আদালতে মামলা করার অধিকার রাখে না, কারণ তারা নাগরিক বলে বিবেচিত হয় না। শেতাঙ্গ মালিকের মাধ্যমে সম্মানিত হওয়ারও অধিকার কৃষ্ণাঙ্গের নেই। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির নির্মাতা আমেরিকার ফার্গুসান শহরে পুলিশের হাতে ১৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর মাইকেল ব্রাউনসহ অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী নিহতের ঘটনাকে সেদেশের এক তিক্ত বাস্তবতা বলে মনে করেন যা আমেরিকা সৃষ্টির সময় থেকে শুরু হয়ে এখনও অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন পুলিশ ২০১৪ সালে ফার্গুসান শহরে মাইকেল ব্রাউনকে হত্যা করে। 

'এ ড্রেড স্কট নেশন বা ড্রেড স্কট জাতি' শীর্ষক প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটিতে যে বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে তা হলো আমেরিকায় কেবল গায়ের রঙের কারণে বিশাল সংখ্যক নাগরিক তাদের অধিকার থেকে এখনও বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রতি বছর বহু কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে বড় কোনো কারণ ছাড়াই হত্যা করা হয়। ব্রিটাই গ্রিরুস নামের একজন সমাজকর্মী  'এ ড্রেড স্কট নেশন বা ড্রেড স্কট জাতি' শীর্ষক এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে অংশ নিয়ে বলেছেন, 'যখন রাস্তায় বের হই তখন দুই ধরণের মানুষের ব্যাপারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকি। এর একদল হলো দুর্বৃত্ত, আর অপরটি হলো পুলিশ।'

তিনি আরও বলেছেন, 'দুর্বৃত্ত বা অপরাধীদেরকে আমি নিজে মোকাবেলা করতে পারি, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি। কিন্তু পুলিশের মোকাবেলায় প্রতিরোধের চেষ্টা করলে জীবন দিতে হয়। এখানে, এই সমাজে গভীর ঘৃণা  বিরাজ করছে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এবং তাদেরর জীবনযাপনের প্রতি ব্যাপক ঘৃণা পোষণ করে একদল মানুষ।

মাইকেল ব্রাউনকে হত্যার দৃশ্য দেখে তার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে ব্রিটাই গ্রিরুস বলেন, 'এই দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে আমাকেই হত্যা করা হয়েছে, আমিই যেন রাস্তায় পড়ে আছি সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে। আমি নিজেকে মৃত অবস্থায় অনুভব করেছি।' ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমেরিকায় বর্ণ বৈষম্যে সম্পর্কে নানা বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রতিদিনের মার্কিন পত্রিকাগুলো পড়লেও দেখা যায় সেদেশের কোনো কোনো স্থানে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে হত্যা করা হচ্ছে নিয়মিত। এটা যেন এখন এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মৃত্যুর সংখ্যা খুব বেশি না হলে অথবা কৃষ্ণাঙ্গরা প্রতিবাদমুখর না হলে এসব ঘটনা অন্যান্য খবরের ভিড়ে হারিয়ে যায়। তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা বা হৈ-হুল্লোড় হয় না। যেমনটি আগেও বলেছি আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হত্যার প্রবণতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।  ট্রাম্পের বর্ণবাদী নীতি ও বক্তব্য সমাজের নানা অংশে প্রভাব ফেলেছিল। এ কারণে ট্রাম্প আমেরিকার ইতিহাসে বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন।

অবশ্য মার্কিন সরকার চোখ বন্ধ করে সব সময় একটি দাবিই করে যাচ্ছে আর তা হলো, আমেরিকায় সব ধরণের জাতি ও বর্ণের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে। এ ক্ষেত্রে  কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু নানা পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে, সেখানে প্রতিদিনের অসংখ্য সহিংস ঘটনার মূলে রয়েছে বর্ণবাদ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত যেসব সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ৭৩ শতাংশই বর্ণবাদী শেতাঙ্গদের মাধ্যমে ঘটেছে এবং এসব হামলা হয়েছে অভিবাসী, অশেতাঙ্গ ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমেরিকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বর্ণবাদ এখন ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে যা ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানী ম্যারি রায়ানের মতে, পাশ্চাত্যে বিশেষকরে আমেরিকায় বর্ণবাদী অপরাধ তদন্ত বিষয়ক ব্যবস্থা এরইমধ্যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এছাড়া পাশ্চাত্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং গণমাধ্যমে এ বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বরং উল্টোটাই ঘটছে। নানা উপায়ে সেখানে বর্ণবাদী আচরণের প্রতি সমর্থন দেওয়া হচ্ছে। আর এই প্রবণতাকে সমাজে মারাত্মক বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। 

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই'র পরিসংখ্যানেই বলা হয়েছে, আমেরিকার কারাগারগুলোতে আটক নাগরিকদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ। জনসংখ্যা অনুপাতে বন্দির এই সংখ্যা অবিশ্বাস্য। জনসংখ্যার অনুপাতে শেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ কারাবন্দির সংখ্যা ছয় গুণ। এছাড়া সমাজে নানাভাবে কৃষ্ণাঙ্গরা বঞ্চিত। নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের কথা বলা হলেও সর্বত্রই ন্যূনতম অধিকার আদায়ের জন্যও কৃষ্ণাঙ্গদের অনেক বেশি বেগ পেতে হয়। বিচার বিভাগেও তাদের প্রতি বিদ্বেষী আচরণ করা হয়।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ