সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-২৯)
শিশুদের জগত নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের তথা অজানাকে জানার অশেষ কৌতুলহলে ভরপুর ও গতিশীল। প্রাকৃতিক জগতের সব কিছুই তাদের নতুন চোখে বিস্ময়ের অনন্ত ভাণ্ডার।
পানি, মাটি, গাছপালা –এসব কিছুই তারা বাস্তব জগতে খেলাধুলা করতে গিয়ে বা দৌড়-ঝাঁপ ও ছুটোছুটির মাধ্যমে জানতে পারে। কিন্তু ইন্টারনেট বা ভার্চুয়াল জগতে থেকে মাটি নিয়ে খেলা করার মত নানা বাস্তব আনন্দের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব নয়।
বর্তমান যুগে তথা নতুন প্রজন্মের কাছে খেলাধুলার অর্থই বদলে গেছে। খেলাধুলা বলতেই তারা বোঝে কম্পিউটার, টেলিভিশন প্রোগ্রাম, ইন্টারনেট বা মোবাইলের মত নানা ধরনের ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে খেলাধুলা করা। ফলে তারা প্রকৃতিকে আবিষ্কারের আনন্দ থেকে বঞ্চিত।
স্কুলগুলোতেও মাঠে-ময়দানে গিয়ে খেলাধুলা ও শরীর চর্চা করার কর্মসূচি তেমন একটা থাকে না। সামান্য যে কর্মসূচি থাকে তার বাইরে শিশুদের সবুজ অঙ্গনে নিয়ে আনন্দ দেয়ার কর্মসূচি থাকে না। পার্ক ও খেলার মাঠের সংখ্যাও খুব কমে আসছে। তাই এসব স্থান কৌতূহল মেটানোর স্থান হিসেবে অন্তহীন প্রকৃতিকে আবিষ্কারের নেশা জাগিয়ে তুলছে না শিশুদের মধ্যে অতীতের মত।
রিচার্ড লুই ' জঙ্গলে সর্বশেষ শিশু: আমাদের এ যুগের শিশুদের প্রাকৃতিক পরিবেশের অভাব থেকে মুক্ত করুন' শীর্ষক বইয়ে এক শিশুর সাক্ষাৎকার বর্ণনা করেছেন যেখানে ওই শিশু বলছে, ঘরের পরিসরে যেসব খেলাধুলা রয়েছে সেসবই বাইরের খেলাধুলার চেয়ে তার কাছে বেশি প্রিয়। কারণ, ইলেকট্রনিক সব উপকরণই রয়েছে বাসভবনের ভেতরে।
শিশুদেরকে নতুন নতুন প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখা কঠিন হলেও তাদেরকে প্রকৃতির কোলে নিয়ে খেলাধুলা ও শরীর চর্চায় ব্যস্ত রাখার মধ্যে রয়েছে মেধা বিকাশের মত ব্যাপক কল্যাণ। সৌভাগ্যক্রমে এমন কিছু পন্থাও রয়েছে যার মাধ্যমে শিশুদেরকে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় তাদের পছন্দের কাজের ফাঁকেই। প্রকৃতির আলো বাতাস যেমন সবুজ গাছপালা বেড়ে ওঠার জন্য সহায়ক তেমনি প্রকৃতির কোল মানুষ ও বিশেষ করে শিশুর প্রবৃদ্ধি ও পূর্ণতার জন্যও জরুরি।
ইসলামী বর্ণনায় স্বচ্ছ পানির প্রবাহের দিকে তাকাতে বলা হয়েছে। এ কাজ মানুষের আত্মাকে করে প্রশান্ত ও তা চোখের জন্যও উপকারী।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে জমিনকে প্রশস্ত করা ও সেখানে সুদৃঢ় বড় বড় পাহাড়-পর্বত স্থাপন এবং মানব চিত্তের জন্য আনন্দদায়ক সব ধরনের গাছপালা বা উদ্ভিদের বন-বনানী গড়ে তোলার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এসবই মানুষের চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম ও মানুষ এসবকে দেখে যেন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় এবং পাপ করে থাকলে আল্লাহর কাছে তওবা করে। মহান আল্লাহ সুরা নাম্ল্-এর ৬০ নম্বর আয়াতে বলেছেন: তোমাদের তৈরি-করা উপাস্য মূর্তিগুলো ভালো না যিনি আকাশমণ্ডল ও জমিনগুলো সৃষ্টি করেছেন তিনি উত্তম? তিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। বৃষ্টির ফলে সৃষ্টি হয় সুন্দর সবুজ উদ্যান যা চিত্তকে করে প্রফুল্ল। তোমরা কখনও এমন গাছপালা গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখ না।
মহানবীর-সা পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম জাফর আস সাদিক-আ. বলেছেন, বিচিত্র বর্ণের তথা রঙবেরঙের ফুলগুলোর দিকে তাকাও, সবুজ গাছপালা ও ফুলের সুন্দর কুড়িগুলোর দিকে তাকাও! এসব মানুষকে এমন আনন্দ দেয় যে অন্য কোনো আনন্দই এর সমতুল্য নয়।
আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী -আ. বছরে অন্তত একবার নার্গিস ফুলের ঘ্রাণ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন মানুষের অন্তরে এমন কিছু অবস্থা আছে যা কেবল নার্গিস ফুলই দূর করে।
শিশুদেরকে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে মহান আল্লাহর অশেষ দয়া ও ক্ষমতার বিষয়টি তাদের বোঝানো যায়। শিশুদেরকে অবশ্যই খুব কাছ থেকে ফুল, গাছপালা ও জীবজন্তুসহ প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা নানা জীবের সঙ্গে করতে হবে পরিচিত। সৃষ্টিকুলের পরিচয় জানার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ তথা স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা অর্জন করে।
শিশুরা সাত বছর পর্যন্ত তাত্ত্বিক বিষয় বুঝতে পারে না। তাই তাদের বাবা মায়ের ও অভিভাবকের উচিত সরাসরি নানা দৃশ্যমান বিষয় দেখিয়ে শিশু সন্তানদেরকে আল্লাহর সম্পর্কে ধারণা দেয়া।
প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের মানুষের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা, আনন্দ ও প্রশান্তি বাড়িয়ে দেয় এবং কমিয়ে দেয় দুঃখ ও বেদনা। ফুল কেনা, ফুল দেখা ও ফুল গাছ রোপণ-এর বিষয়ে গবেষণাই এর প্রমাণ। প্রতিদিন সকালে বা বিকেলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভ্রমণ আপনাকে দিতে পারে অপার প্রশান্তি। চোখ মেলে দেখুন ফুল আর ঘাসের ওপর শিশির-বিন্দু। আপনার মনটাও হয়ে যাবে ফুলের মত কোমল ও পেলব।
মন-মানসিকতা যদি খিটমিটে হয়ে যাওয়ার অবস্থায় থাকে প্রাকৃতিক পরিবেশে ভ্রমণ তা দুর করে দেবে। আর এ জন্যই গ্রামাঞ্চলে থাকায় যারা প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রকৃতির মুক্ত হাওয়া ও সবুজ বনানী উপভোগ করে তারা শহরে যান্ত্রিক একঘেয়ে জীবনে অভ্যস্ত মানুষের চেয়ে বেশি সুস্থ ও প্রফুল্ল থাকে এবং দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হয় বলে গবেষণায় দেখা গেছে। নানা ধরনের মানসিক চাপ কম থাকে বলে গ্রামের মানুষের মধ্যে উচ্চ-রক্তচাপ ও হৃদরোগও কম হয়। এমনকি প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিও মানুষের মানসিক চাপ অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
শিশু-কিশোরদের নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে ভ্রমণ তাই খুবই জরুরি। আবদ্ধ খাঁচার মত বদ্ধ পরিবেশে দীর্ঘকাল শিশুদের ধরে রাখা খুবই বিপজ্জনক। এতে তাদের আচরণ ও আত্মবিশ্বাসও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে পারে। আপনি আপনার শিশুকে নিয়ে পার্কে ও জঙ্গলে ঘুরলে সে অনেক কিছু জানতে পারবে প্রশ্ন করে। শিশুদের নানা বিষয় শেখানোর জন্য এ ধরনের ভ্রমণ খুবই জরুরি। প্রকৃতির মাঝে যে নিয়মের রাজত্ব বা কর্তৃত্ব ও ঐকতান রয়েছে তাও দেখার ও শেখার বিষয়। ব্যাপক মাত্রায় অক্সিজেনের চাহিদা মেটানোর জন্যও গাছপালায় পরিপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ভ্রমণ খুবই জরুরি। প্রাকৃতিক পরিবেশে ভ্রমণ শিশু-কিশোরদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, সামাজিক চেতনা ও শারীরিক উৎকর্ষতাও বাড়িয়ে দেয়। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য ভ্রমণের সময় শিশু ও কিশোরদের জন্য যা যা নেয়া জরুরি তা নিতে অভিভাবকরা যেন ভুল না করেন।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/০৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।