সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-৩৪ "সর্বশেষ পর্ব")
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনায় আমরা শিশুদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুললে শিশুর জন্ম নেয়ার আগ থেকেই বাবা-মায়ের করণীয় নানা কাজ বা দায়িত্ব এবং এ সংক্রান্ত ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে আমরা কথা বলেছি।
শিশু কিশোরদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা ও ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। সুসন্তানের অধিকারী হওয়া মহান আল্লাহর এক বড় নেয়ামত এবং এ জন্য মহান আল্লাহর কাছে সব সময় কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। সন্তানকে ভালো মানুষ ও সুসভ্য হিসেবে গড়ে তুলতে মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া ইসলামের অন্যতম ঐতিহ্য। মহানবীর (আ.) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ) তাঁর প্রার্থনায় বলতেন: হে আল্লাহ! আমার সন্তানদের সুশিক্ষিত ও সভ্য করে গড়ে তুলতে আপনি আমাদের সাহায্য করুন।
আমরা জেনেছি যে সন্তানকে সুশিক্ষিত, সৃষ্টিশীল ও সুচরিত্রের অধিকারী বা সুসভ্য করতে হলে আগে বাবা-মাকেই এক্ষেত্রে আদর্শ-স্থানীয় হতে হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুস্থ ও যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরিবারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক ভূমিকার কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। সুস্থ ও যোগ্য সন্তান গড়ে তোলার জন্য স্বামী-স্ত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন থাকা খুব জরুরি এবং তাদের মধ্যে যেন কোনোভাবেই বিচ্ছেদের পরিবেশ সৃষ্টি না হয়। পরিবার-ব্যবস্থাকে মজবুত রাখা ও সৌভাগ্যের নীড় হিসেবে গড়ে তোলা ছিল নবী-রাসুলদের অন্যতম প্রত্যাশা। তাঁরা এ লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
পরিবার হচ্ছে স্নেহ-মমতার এক অনন্য নীড় এবং সমাজের সুখ শান্তির অন্যতম প্রধান ভিত্তি । বিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে এক পবিত্র চুক্তি ও সামাজিক বন্ধনের সেতু। সন্তান এই বন্ধনকে সুদৃঢ় করে।
পরিবারগুলো হচ্ছে নানা প্রথা, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও শিক্ষা-বিনিময় ও সম্প্রচার করার এবং ধরে রাখার মাধ্যম। খাবার গ্রহণের প্রথা থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান পরিবারের মধ্যেই গড়ে ওঠে। পরিবারগুলো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পৌঁছে দেয়। পরিবারগুলোর টিকে থাকার ওপরই নির্ভর করে ভবিষ্যত মানব-প্রজন্মের টিকে থাকা। একটি বিখ্যাত উপদেশে বলা হয়েছে: আপনার কর্মসূচি যদি হয় এক বছরের তাহলে গম বপন করুন, যদি পাঁচ বছরের কর্মসূচি থাকে তাহলে বৃক্ষ রোপণ করুন, আর যদি শত-বছর-কেন্দ্রিক কর্মসূচি থাকে তাহলে মানুষ গড়ে তুলুন!
মানুষকে মহান আল্লাহর ঘোষিত লক্ষ্যের আলোকে গড়ে তোলা হচ্ছে চিরস্থায়ী পুঁজি-বিনিয়োগ। পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষকে গড়ে তোলা মানে তাকে বাঁচিয়ে তোলা ও তার মধ্যে খোদায়ি প্রাণ বা চেতনার সঞ্চার করা। আর এই জরুরি কাজের ক্ষেত্র হল পরিবার।
যে পরিবার সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত সে পরিবারই সুস্থ ও স্থায়িত্বের অধিকারী। এ ধরনের পরিবার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং এ ধরনের পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে রয়েছে উচ্চতর উন্নত সম্পর্ক। তারা নীতি নৈতিকতার ক্ষেত্রে শক্তিশালী হলেও পরস্পরের প্রতি নমনীয়। এমন পরিবারে স্ত্রী স্বামীকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন না এবং স্বামীও তদ্রূপ এবং কর্তৃত্বকামী নন। তারা পরস্পর মত বিনিময় ও পরামর্শের মাধ্যমে সন্তানকে সুশিক্ষিত মানুষ ও পরিবারকে শক্তিশালী করেন।
পবিত্র কুরআন সন্তান গ্রহণকে উৎসাহ দিয়ে বলেছে, সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য। ‘স্থায়ী সৎকর্ম’ তোমার রবের কাছে পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশান্বিত হওয়ার জন্যও সর্বোৎকৃষ্ট। (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৪৬)
সন্তান-সন্ততি পরিবারে বয়ে আনে আনন্দ ও প্রশান্তি। মার্কিন গবেষক ব্রিগহাম ইয়ং বিশ্বের ৮৬টি দেশের দুই লাখ পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছেন যে সন্তানের অধিকারী হওয়ার পর বাবা-মায়েদের উচ্চ-রক্তচাপ কমে গেছে এবং তাদের মধ্যে কোনো কিছু শেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। এ ছাড়াও সন্তানের অধিকারী হওয়ার পর বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার বাড়ে ও বাড়ে আত্মবিশ্বাস এবং ছোটখাটো কাজেও মনোযোগ বা দক্ষতা বাড়ে। বাবা-মা হওয়ার পর তারা নানা ধরনের সৌন্দর্যকে আগের চেয়েও বেশি উপলব্ধি করেন বলে এই মার্কিন গবেষকের গবেষণায় দেখা গেছে।
সন্তান-সন্ততি পরিবারে সব ধরনের বরকত নিয়ে আনে। যেমন, সন্তানের অধিকারী হওয়ার পর প্রাচুর্য, সৌভাগ্য, মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা এবং সমৃদ্ধির মত বিষয়গুলো বাড়ে। জীবনকে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ভরিয়ে দেয় সন্তানসন্ততির আগমন। মুসলিম পরিবারে সন্তান সন্ততির আগমন সমাজবদ্ধ জীবনের আনন্দ ও সুমিষ্টতা বাড়িয়ে দেয় বলে তারা মনে করেন।
সমাজকে সুস্থ রাখতে হলে পরিবারগুলোকে মানসিক দিকসহ সব দিকে সুস্থ রাখতে হবে। মানবজাতির যত অগ্রগতি ঘটেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা ঘটেছে সমৃদ্ধ ও সুস্থ পরিবার থাকার কল্যাণেই। সমৃদ্ধ ও সুস্থ পরিবার না থাকলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনেক প্রচেষ্টাই হয়ে পড়ে নিষ্ফল।–
মানুষ নিজ পরিবারের মধ্যেই আত্ম-পরিচিতি ও ব্যক্তিত্ব গড়ার অনুপ্রেরণা পায়। মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পূর্ণতা অর্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হল পরিবার। মোট কথা সুস্থ পরিবার হল প্রশান্তি ও উন্নতির সোপান।
পরিবার যদি সুশিক্ষিত হয় তাহলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতির পথ সুগম হয় এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মানবীয় মূল্যবোধেরও বিকাশ ঘটে।
তাই পরিবার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়ে গেছেন সব নবী-রাসুল। ইসলাম ধর্ম পরিবারকে শক্তিশালী করার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার হল দয়া ও ভালবাসার কেন্দ্র। পরিবার যদি উন্নত না হয় সমাজও উন্নত হয় না। মানুষের স্নেহ-মমতার চাহিদাসহ আধ্যাত্মিক ও অন্য অনেক চাহিদা মেটানো পরিবারের মাধ্যমেই সম্ভব হয়।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী উন্নত পরিবারের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন: একটি ভালো পরিবার অর্থ সেখানে স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের প্রতি দয়ালু, বিশ্বস্ত ও আন্তরিক এবং পরস্পরের প্রতি অনুরাগী। তারা একে অপরকে সাহায্য করে এবং পরস্পরের ইচ্ছা ও প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়। দ্বিতীয়ত তারা সন্তানের ব্যাপারে দায়িত্বশীলতা অনুভব করে। তারা সন্তানকে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে সুস্থ হিসেবে বড় করতে চান। বৈষয়িক ও আত্মিক দিক থেকে তাকে সুস্থ রাখতে তারা তাকে কিছু বিষয় শেখান ও কোনো কোনো বিষয়ে তাকে বাধ্য করেন ও কোনো কোনো বিষয় থেকে বিরত রাখেন এবং ভালো নানা গুণ তার মধ্যে সঞ্চার করেন। এ ধরনের পরিবার গোটা দেশের সব সংস্কারের ভিত্তি। কারণ এ ধরনের পরিবারের সদস্যরা ভালো গুণের অধিকারী হয়। তাদের মধ্যে থাকে সাহসিকতা, স্বাধীন চিন্তা, চিন্তাশীলতা, দায়িত্বশীলতার অনুভূতি, স্নেহানুভূতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহসিকতা ও সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, তারা হন কল্যাণকামী, অকল্যাণকামী নন এবং ভদ্র ও সুশীল। কোনো সমাজের মানুষ যখন এ ধরনের গুণী হন তখন সেই সমাজ কখনও দুর্ভাগ্যের শিকার হয় না।
মহান আল্লাহ আমাদের এমন পরিবারের অধিকারী হওয়ার তৌফিক দান করুন। আলোচনা শেষ করব পবিত্র কুরআনের প্রার্থনামূলক এই বাক্য দিয়ে:
হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রী এবং আমাদের সন্তানকে এমন দয় করা যাতে তারা আমাদের দৃষ্টিকে করে প্রশান্ত এবং আমাদেরকে খোদা-সচেতন বা মুত্তাকীদের জন্যে কর আদর্শস্বরূপ।
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার সর্বশেষ পর্ব এখানেই শেষ করছি।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।