সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-৩২)
সন্তানের অধিকারী হওয়া মানুষের কাছে অত্যন্ত সুখ ও সৌভাগ্যের বিষয়। সন্তান বাবা-মায়ের স্মৃতি ও উত্তরাধিকার বহন করে।
নারী ও পুরুষের বিয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল বংশধর রেখে যাওয়া তথা মানব প্রজন্ম অব্যাহত রাখা। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে অনেক মুসলিম পরিবার বা দম্পতি এখন সন্তান নেয়ার বিষয়ে অনীহা দেখাচ্ছেন। আবার অনেকে সন্তান নিতে চাইলেও কেবল এক সন্তান নিতে চান এবং একের বেশি সন্তান নেয়াকে অর্থনৈতিক দিকসহ নানা দিক থেকে ঝামেলার বিষয় বলে মনে করেন। ফলে দেশগুলোর জনসংখ্যা নানা ধরনের সংকট ও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। অথচ প্রকৃতির অন্য কিছুর মধ্যে যেমন গাছপালা ও পশুপাখির মধ্যে জনসংখ্যাগত এ ধরনের সমস্যা নেই। বাস্তবে দেখা গেছে যারা সন্তানহীন তাদের তুলনায় সন্তানের অধিকারী দম্পতিরা বেশি সুখী এবং যাদের সন্তান সংখ্যা বেশি তারা এক সন্তানের অধিকারী পরিবারের চেয়ে বেশি সুখী।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম বেশি সন্তান নিতে মুসলমানদের উৎসাহ দেয়। মহানবী (সা) বলেছেন, হে নারী ও পুরুষেরা! তোমরা বিয়ে কর ও বংশধর বা সন্তানের অধিকারী হয়ে জনসংখ্যা বাড়াও! ক্বিয়ামতের দিন আমি অন্যান্য উম্মতের সামনে আমার উম্মতের সংখ্যাধিক্য নিয়ে গৌরব করব, এমনকি গর্ভে মরে যাওয়া সন্তানের সংখ্যা যোগ করে হলেও!
ইসলামী বর্ণনায় সন্তানকে বাবা মায়ের হৃদয়ের ধন বা ফল, বেহেশতি সুগন্ধি ফুল, জীবনের ফসল ও জীবন ইত্যাদি নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সন্তানের অধিকারী হলে মানুষ মানসিক ও আত্মিক দিক থেকে প্রশান্তি অনুভব করে এবং মানসিক অস্থিরতা ও হতাশা থেকে মুক্তি পায়। সন্তান থাকলে পারিবারিক বন্ধনও বেশি সুদৃঢ় হয়। সন্তান-সন্ততি ও তাদের ভরণ-পোষণ নিয়ে মানুষ যখন ব্যস্ত থাকে তখন তারা জীবনের ছোটখাটো অনেক সমস্যা ও সংকটের কথা ভুলে যায় বা সেসব সংকট তাদেরকে দুর্বল করে না।
অবশ্য কোনো পরিবার বা দম্পতি যদি সাংস্কৃতিক দারিদ্রে ভোগেন এবং এ কারণে সন্তানদের ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করতে তথা ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারেন তাহলে এমন পরিবার বা দম্পতিগুলোর জন্য বেশি সন্তান ইসলাম ও এর মহান নেতৃবৃন্দের লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। আর আর্থিক দৈন্যতার ভয় করে কম সন্তান নেয়া বা কেবল এক সন্তান নেয়াও অত্যন্ত অযৌক্তিক। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, এমন কোনো প্রাণী বা জীব নেই যার রিজিকের ব্যবস্থা মহান আল্লাহ করেন না। (সুরা হুদ-৬) সুরা আনআমের ১৫১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা দারিদ্রের ভয়ে সন্তানদের হত্যা করো না। তোমাদেরকে ও তাদেরকে আমিই রিজিক দিয়ে থাকি।–এ থেকে স্পষ্ট মহান আল্লাহই সব মানুষ ও জীবের রিজিক সরবরাহের গ্যারান্টি দিয়েছেন।
যেসব পরিবারের বাবা ও মা দুজনই চাকরি করেন বা পরিবার থেকে দূরে বিশেষ কর্মক্ষেত্রে যান তাদের কেউ কেউ ঝামেলার অজুহাত দেখিয়ে ও কেউ কেউ অর্থনৈতিক দৈন্যতার অজুহাত দেখিয়ে বেশি সন্তান নিতে চান না। অথচ একমাত্র সন্তানের দেখাশুনা করা ও প্রতিপালন দুই বা ততোধিক সন্তানের প্রতিপালনের চেয়ে বেশি কঠিন। পরিবারের একমাত্র সন্তান না চাইতেই সব কিছু সহজে পেয়ে যায় বলে তারা কম ধৈর্যশীল হয় এবং খুব সামান্য বকা-ঝকাতেই তারা মুষড়ে পড়ে। খুব সামান্য অপমান এবং এমনকি কখনও কখনও হাসি-ঠাট্টাও তারা সহ্য করতে পারে না। খুব সামান্য অপমান ও বঞ্চনাকেও তারা দীর্ঘকাল মনে রাখে। কোনো কিছু চাওয়া মাত্রই যুগিয়ে দেবে এমন সুহৃদ ব্যক্তিকেই কেবল তারা আপন বলে মনে করে। পরিবারের একমাত্র সন্তান অনেক সময় নিজের দরদের কথাগুলো অন্যদের বলে না এবং তারা অন্তর্মুখী হয়ে থাকে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন পরিবারের একমাত্র সন্তান জীবনের নানা বিষয়ে অন্যদের চেয়ে কম দক্ষ হয় বা দেরিতে দক্ষ হয়। কারণ অনেক দক্ষতা বা গুণ থাকার দরকারও তারা অনুভব করে না। বেশি আদর পায় বলে এ ধরনের সন্তান ব্যক্তিগত অনেক কাজেই তুলনামূলকভাবে অন্য শিশুদের চেয়ে বেশি পর-নির্ভর হয়ে থাকে। যেমন, দাঁত মাজা, পোশাক পাল্টানো ও সাইকেল চালনা শেখা। কিন্তু যেসব পরিবারে একাধিক বা দুইয়ের বেশি সন্তান থাকে সেসব পরিবারের সন্তানরা এসব কাজে খুব দ্রুত দক্ষ ও স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। একাধিক সন্তান বা দুইয়ের বেশি সন্তান থাকলে তারা খুব সহজেই একে অপরের কাজে অনুপ্রাণিত হয় এবং দ্রুত নানা দক্ষতা অর্জন করে। ফলে দুই বা ততোধিক সন্তান খুব সহজেই পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশে ও একই ধরনের অনুরাগ নিয়ে সব বিষয়ে দক্ষ ও পরিপক্ব হতে থাকে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে পরিবারের একমাত্র সন্তান বেশিরভাগ সময়ই ক্লান্তি অনুভব করে এবং কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করলেও সে বিষয়ে লেগে থাকার মানসিক উদ্দীপনা খুব কমই পায়। পরিবারের একমাত্র শিশু সন্তান বা কিশোর কিশোরী যদি প্রায় একই বয়সের অন্য শিশু বা কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে নানা বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ না পায় তাহলে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বন্ধুত্ব ও ঈর্ষার মত বিষয়গুলো খুব কমই বুঝতে পারে। তাই তাদের জন্য এ ধরনের সমবয়সী গ্রুপের সাহচর্য খুবই জরুরি। একমাত্র সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অতিরিক্ত যত্নের কারণে এ ধরনের সন্তান সমস্যাগুলোর মোকাবেলায় উদ্ভাবনী ক্ষমতা বা সৃষ্টিশীলতার প্রয়োগ বা দেখে-ঠেকে শেখার ক্ষমতা ও দায়িত্বশীলতা সহজেই অর্জন করতে পারে না। এ অবস্থায় একমাত্র সন্তান হয়ে ওঠে বেপরোয়া বা একরোখা ও সমালোচনা-বিমুখ এবং বাবা-মাকে তার সব আবদারই অনুগত দাসের মত মেনে নিতে হয়।
অবশ্য সমাজ-বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে পরিবারের একমাত্র সন্তান স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো নম্বর পেয়ে থাকে। তারা সহপাঠীদের তুলনায় পড়াশুনায় ভালো হয়ে থাকে। কিন্তু অন্য একদল গবেষক মনে করেন এই শ্রেণীর শিশু-কিশোর সন্তানরা অন্যদের তুলনায় সামাজিক ও সামষ্টিক কাজে কম অংশ নেয় এবং তারা সাধারণত অন্তর্মুখী হয়ে থাকে। এক সন্তানকেন্দ্রীক পরিবারগুলোর কোনো নিন্দা না জানিয়েই এ ধরনের সন্তান থাকার নানা দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সবারই সতর্ক হওয়া জরুরি যাতে সমাজ এ ধরনের পরিবারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/০৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।