ডিসেম্বর ০৬, ২০২১ ২০:১২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছি, ঘরে পোষা প্রাণীর সঙ্গে বসবাসের প্রবণতা বাড়ার কিছু কারণ রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে,পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে একাকীত্বে ভুগেন এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। তাদের সঙ্গে কেউ বসবাস করেন না। এ ধরণের নিঃসঙ্গ মানুষের মধ্যে অনেকেই আবার বৃদ্ধ। এ ছাড়া কোনো কোনো পরিবার তাদের সন্তানের খেলার সাথী হিসেবে পোষা প্রাণীকে বেছে নেন। জীবনসঙ্গী,সন্তান,ভাই ও বোনের শূন্যতা পূরণ করতে তারা এটা করেন। পাশ্চাত্যে বিশেষকরে আমেরিকায় পোষা প্রাণীকে পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করাটা তাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির যুগে মানুষের পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি বিশেষকরে পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের মধ্যে আন্তরিকতা হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে প্রতিনিয়তই সৃষ্টি হচ্ছে বড় ধরণের শূন্যতা। আর এই শূন্যতা পূরণ করতেই পাশ্চাত্যের মানুষ পশুর দিকে ঝুঁকছে।

কিছু দিন আগে নিউজ পোর্টাল 'নিউ ইয়র্ক পোস্ট'এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সন্তানের স্থলে কুকুর লালনপালনের প্রতি ঝোঁক প্রসঙ্গে লিখেছে,২০১৮ সালের গবেষণায় দেখা গেছে নিউ ইয়র্কের এক-তৃতীয়াংশ পরিবার সন্তান লালনপালন না করে কুকুর লালনপালনের প্রতি বেশি আগ্রহী। ‘ওয়ান পোল'গবেষণা কেন্দ্র নিউ ইয়র্কের দুই হাজার পরিবারের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ৩৪ শতাংশ পরিবার সন্তান জন্ম দেওয়ার চেয়ে কুকুর কেনাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। অপর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ পরিবার অর্থাৎ ৬৬ শতাংশ পরিবার কুকুরকে পরিবারের মূল সদস্য হিসেবে গণ্য করেন। তারা বলেছেন,কুকুরকে তারা নিজের সন্তান বলেই মনে করেন এবং কুকুরের প্রতি অনেক বেশি মনের টান অনুভব করেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী অর্ধেক পরিবারই জানিয়েছেন, তারা তাদের পোষা প্রাণী বা কুকুর-বিড়ালের আবেগ-অনুভূতিগুলোকে বুঝতে পারেন। তারা এই কুকুর-বিড়ালকেই সবচেয়ে ভালো বন্ধু বলে মনে করেন। তারা এগুলোর সঙ্গে কথা বলেন। এর মাধ্যমে নিজেদের নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করেন।

কোনো কোনো পরিবার বলেছেন,নিজের সন্তানের চেয়ে কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে সময় কাটানো তাদের জন্য বেশি আনন্দদায়ক ও উৎসাহব্যঞ্জক। ইউরোপের বেশিরভাগ চিকিৎসক পোষা প্রাণীর মালিকদের সতর্ক করে বলেছেন,স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরও এমনকি পশুকে নিয়ে এক বিছানায় না থাকলেও রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এ কারণে পশু লালনপালনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি বিশেষকরে শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ শিশুদের এ ধরণের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা তুলনামূলক কম থাকে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেছেন,পোষা প্রাণী যারা পালেন তারা নানা ধরণের রোগের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এ পর্যন্ত ৮৫০ ধরণের রোগ চিহ্নিত হয়েছে যেগুলো সহজেই পোষা প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। একইভাবে এসব রোগ মানুষের শরীর থেকেও পোষা প্রাণীর শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। বিশেষকরে যাদের হাঁপানি ও অ্যালার্জির মতো রোগ আছে,তাদের জন্য ঘরে পোশা প্রাণী রাখা অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।

এখন কুকুরের পাশাপাশি বিড়াল লালনপালনের প্রতিও মানুষের ঝোঁক দেখা যায়। কিন্তু এই বিড়ালও মারাত্মক অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। বিড়ালের অ্যালার্জেনের মূল উৎস হচ্ছে তাদের ত্বকে অবস্থিত তৈলাক্ত গ্রন্থি। এই গ্রন্থি থেকে কিছু অ্যালার্জেন উপাদান নিঃসৃত হয় ও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর কুকুরের মূল অ্যালার্জেন হচ্ছে লালা। লোমের ভূমিকা তুলনামূলক কম। কুকুর-বিড়াল ছাড়াও অন্য আরও কিছু পশু অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। এদের শরীরের নানা উপাদানের সংস্পর্শে এলে আক্রান্ত সংবেদনশীল ব্যক্তির শ্বাসতন্ত্র পেশি সংকুচিত হয়,নানা রাসায়নিক নিঃসৃত হয়,শ্বাসনালি সরু হয়ে পড়ে। ফলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। এ কারণে ঘরের ভেতর রোমশ প্রাণীর চলাচল সীমিত রাখা জরুরি। কিন্তু অনেকেই পোষা প্রাণীর সঙ্গে মেশার সময় প্রাথমিক সাবধানতাও অবলম্বন করতে চান না। খানিকটা সচেতনতার অভাবে এই সব নিরীহ প্রাণী থেকে যে মারাত্মক রোগ সংক্রমিত হতে পারে তা ভুলে যান। কেউ কেউ পোষা প্রাণীর সামান্য কামড়ানো বা আঁচড়ানোকে তোয়াক্কা করেন না। অনেকে শোয়ার ঘরে কুকুর-বিড়াল রাখেন এবং বিছানা,সোফা,চেয়ার ইত্যাদিতে বসতে দেন। এর ফলে মারাত্মক বিপদ নেমে আসতে পারে।

চিকিৎসকদের মতে, ব্যাকটেরিয়া বাহিত মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে পোষা প্রাণীর মাধ্যমে। কুকুর,বিড়াল-সহ যে কোনও পশুর মুখের ভিতরে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে। কোনো কারণে পোষা প্রাণী কামড় দিলে সেই ব্যাকটেরিয়া মানুষের শরীরে প্রবেশ করে যা থেকে ইনফেকশন হয়। আরেক ধরণের রোগের নাম ক্যাট স্ক্র‌্যাচ ফিভার। বারটোনেল্লা নামে একটি অতি ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া থেকে এই রোগটি হয়। এর ফলে জ্বর হয়,লিম্ফ নোড ফুলে যায়। আঁচড়ের স্থানে ফোসকার মতো হয়। এর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন পড়ে। পোষা প্রাণীর সঙ্গে সব সময ওঠবস করার কারণে হতে পা বোভাইন টিউবারকিউলোসিস রোগ। বিভিন্ন ধরনের পোষা প্রাণীর মাধ্যমেই মানুষের শরীরে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। টিবি রোগের ব্যাকটেরিয়া টিউবারকিউলোসিসের থেকে এটি পৃথক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। এই রোগে কখনও কখনও টিবির উপসর্গ দেখা যায় আবার কখনও আলাদা লক্ষণও হতে পারে।

বিড়ালের মল,মূত্র থেকে টোক্সোপ্লাসমোসিস রোগ হতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং বয়স বেশি তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদেরও হতে পারে এই রোগ। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের এই রোগ হলে বিপদ বেশি। ফাংগাস বাহিত রোগও হতে পারে। পোষা প্রাণী থেকে ফাংগাস বাহিত রোগ দাদ হওয়ার আশঙ্কা থাকে‌। এতে ত্বকে গোলাকৃতি ইনফেকশন হয়। কুকুরের কারণে হতে পারে পরজীবী বাহিত নানা রোগ। বিশেষকরে ইকাইনোকক্কাস গ্র‌্যানুলস পরজীবী কুকুরের ক্ষুদ্রান্ত্রে থাকে। এই পরজীবীর মাধ্যমে সংক্রামিত কোনও কুকুরের মলের সংস্পর্শে এলে মানুষের শরীরে এই রোগটি হয়। এর ফলে লিভার ও অন্য অঙ্গে সিস্ট হতে পারে। এছাড়া রয়েছে ভাইরাস বাহিত রোগ- জলাতঙ্ক। কুকুর কামড়ালে বা আঁচড়ালে এটি হয়। ক্ষত কতটা তার উপর ভ্যাকসিন ও ইমুনোগ্লোবিউলিনের প্রয়োজন হয়। চিকিৎসা না করলে মৃত্যু হতে পারে।

এসব কারণেই পবিত্র ইসলাম ধর্ম পশু পালনের ক্ষেত্রে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম ধর্ম কুকুরের মতো কিছু প্রাণীকে বসবাসের ঘরে রাখতে নিষেধ করেছে। আসলে ইসলাম ধর্মে পুরো জীবন প্রণালীই হচ্ছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞাভিত্তিক। ইসলাম যেসব নির্দেশনা দিয়েছে তা মেনে চললে মানুষ শান্তিপূর্ণ সক্ষম হতে পারে। শারীরিক ও মানসিক দুষণ থেকেও মুক্ত থাকতে পারবে। তবে এর অর্থ এই নয় যে,ইসলাম ধর্ম কুকুরসহ এ ধরণের প্রাণীর অীধকারকে অস্বীকার করেছে। ইসলাম ধর্মেও প্রতিটি প্রাণীর সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার ভিত্তিতে নিজস্ব অধিকার রয়েছে, মুসলমানদেরকে তা মেনে চলতে হবে।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ