ডিসেম্বর ২৭, ২০২১ ১৯:৫৪ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছি বিশ্বে প্রতি বছর বিজ্ঞাপন খাতকে ঘিরে অর্থের লেনদেন হয় প্রায় এক থেকে দুই ট্রিলিয়ন ডলার।

বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন যে কেবল অর্থনীতির উপরই প্রভাব ফেলে তা কিন্তু নয়, এর প্রভাব পড়ে সমাজ ও সংস্কৃতির উপরও। সমাজে নতুন প্রবণতা চালু করতে বিজ্ঞাপনের জুড়ি নেই। সারা বিশ্বেই যেসব বিষয়ে বিজ্ঞাপন বেশি চোখে পড়ে সেগুলোর একটি হলো খাদ্যপণ্য। এছাড়া প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞাপনের প্রভাবে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধেও পরিবর্তন এসেছে। পারিবারিক ভোগের মডেল পাল্টে গেছে।  পাঠক, দর্শক ও শ্রোতাদের চিন্তা ও মননে বিজ্ঞাপন এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে, মানুষের পণ্য কেনার আগ্রহ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মিডিয়া এমনভাবে আকর্ষণীয় করে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয় যে, মানুষ তা দেখে যে করেই হোক সেই পণ্য কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বিস্তার ঘটছে ভোগবাদের।

ভোগবাদের বিস্তারে গণমাধ্যম বিশেষকরে টেলিভিশনের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারীরা টিভি বিজ্ঞাপনকে বিজ্ঞাপনের রাজা বলে অভিহিত করে থাকেন। কারণ বেশিরভাগ মানুষ প্রতিদিন গড়ে কয়েক ঘণ্টা টিভি দেখেন। যেমন আমেরিকার নাগরিকেরা প্রতিদিন গড়ে চার ঘণ্টা টিভি দেখেন। অন্যভাবে হিসাব করলে বলা যায় বছরের ১২ মাসের মধ্যে তাদের দুই মাস ব্যয় হয় টিভি দেখার পেছনে। অর্থাৎ ৬৫ বছর বয়সী একজন মার্কিন নাগরিক তার জীবনের ৯ বছরই টিভির সামনে বসে ব্যয় করেন।  টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করেই পণ্য উৎপাদনকারীরা তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে ভোক্তাদের সামনে তুলে ধরে এবং ভোগের প্রতি আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে। টিভি চ্যানেলের দর্শক বৃদ্ধির সঙ্গে বিজ্ঞাপনের সাফল্যের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

টিভির দর্শক একইসঙ্গে টিভির অনুষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপনেরও দর্শক। টিভির একজন দর্শক যখন অনুষ্ঠান দেখে তখন সে সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে, আর যখন বিজ্ঞাপন দেখে তখন সে পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্র তৈরি করে। এভাবে একজন দর্শক সাংস্কৃতিক শ্রেণি ও ভোক্তা শ্রেণিভুক্ত হয়ে যায়। এভাবে টিভি চ্যানেলসহ গণমাধ্যম ভোক্তা শ্রেণি তৈরি করছে প্রতিনিয়ত। এছাড়া টিভি অনুষ্ঠানমালায় পরোক্ষভাবেও পণ্যের বাজার তৈরির চেষ্টা করা হয়। টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানমালা যে দর্শক শ্রেণী সৃষ্টি করে বিজ্ঞাপন সেই দর্শক শ্রেণিকে পণ্যের বাজারে পাঠিয়ে দেয়। দর্শককে আকৃষ্ট করে ভোক্তায় পরিণত করার কলাকৌশল বিজ্ঞাপন শিল্পে রয়েছে। এর ফলে গণমাধ্যমের দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের একটা অংশকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্যের ভোক্তায় পরিণত করা হচ্ছে। আর মুনাফা করছে কোম্পানিগুলো। বিজ্ঞাপনে পণ্যকে কতটা আকর্ষণীয় ও মোহনীয় করে তুলে ধরা হচ্ছে তার ওপর নিভর করে চাহিদা তৈরি হয়। পণ্যের মানের চেয়ে উপস্থাপনের ধরণ এখানে মুখ্য হয়ে ওঠে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত লেখক ও তাত্ত্বিক নিল পোস্টম্যান বলেছেন, টিভি বিজ্ঞাপনে পণ্যের মান নিয়ে কোনো কথা নেই বরং সব কিছুই ভোক্তার বৈশিষ্ট্যকে ঘিরে। বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো বা বিজ্ঞাপনদাতারা পণ্যের গুণ-মান জানার প্রয়োজনবোধ করেন না বরং তারা ক্রেতার দুর্বল পয়েন্টগুলো জানতে আগ্রহী। তারা এই দুর্বল পয়েন্ট ব্যবহার করে ব্যবসা করতে চায়। এ কারণেই পণ্যের মান বৃদ্ধি বিষয়ক গবেষণায় বিনিয়োগ কমছে এবং বিজ্ঞাপন খাতে বিনিয়োগ দিন দিনই বাড়ছে। এখন গণমাধ্যমের আয়ের প্রধান উৎসই হচ্ছে বিজ্ঞাপন। বেশিরভাগ গণমাধ্যমের কাছে এখন আর দর্শক-শ্রোতা বা পাঠকের চাহিদা গুরুত্ব পায় না বরং এই গণমাধ্যমই মানুষের মাঝে নতুন নতুন চাহিদা তৈরির চেষ্টা চালায়। গণমাধ্যমই সুখের নিজস্ব সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেয় এবং জীবনের নতুন অর্থ বর্ণনা করে। তারা পৃথিবীর পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে নিজস্ব বর্ণনা তুলে ধরে। বর্তমান যুগের গণমাধ্যমের একটা বড় অংশই এখন তথ্য আড়াল বা বিকৃতির মাধ্যমে মানুষকে নিজেদের নির্ধারিত একটি লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করার চেষ্টা করে। 

গণমাধ্যমে পণ্যের বিজ্ঞাপনে পণ্যকে প্রয়োজনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। জাগিয়ে তোলা হয় আকাঙ্ক্ষা। আর আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে পণ্যকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হিসেবে দেখানো হয়। এর ফলে বিলাসদ্রব্যও হয়ে ওঠে অতিপ্রয়োজনীয়। বিজ্ঞাপনে যারা প্রভাবিত হোন তাদের কাছে তখন পুষ্টিকর খাবারের চেয়ে বিলাসদ্রব্যকে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে হতে থাকে। মৌলিক চাহিদা পূরণের চেয়ে তখন তার কাছে রং ফর্সা করা ক্রিমের মতো প্রসাধন সামগ্রী কেনাটা বেশি গুরুত্ব পায়। উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছেই তা কেবল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না নিম্নবিত্তরাও ভ্রান্ত সৌন্দর্য চর্চার সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আর বিজ্ঞাপন সৌন্দর্য চর্চার সংস্কৃতিকে ক্রমেই এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে যে, উৎপাদনকারীরা প্রসাধন সামগ্রীর দাম ব্যাপকভাবে বাড়ালেও সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষা কারণে এর চাহিদা কমে না।

বিজ্ঞাপন কম প্রয়োজনীয় পণ্যকেও কৃত্রিম উপায়ে অতিপ্রয়োজনীয় করে তোলে। বিজ্ঞাপনের কারণে মানুষ তার আসল প্রয়োজনের কথাই ভুলে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে আসল ও কৃত্রিম প্রয়োজনের মধ্যে রেখা টানার বোধ শক্তিও হারিয়ে ফেলে।  গণমাধ্যম সুখ ও সন্তোষের যে সংজ্ঞা আরোপ করে তাতে পণ্য হয়ে ওঠে সুখের উৎস। পণ্য ক্রয়ের সামর্থ্যই হয়ে ওঠে সুখ-শান্তির সমার্থক। মানুষ ভাবতে থাকে জীবন মানেই ভোগ। যে যত কম ভোগ করছে তার জীবন তত খানিই অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টিতে ভোগ মানেই পূর্ণতা। এভাবে ব্যক্তির কেনা পণ্যের দামের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয় ব্যক্তির মান-মর্যাদা। বিজ্ঞাপন দিয়ে এভাবেই গণমাধ্যম বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মুনাফা অর্জনের পথকে ক্রমেই প্রসারিত করছে, প্রসার ঘটাচ্ছে ভোগ-সংস্কৃতির। আসলে ভোগের সংস্কৃতিতে অল্পে তুষ্টির কোনো কথা নেই, এখানে আধিক্যেই কেবল সুখ অনুভূত হয়। এর ফলে অর্থ ও শ্রমের অপচয় ঘটে প্রতিনিয়ত।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ