জানুয়ারি ১০, ২০২২ ২০:৩৩ Asia/Dhaka

ভাই ও বোনেরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। ইসলামী ও ইরানি পরিবার বিষয়ক নতুন ধারাবাহিক আলোচনা অনুষ্ঠান সুখের নীড় থেকে আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি সাদর সম্ভাষণ ও আমাদের সঙ্গী হবার একান্ত আমন্ত্রণ।

অল্পে তুষ্টি হল জীবনে সুখ ও সৌভাগ্য অনুভবের সবচেয়ে একমাত্র রাজপথ। বিয়ের মাধ্যমে  সুখী পরিবার গড়তে গিয়ে অনেকেই দেরি করছেন সব দিকেই প্রত্যাশিত ও যোগ্য জীবন-সঙ্গী পাওয়ার অভাবে! এক্ষেত্রে প্রত্যাশাগুলো যদি হয় আকাশচুম্বী বা অবাস্তব তাহলে তা সোনার হরিণের পেছনে অযথা সময় নষ্ট করার মত পণ্ডশ্রমেই পরিণত হতে বাধ্য। আধুনিক অনেক কন্যারা পাত্র খুঁজতে গিয়ে উচ্চ-শিক্ষিত, খুব অভিজাত বা বনেদী পরিবারের ছেলে, ধনী, সুদর্শন, দীর্ঘদেহী, বাড়ি-গাড়ির মালিক, কখনওবা পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান ইত্যাদি সব ভালো দিক-সম্পন্ন পাত্র প্রত্যাশা করেন। পাত্র ধার্মিক ও সৎ স্বভাবের কিনা সেটাও কেউ কেউ পছন্দের তালিকায় রাখেন না বা অন্যান্য বিষয়গুলোর মত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না! সব দিকে শতভাগ সোনার ছেলে পাওয়াটা কঠিন এবং এসবের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পাত্রীর বয়সও অনেক বেশি হয়ে পড়ায় পাত্ররাও পাত্রীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

অন্যদিকে আধুনিক পাত্রদেরও অনেকেই পাত্রী খুঁজতে গিয়ে উচ্চ-শিক্ষিত, খুব অভিজাত বা ধনী ও বনেদী পরিবারের কন্যা, সুদর্শন, দীর্ঘদেহী ও রূপবতী, অতি উজ্জ্বল বর্ণ, কখনওবা পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান ইত্যাদি কথিত সব ভালো দিক-সম্পন্ন পাত্রী প্রত্যাশা করেন। পাত্রীর ধার্মিক ও সৎ স্বভাবসম্পন্ন হওয়ার বিষয়টিও সব পরিবারে সমান গুরুত্ব পায় না। আর এসব কিছুই একযোগে একজনের মধ্যে পাওয়া খুব দূরহ বা কঠিন হয়ে পড়ে। এটা মনে রাখা দরকার-  সব-দিকে সোনায়-সোহাগা পাত্রপাত্রী পাওয়াটা কল-কারখানার পণ্যের মত সুলভ নয়! পাত্র-পাত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে  ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত সৎ-স্বভাব ও ধার্মিকতাকে। আর অন্য সব দিক হল অপ্রধান। অনেক সময় দেখা যায় যে বাহ্যিক সৌন্দর্য বা রূপের অধিকারীরা যথেষ্ট মেধাবী নন অথবা ধার্মিক ও সৎ-স্বভাবের অধিকারী নন। মানুষকে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদের জন্য পছন্দ করা উচিত নয়, বরং পছন্দ করা উচিত তার সৎ স্বভাব ও ধার্মিকতার জন্য। বাহ্যিক ধন-সম্পদ ও রূপ-এসবই হচ্ছে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী বিষয়।  

মহান আল্লাহ জীবনসঙ্গী হিসেব যার জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তাতে সন্তুষ্ট হয়ে এবং তাকে খোদায়ি উপহার হিসেবে ধরে নিয়ে যদি পরস্পরের প্রতি অনুরাগী ও শ্রদ্ধাশীল হওয়া যায় তাহলে সংসারগুলো হয়ে উঠবে সত্যিকার অর্থেই সুখের নীড়। 

স্বামী ও স্ত্রীকে নারী ও পুরুষের পৃথক প্রকৃতি বা মনস্তত্ত্ব এবং তাদের মানসিক ও শারীরিক পার্থক্যগুলো বুঝতে হবে সুখী জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে। মনোবিজ্ঞান বলে নারী ও পুরুষের ব্যক্তিত্বের প্রকৃতি আর চেতনা ভিন্ন ধরনের। তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষিত হওয়ার প্রকৃতিও ভিন্ন রকম। আর এ ধরনের ভিন্নতার কারণেই নারী ও পুরুষ পরস্পরের কাছে আকর্ষণীয়। তাই স্বামী ও স্ত্রীকে বুঝতে হবে তাদের নানা ধরনের পার্থক্যের উৎস কি কেবলই চিন্তাগত না লৈঙ্গিক পার্থক্য থেকে উৎসারিত। চিন্তাগত মতভেদ সহজেই নিরসনযোগ্য। কিন্তু লৈঙ্গিক পার্থক্য থেকে উৎসারিত পার্থক্যগুলোর বিষয়ে পরস্পরকে উপলব্ধি করা জরুরি।

দাম্পত্য জীবন শুরুর প্রথম থেকেই স্বামী-স্ত্রীর উচিত কাজ ও দায়িত্বগুলো ভাগ করে নেয়া। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী-আ. ও হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহ আলাইহার জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখব ঘরের কাজগুলো করতেন নবী-নন্দিনী আর বাজার করা ও বাইর থেকে খাদ্য সংগ্রহের কাজসহ বাইরের যাবতীয় কাজ করতেন হযরত আলী-আ। অবশ্য ঘরের কাজেও হযরত ফাতিমাকে সহায়তা করতেন আমিরুল মুমিনিন।

আধুনিক যুগে ইরানসহ বিশ্বের পরিবার-প্রথায় এসেছে পরিবর্তন। পরিবারগুলো এখন আর আগের মত একান্নবর্তী নয়। বৈশ্বিক ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবারগুলো হয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র বা ছোট পরিসরের। পরিবারগুলোর অনেক দায়িত্বের মধ্যে কিছু দায়িত্ব পালন করছে শিক্ষা-বিভাগ, কলকারখানা ও গণমাধ্যমের মত নানা আধুনিক প্রতিষ্ঠান। ফলে পরিবারগুলোর দায়িত্বের বোঝা এখন অনেক কমে গেছে।

আধুনিক যুগের ছোট পরিবারগুলো মূলত দুই-প্রজন্ম-ভিত্তিক। পাশ্চাত্যে শিল্প-বিপ্লবের পর এ ধরনের পরিবার-প্রথা শুরু হয়। স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে গড়ে ওঠে এই শ্রেণীর পরিবার। এই পরিবারের সদস্যদের কেউই অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে একত্রে থাকে না। এ ধরনের পরিবারে বাবা অথবা মা কিংবা উভয়েই পরিবারের অর্থ-ব্যবস্থা পরিচালনা করেন। অর্থনৈতিক বিষয়ে তারা প্রথম পর্যায়ের আত্মীয়ের ওপর নির্ভরশীল নন। এ ধরনের পরিবারে সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো সাধারণত আলোচনা ও মত-বিনিময়ের মাধ্যমে নেয়া হয়। অনেক চিন্তাবিদ এ ধরনের পরিবারকে বুদ্ধিবৃত্তি-কেন্দ্রিক পরিবার বলে প্রশংসা করেছেন। কারণ বড় ধরনের সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার সময় এ ধরনের পরিবারের যে সদস্যের যুক্তি সবচেয়ে জোরালো বলে মনে হয় তাকেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়।  ক্ষুদ্র পরিসরের এই পরিবারগুলো কখনও বড় হয়ে ওঠে না। কারণ এমন পরিবারের যে সন্তানই প্রাপ্ত বয়স্ক হন তিনি চাকুরী নিয়ে ও নতুন পরিবার গঠন করে আলাদা হয়ে যান। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখন এ ধরনের পরিবার দেখা যায়। এবারে ইরানের এমনই এক পরিবারের কথা বলব।

জনাব রাহিমি ইরানের একটি অনু-পরিবার তথা ক্ষুদ্র পরিবারের দৃষ্টান্ত। বিয়ের বহু বছর পরও এ পরিবারের স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের গভীর অনুরাগী। তাদের রয়েছে তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। ছেলে ও মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা এখন পিত্রালয়ে থাকেন না। ছুটির দিনে ছেলে-মেয়েরা সপরিবারের বাবার বাসায় আসলে দুই কক্ষ বিশিষ্ট ৭০ বর্গমিটারের বাসাটিতে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু অন্যান্য দিনে এ বাসভবন যেন শীতল ও নীরব হয়ে যায়। এ সময় প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগে ও মসজিদে তার সময় কাটে। মসজিদ হচ্ছে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রশান্তি অর্জনের আদর্শ স্থান।  ছেলে মেয়েদের বাসভবন অনেক দূরে থাকায় তাদের সঙ্গে  রাহিমি দম্পতির যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে টেলিফোন। পরিবার বিষয়ে অন্যদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন রাহিমি-দম্পতি। তবে তাদেরই এক পুত্র সন্তানের সঙ্গে পুত্রবধূর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় রাহিমি দম্পতি তাদের নাতীর ভবিষ্যৎ স্নেহের চাহিদা নিয়ে উদ্বিগ্ন।  পরিবার বিষয়ে উপদেষ্টা হিসেবে খ্যাত হওয়া সত্ত্বেও রাহিমি-দম্পতি সন্তানদের পারিবারিক সমস্যার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন না। কারণ এতে তারা নিজ সন্তানের পক্ষে সক্রিয়-এমন অভিযোগ উঠতে পারে। তবে তারা পুত্রবধূর সঙ্গে পুত্রের বিরোধ মিটাতে একজন মধ্যস্থতাকারী খুঁজছেন।  

অনু-পরিবার তথা ক্ষুদ্র পরিবার শিল্প-কারখানা ভিত্তিক সমাজের ফসল। এ ধরনের পরিবারেও স্নেহ-মায়া-মমতার ঘাটতি নেই। ইরানের ৬০ শতাংশ পরিবারই অনু-পরিবার। এ ধরনের পরিবারের সন্তানরা সাধারণত বিয়ে করেন পূর্ব-পরিচিত কারো প্রতি অনুরাগ বা আকর্ষণের ভিত্তিতে। তবে সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থাও যাচাই-বাছাই করা হয় বিয়ের আগে। অনু-পরিবারগুলো একই ধরনের পণ্য উৎপাদনের ইউনিট নয় বলে বিয়ের বর কনে বাছাইয়ের বিষয়ে সাধারণত ব্যক্তির অনুরাগ ও আকর্ষণই বেশি গুরুত্ব পায়।

ইসলামের দৃষ্টিতে সামাজিক ঐক্য পরিবারের দম্পতিগুলোর ঐক্য ও সংহতির ওপর নির্ভর করে। এ ধর্মের দৃষ্টিতে পরিবারের বুনিয়াদ হওয়া উচিত আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও শিক্ষা-ভিত্তিক, বস্তুবাদ ভিত্তিক নয়।  মুসলিম পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে জাঁকজমক ও ইসলামী রীতি-নীতির প্রতি উদাসীনতা কাম্য নয়।

ইরানের ইসলামী পরিবারগুলোয় নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নানা শিক্ষার ব্যাপক চর্চাও দেখা যায়। যেমন, একজন শহীদ স্বামীর স্ত্রী বলছিলেন, অন্যরা খাওয়া শুরু করা সত্ত্বেও তার স্বামী খাবারের মজলিসে স্ত্রীকে বাদ দিয়ে কখনও একাকী খাওয়া শুরু করতেন না। অন্য এক শহীদের স্ত্রী বলছেন, একবার তিনি তার স্বামীর  বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার কারণে তার কাপড় ধোয়ার উদ্যোগ নিয়ে গিয়ে দেখেন স্বামী প্রচণ্ড শীতের মধ্যে বরফ-শীতল পানিতে কাপড় ধুচ্ছেন! স্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করলে স্বামী বললেন যে তুমি বাবার বাড়িতে কাপড় ধোয়ার মেশিনে কাপড় ধুতে অভ্যস্ত ছিলে! আমি দুঃখিত যে তোমার জন্য তার ব্যবস্থা করতে পারিনি! তাই এমন শীতের মধ্যে তুমি শীতল পানিতে...-এ পর্যন্ত বলতেই তার স্ত্রী বললেন, আমি তো স্বেচ্ছায় এ কাজ করছি! তুমি যে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করছ এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ