জানুয়ারি ৩০, ২০২২ ২৩:৩১ Asia/Dhaka

ইরানে আসার আগে অনেক কথা শুনেছিলাম। কিন্তু ইরানের যেটুকু দেখেছি তাতে দেশটি নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠতে পারে এমন কিছু দেখিনি। রেডিও তেহরানকে দেয়া ইরান সফর সম্পর্কে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বাংলাদেশের সাবেক নির্বাচন কমিশনার, বিশিষ্ট লেখক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, শুনেছিলাম যে ইরানে মহিলাদের ওপর খুব নিপীড়ন করা হয়। সেখানে অনেক কড়াকড়ি রয়েছে মহিলাদের ওপর। কিন্তু আমরা সেরকম কিছুই দেখিনি। বরং ইরানে নারীদের চলাফেরা, পোশাক, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তাদের সংখ্যা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। 

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

শ্রোতা/পাঠক বন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান 'আলাপনে' আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো ও সুস্থ আছেন। 

সুন্দর প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরপুর, ইতিহাস আর ঐহিত্যের লীলাভূমি ইরান ভ্রমণের সাধ নিশ্চয়ই আপনাদের সবার মাঝেই আছে। কিন্তু তাতো আর সবার পক্ষে হয়ে ওঠে না নানা কারণে।

ইরান ভ্রমণের সাধ ছিল প্রায় ৪০ বছরে ধরে একজন ঋদ্ধ মানুষের। তিনি হচ্ছেন- বাংলাদেশের সাবেক নির্বাচন কমিশনার, বিশিষ্ট লেখক, অব.ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের।  অবশেষে ২০১৯ সালের ১৭ জুন তিনি ইরান ভ্রমণে আসেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে দারুণ একটা বইও লিখেছেন। বইটির নাম- 'ইরান যেমন দেখলাম'। আমরা বিশিষ্ট এই গুণীজনের ইরান ভ্রমণ নিয়ে কয়েক পর্বে কথা বলব। আপনারাও আমাদের সাথেই থাকবেন। তো চলুন আজ শোনা যাক ড. সাখাওয়াত হোসেনের ইরান ভ্রমণের প্রথম পর্ব।

জনাব ড. এম সাখাওয়াত হোসেন রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: জনাব ড. এমন সাখাওয়াত হোসেন দীর্ঘ চল্লিশ বছর অপেক্ষার পর আপনার মনের ভেতরে থাকা ইরান ভ্রমণের সাধ বাস্তবে রুপ নিয়েছিল ২০১৯ সালের মাঝামাঝি। নিশ্চয়ই যখন আপনি ইরানে পা রাখলেন তখন অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিল। ইরান নিয়ে তো আপনি অনেক কথাই শুনেছেন ইরান ভ্রমণের আগে। তো শুরুতেই আপনার কাছে জানতে চাইব- কেমন দেখলেন আপনি ইরান?

রামসার , ইরান

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: দেখুন, আমি ইরান ভ্রমণ করেছি একজন পর্যটক হিসেবে। ইরান দেখার সাধ ছিল দীর্ঘ দিনের যা আমি আমার বইয়ে লিখেছি। তবে ইরান ভ্রমণে এলেও গোটা ইরান দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি আর নয়ও। আমি ইরানের কিছু অংশ দেখেছি। দেখেছি কয়েকটি বড় শহর। কাস্পিয়ান সি, রামসার পর্যন্ত গিয়েছিলাম। যেহেতু সড়ক পথেই আমরা পুরো ভ্রমণটা করেছি সে কারণে রাস্তার ধারের ছোট ছোট অনেক শহরে থেমেছি। সেসব শহরের মানুষ জনের সাথে কথাবার্তা হয়েছে। কোথাও কোথাও দুপুরের এবং রাতের খাবার খেয়েছি। কখনও কখনও চা খাওয়ার জন্য থেমেছি। পুরো সড়ক পথে এত লম্বা একটা ভ্রমণে আমার চোখে এমন কিছু পড়েনি কিংবা এখানকার পত্রপত্রিকায় দেখিনি যে ইরান নিয়ে খুব বড় প্রশ্ন উঠতে পারে। অথচ ইরানে আসার আগে অনেক কথা শুনেছিলাম!

অনুপম সুন্দর ইরান

ইরান ভ্রমণে আমাদের সাথে বাংলাদেশি যাঁরা ছিলেন তার মধ্যে একজন ছিলেন ফার্সি খুব ভালো করে জানেন, বুঝেন এবং বলতে পারেন। তিনি ইরানে বিয়ে করেছেন। কাজেই কোথাও কারও সাথে কথাবার্তা বলতে আমাদের খুব একটা সমস্যা হয়নি। আমি আগেই বলেছি বড় ছোট মিলিয়ে বেশ কিছু শহর আমরা দেখেছি। আমার বইয়ে আমি লিখেছি, ইরান সম্পর্কে যে ধরনের নেতিবাচক কথাবার্তা শুনেছি, দেশটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে যা আগে জেনেছিলাম সেইরকম কোনো কিছু আমরা দেখিনি। আমরা শুনেছিলাম যে ইরানে মহিলাদের উপর খুব নিপীড়ন করা হয়। রাস্তাঘাটে নারীদের চলাচলের সময় নিপীড়ন করা হয়। সেখানে অনেক কড়াকড়ি রয়েছে মহিলাদের উপর। কিন্তু আমরা সেরকম কিছুই দেখিনি।

রেডিও তেহরান: ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, ইরান দেখার সময় আপনি এখানকার নারীদের দেখেছেন। তবে ইরানে আসার আগে আপনি শুনেছিলেন এখানে মহিলাদের উপর খুব নিপীড়ন করা হয়। কিন্তু আপনার ভ্রমণের সময় তেমনটি চোখে পড়েনি বলে জানালেন। তো আপনি এখানে আসার পর নারীদের কেমন দেখলেন? মানে নারীদের অধিকার সম্পর্কে আপনি কি দেখেছেন?

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: দেখুন, আমি খুব খোলামেলাভাবে স্পষ্ট করে বলতে চাই- আমরা পড়েছিলাম বা শুনেছিলাম ইরানি নারীদের বাইরে বের হতে গেলে হাতের নখ, পায়ের নখ পর্যন্ত দেখা যাবে না। এধরনের নানা কথা শুনেছি। কিন্তু আমরা যখন ইরান সফরে এলাম তখন এসবের কিছুই দেখিনি। আমরা তো কখনও কখনও রাত বারোটা একটা পর্যন্ত বাইরে কাটিয়েছি। কারণ আবহাওয়া খুব ভালো ছিল। গরমের সময় ছিল। বিকেলের দিক থেকে একটু ঠাণ্ডা হতে শুরু করত। অত রাত পর্যন্ত আমরা তরুণীদের দেখেছি বের হতে। তাদেরকে দেখেছি আইসক্রিম কর্ণারে। ইরানের অধিকসংখ্যক নারীকে গাড়ি চালাতে দেখেছি। আমি একা নই আমার ভ্রমণসঙ্গীদের সবাই খুব আশ্চর্য হয়েছি এমন দৃশ্য দেখে।

আমার কাছে মনে হয়েছে, শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ নারীকে বাইরে বের হতে দেখেছি। মেয়েদেরকে দেখেছি- রাস্তাঘাটে, বাজারে, বিনোদন কেন্দ্রে এবং প্রসাধনীর দোকানে। এখানে প্রচুর প্রসাধনীর দোকান রয়েছে। আমি নিজে গিয়েছি কসমেটিকস'র দোকানে একটি সুনির্দিষ্ট পারফিউম খুঁজতে। সেদিন এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল-যা বলা ঠিক হবে কি না জানি না! আমরা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না। তখন একজন নারী ট্যাক্সিচালক আমাদেরকে মার্কেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। তিনি যখন শুনলেন যে আমারা বিদেশি। বাংলাদেশ থেকে ইরান ভ্রমণে এসেছি তখন আমাদেরকে নির্দিষ্ট মার্কেটে পৌঁছি দিলেন এবং কোনো টাকা নিলেন না। ফলে ইরানে নারী ট্যাক্সিচালকও দেখেছি। নারী ট্যাক্সিচালক কেবল নারী প্যাসেঞ্জার নিয়ে থাকেন কিন্তু আমরা বিদেশি হওয়ায় এবং ট্যাক্সি না পাওয়ার কারণে তিনি আমাদের সহযোগিতা করলেন। শুধু তাই না নারীদের পোশাক পরিচ্ছদ খুবই আধুনিক। তাঁরা হাইহিল পরছেন, জিন্স পরছেন। তবে এসব পোশাকের উপরে চাদর জড়ানো। মাথায় হিজাব পরা। যেকোনো মুসলিম দেশে এধরনের পোশাক দেখা যায়। এ সম্পর্কে আমি বিস্তারিত আমার বইয়ে লিখেছি।

রেডিও তেহরান:  ড. এম সাখাওয়াত হোসেন আপনি –আপনার ভ্রমণ কাহিনীতে ইরানে নারীদের চলাফেরা, পোশাক, কর্মক্ষেত্র নিয়েও লিখেছেন এবং সে সম্পর্কে বিরতির আগে বলছিলেন। যদি বিষয়টি সম্পর্কে আরও কিছু বলেন।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: শুধু পোশাক নয় কিংবা চলাফেরা নয়- চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা অনেক। ডাক্তার, নার্স, অফিস আদালত সর্বত্র নারী ব্যাপক সংখ্যায় আছেন। যখন অফিস ছুটি হয় তখন দেখেছি বহু নারী কর্মক্ষেত্র থেকে বের হচ্ছেন। আমি এখানকার মানুষের কাছে শুনেছি এবং আমার অনুমান শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ নারী কাজ করেন বিভিন্ন সেক্টরে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেছি নারীদের। হামেদানসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রচুর নারী শিক্ষার্থী দেখেছি। এখানে মহিলাদের সাথে কথা বলে দেখেছি তাঁরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। মার্কেটে দুচারজন নারীর সাথে কথা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলছি। শেখ সাদি'র মাযারে গিয়েছিলাম। কিছু বই কেনার ইচ্ছে হলো। গেলাম বইয়ের দোকানে। সেখানে দেখলাম দোকানগুলোতে সব মহিলা বিক্রেতা। তাঁরা অত্যন্ত বিনয়ী, সুন্দরী এবং খুবই ভালো। তাদের শিক্ষা নিয়ে আমি দু একজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। জানলাম তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। এক দোকানে বই কেনার সময় বিক্রেতা মেয়েটির সাথে কথা হচ্ছিল ইংরেজিতে। মেয়েটি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্সি সাহিত্যে পড়াশুনা করেছে। আমার কেনা বইটির উপর সে নিজেও একটি কবিতা লিখে দিল। মেয়েদের এমন স্বাধীনভাবে শালীন পোশাকে চলাফেরা দেখে আমি খুবই বিস্মিত হয়েছি। হয়তো বিপ্লবের পরপরই কিছু কড়াকড়ি ছিল। তবে পশ্চিমারা ইরানকে নিয়ে নানা কথা প্রচার করে আসছে! তারা বলছে ইরানে নারী স্বাধীনতা নেই! 

এখন নারী স্বাধীনতা বলতে আসলে কি বোঝায়? নারী স্বাধীনতা বলতে যদি বিকিনি পরে বেড়ানোকে বোঝানো হয় সেটি অন্য বিষয়! তবে নারী স্বাধীনতা বলতে আমি যেটি বুঝি সেটি হচ্ছে, তাদের কর্মক্ষেত্র, চলাফেরা, লেখাপড়া, উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ, বিভিন্ন পেশায় বিচরণ করা। আর সেক্ষেত্রে আমি দেখেছি ইরানের নারীরা অনেক এগিয়ে। কেউ মিনি স্কাট পরলো কি  পরলো না সেটা তো স্বাধীনতার মাপকাঠি কিংবা সবদেশের সংস্কৃতি  হতে পারে না। সেটা দিয়ে তো বিচার করা যাবে না। আমি ইরানের নারীদের যেভাবে দেখেছি তাতে সত্যিই আমি ইম্প্রেস এবং খুব বিস্মিত হয়েছি।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। ইরান ভ্রমণ নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আর শ্রোতা/পাঠক বন্ধুরা! এতক্ষণ আপনারা ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের কথার মধ্য দিয়ে ইরান ভ্রমণ করলেন। আগামী সপ্তায় তিনি তাঁর ইরান ভ্রমণের আরও অনেক অভিজ্ঞতা আপনাদেরকে শুনাবেন। সে আসরেও আমাদের সাথে থাকতে ভুলবেন না। সবাই ভালো থাকবেন।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ