ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২২ ১৭:০১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ফাতহ 'র ১ম পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ১ থেকে ৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। ষষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর সূরা ফাতহ নাজিল হয়। ওই বছর বিশ্বনবী (সা.) ও মদিনার মুসলমানদের একটি বিশাল অংশ ওমরাহ করার জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু মুশরিকরা মক্কার নিকটবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে মুসলিম কাফেলার গতিরোধ করে এবং মক্কায় প্রবেশ করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এই সূরার ১-৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

إِنَّا فَتَحۡنَا لَكَ فَتۡحٗا مُّبِينٗا (1) لِّيَغۡفِرَ لَكَ ٱللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِن ذَنۢبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعۡمَتَهُۥ عَلَيۡكَ وَيَهۡدِيَكَ صِرَٰطٗا مُّسۡتَقِيمٗا (2) وَيَنصُرَكَ ٱللَّهُ نَصۡرًا عَزِيزًا (3)

“নিশ্চয় আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়।” (৪৮:০১)

“যেন আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যত ত্রুটিসমূহ [যা কাফিররা আপনার সম্পর্কে রটিয়েছে তা] মার্জনা করেন এবং আপনার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন। আর আপনাকে সরল পথের হেদায়াত দেন। ” (৪৮:০২)

“আর আল্লাহ আপনাকে প্রবল পরাক্রান্ত সাহায্য দান করেন।” (৪৮:০৩)

এই আয়াতগুলোতে হুদায়বিয়ার সন্ধিকে ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ের প্রেক্ষাপট হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ, এতদিন কাফিররা মুসলমানদের ধ্বংস করতে চেয়েছে এবং তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার দিতেই কাফিররা নারাজ ছিল। কিন্তু হুদায়বিয়ার সন্ধিতে কাফিররা মুসলমানদের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে এবং এর দুই বছর পর অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে।

বস্তুত, বিশ্বনবী (সা.)-এর আবির্ভাবের ফলে জাহেলি যুগের অন্যায় ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন রীতিনীতিগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ইসলামি শিক্ষা অনুযায়ী উঁচু-নীচুর মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার অবসান হয় এবং সব বর্ণ ও গোত্রের মানুষ এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর সমান মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়।

অবশ্য মূর্তিপূজা ও জাহেলি যুগের অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিশ্বনবীর চূড়ান্ত সংগ্রাম কাফির নেতাদের পছন্দ হয়নি। তাদের পক্ষে এ বিষয়টি মেনে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এ কারণে জাহেলি সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটিয়ে সমাজে একটি আমূল পরিবর্তনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) যে চেষ্টা করছিলেন সেজন্য তাঁকে গোনাহগার বলে মনে করত মক্কার কাফিররা।

সংক্ষেপে একথা বলা যায় যে, হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও এর ধারাবাহিকতায় মক্কা বিজয়ের ফল ছিল এই যে, প্রচলিত আরব সমাজে প্রচলিত জাহেলি যুগের সংস্কৃতির বিলোপ ঘটে। রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা ও মদিনায় ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। গোত্রে গোত্রে বংশ পরম্পরায় চলে আসা সংঘাতগুলোর অবসান ঘটে এবং সমাজের সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- যেকোনো বিষয়ে বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়ার অর্থ পরবর্তী সময়ের জন্য সাফল্যের বীজ বপন করে রাখা। শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয় সব সময় যে জিহাদের মাধ্যমে আসবে তা নয়। কখনও কখনও শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পরবর্তীতে বিজয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়।

২- আমরা যদি সবাই যার যার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হই এবং লক্ষ্যে পৌঁছার প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা না করি তাহলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের কাজকে এতটা সহজ করে দেবেন যাতে আমরা ওই প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি।

৩- মহানবী (সা.) শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ কিংবা শান্তি যা-ই করুন না কেন তা তিনি করেন এক আল্লাহর নির্দেশ ও দিকনির্দেশনায়। আল্লাহর রাসূল নিজের নফসের ইচ্ছায় কোনো কাজ করেন না।

সূরা ফাতহ ৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

هُوَ ٱلَّذِيٓ أَنزَلَ ٱلسَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ لِيَزۡدَادُوٓاْ إِيمَٰنٗا مَّعَ إِيمَٰنِهِمۡۗ وَلِلَّهِ جُنُودُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمٗا (4)

“তিনিই মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেছেন যেন তারা তাদের ঈমানের সাথে ঈমান বৃদ্ধি করে নেয়। আর আসমানসমূহ ও যমীনের বাহিনীসমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ হলেন সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (৪৮:০৪)

হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে বেশিরভাগ মুসলমান মক্কায় উপস্থিত হয়ে ওমরাহ করতে না পারায় নিজেদেরকে পরাজিত মনে করার পাশাপাশি মনোক্ষুণ্ন ও বিষন্ন ছিলেন। কিন্তু এই সূরা নাজিল করে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ভবিষ্যতে বিজয়ের সুসংবাদ দিলে তাদের অন্তর শান্ত হয় এবং মহানবীর বাণী ও তাঁর প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তাদের ঈমান শক্তিশালী হয়। স্বাভাবিকভাবেই যে ব্যক্তি বিশ্বজগতকে আল্লাহ তায়ালার সুচিন্তিত নিয়মের অধীন মনে করে এবং আসমানসমূহ ও জমিনের সকল সৃষ্টিকে আল্লাহর বাহিনী বলে বিশ্বাস করে তার মধ্যে কখনও পরাজয়ের অনুভূতি আসে না। শত্রু  যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন এরকম বিশ্বাসী মানুষ তাদেরকে ভয় পায় না।

এই আয়াতের তিনটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

১- মুমিনদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার একটি দয়া হচ্ছে এই যে, তিনি তাদের অন্তরকে প্রশান্ত করেন। অন্যদিকে কাফিরদের তিনি যেসব শাস্তি দেন তার একটি হচ্ছে তাদের অন্তরকে অশান্ত ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ করে রাখেন।

২- ঈমানের যেমন বিভিন্ন স্তর রয়েছে তেমনি মানুষের ঈমানের স্তরের ওঠানামা হয়। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন ঘটনা ও বিপদ-আপদ এমন পরীক্ষা যা ঈমানের স্তরের এই ওঠানামার ওপর প্রভাব ফেলে।

৩- মহান আল্লাহর ক্ষমতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি মনযোগ দিলে এবং বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টিকে আল্লাহর ইচ্ছার অধীন মনে করলে মুমিন ব্যক্তিরা অন্তরে অদ্ভুত প্রশান্তি লাভ করে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ