সুখের নীড়- পর্ব ৩
বিয়ে মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্য যে কোনো বড় কাজের মত বিয়ের জন্যও প্রস্তুতি নেয়া জরুরি।
বিয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হল মানসিক প্রশান্তি লাভ করা। অনেকেই বিয়ের পাত্র পাত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই গুরুত্ব দেন। অথচ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে পাত্রপাত্রীর মধ্যে যদি ব্যাপক ব্যবধান থাকে তাহলে বিয়ের পর তারা সুখ ও নিরাপত্তা অনুভব করবেন না। তবে পাত্র ও পাত্রীর মধ্যে সবগুলো ভালো দিক খুঁজতে যাওয়ার ফল এটা হয় যে পাত্র ও পাত্রীদের বিয়ে অনেক বেশি দেরিতে ঘটে।
অনেকেই কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যকে পাত্র-পাত্রী বাছাইয়ের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে বলেন: যেহেতু আমরা পরস্পরকে ভালবাসি তাই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিষয়ে রুচির পার্থক্য দেখা দিলে পরস্পরের সঙ্গে আপোষ-রফা করব! এ ধরনের কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বা অনেক ক্ষেত্রেই কেবল প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমিত থাকে। বিয়ের পর স্বামী ও স্ত্রী যেন পরস্পরের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আশা না করেন। বিয়ের পর ইতিবাচক পরিবর্তন আসতেও পারে আবার তা সম্ভব নাও হতে পারে। এ বিষয়ে কোনো গ্যারান্টি নেই। বিয়ের আগেই এসব বিষয়ে ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
ধার্মিক পরিবারের ছেলে যদি এমন পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেন যেখানে ধর্মকে মোটেই গুরুত্ব দেয়া হয় না তাহলে তারা পরস্পর সুখি হবেন না -এটাই স্বাভাবিক। বিয়ে করে ফেলার পর জীবনসঙ্গীর জীবন-যাপনের পদ্ধতি বা লাইফস্টাইল ও ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন না আসলেও বা পরস্পরের প্রতি ঘনিষ্ঠতা না আসলেও তখন আর করার কিছুই থাকে না। আর এ জন্যই ইসলাম ধর্ম সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং ইমান ও ধর্মীয় বিষয়ে বর-কনের পরিবার সমকক্ষ বা সমশ্রেণীর কিনা তা বিয়ের আগেই যাচাই করে দেখতে বলে। ইসলাম এ বিষয়টিকে কুফু নামক পরিভাষায় উল্লেখ করে থাকে। অনেকে কুফু বলতে কেবল সম্ভাব্য বর ও কনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদার সমান অবস্থাকে বোঝাতে চান। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে কেবল এসব বিষয়ই কুফু নয়। বরং কুফুর মধ্যে ইমান ও ধর্মীয় বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কুরআনের সুরা নুরের ২৬ নম্বর আয়াতের একাংশে বলা হয়েছে: পবিত্র নারীরা পবিত্র পুরুষের উপযুক্ত, পবিত্র পুরুষেরা পবিত্র নারীর জন্য।–নারী ও পুরুষের এই পবিত্রতা আত্মিক পবিত্রতাও বটে। আল্লাহ, নবুয়্যত, কুরআন ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস আত্মাকে করে পবিত্র এবং এসব বিশ্বাস মানুষকে খোদায়ি গুণ ও স্বভাব-চরিত্রের দিকে আকৃষ্ট করে।
গত পর্বের আলোচনায় আমরা অনু-পরিবার নিয়ে কথা বলেছি। অনু-পরিবার নগর-সভ্যতা ও আধুনিক শিল্প-কারখানা-কেন্দ্রিক সভ্যতা বিকাশের ফসল। এ ধরনের পরিবার ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একান্নবর্তী পরিবারগুলোর সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে।
অনু-পরিবারেরও নানা রূপ রয়েছে। অনু পরিবার বলতে ক্ষুদ্র পরিবার বোঝায়। তবে এমন পরিবারেও যদি স্বামী বা স্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের কেউ মূল পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন তাহলে ওই পরিবারকে বলা হয় সংযুক্ত অনু-পরিবার। এ ধরনের পরিবারের সদস্যরা মূল পরিবার ও মূল পরিবার-প্রধানের অনুসারী হয়ে থাকেন। প্রাচ্যে ও মুসলিম দেশগুলোতে এ ধরনের অনেক পরিবার দেখা যায়। ইরানেও এমন অনেক পরিবার রয়েছে। এ ধরনের পরিবারের অস্তিত্বও সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নানা কারণের ফসল।
আজকাল অনেকেই অর্থনৈতিক সমস্যায় আক্রান্ত অতি বৃদ্ধ বাবা ও মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখেন যা ইসলামের দৃষ্টিতে শোভনীয় নয়। ইসলাম বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করাকে ও তাদের অধিকার পালন করাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় গুরুত্ব দেয়। তাই সংযুক্ত ও যৌথ-পরিবার ব্যবস্থাই ইসলামের দৃষ্টিতে বাবা-মায়ের সেবার জন্য বেশি উপযুক্ত।
ইরানে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে কেবল দুই শতাংশ জনগণ বৃদ্ধাশ্রম বা বয়স্ক আশ্রয় কেন্দ্র চালু রাখার পক্ষপাতী। এ থেকে বোঝা যায় ইরানি পরিবারগুলো এখনও পশ্চিমা আদর্শের প্রতি খুব একটা আকৃষ্ট নয়। পরিবারগুলো ও আত্মীয়-স্বজনের পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা ও যোগাযোগের সুবিধা এবং বয়স্কদের সেবা দেয়ার জন্য যৌথ পরিবার প্রথা বজায় রাখা খুবই জরুরি। সম্মিলিতভাবে ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠান ও উৎসব ও শোক অনুষ্ঠান উদযাপন ইরানে পারিবারিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক রক্ষার প্রথা এখনও টিকিয়ে রাখার সহায়ক হয়েছে। মানুষ যখন অর্থনৈতিক সমস্যাসহ নানা ধরনের সমস্যার শিকার হয় তখন পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের শরণাপন্ন হয়। আর এসব কারণে ইরানে সংযুক্ত পরিবার প্রথাকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
আজকের এ অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে সংসারকে সুখের নীড় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কয়েকটি জরুরি পরামর্শ শোনাব। বাংলাদেশে একটি প্রবাদ বেশ প্রচলিত। আর তা হল সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামও নারী জাতির প্রতি সম্মান জানিয়ে লিখেছেন:
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
-এরই আলোকে বলা যায় নারীর প্রতি সম্মান দেখানো উচিত প্রত্যেক পরিবারের প্রধান তথা স্বামী বা বাবার পক্ষ থেকে। অন্যদিকে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি সম্মান, সহনশীলতা, কৃতজ্ঞতা ও ক্ষমাশীলতা ইসলামী শিক্ষারই অন্যতম মহৎ দিক। কন্যা, জায়া ও জননীর সহায়তা ছাড়া পুরুষরা কখনও সফল পরিবার গড়ে তুলতে পারে না এবং পুরুষদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য মা, বোন ও স্ত্রীর সহায়ক ভূমিকা অপরিহার্য।
স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক সম্মান উভয়েরই আত্মবিশ্বাস বাড়াতে ও পরস্পরের প্রতি অনুরাগ বাড়াতে সাহায্য করে। জীবন-সঙ্গীকে খুশি রাখতে অন্যদের সামনে স্ত্রীর বা স্বামীর ভালো দিকগুলোর বা ভালো কাজ ও গুণের প্রশংসা করুন। পারস্পরিক প্রশংসার কারণে স্বামী-স্ত্রীর ভালো গুণগুলোর বিকাশ ঘটে থাকে। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।