সূরা ফাতহ : আয়াত ২৬-২৯ (শেষ পর্ব-৭)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ফাতহ 'র ৭ম ও শেষ পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ২৬ থেকে ২৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ২৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
إِذۡ جَعَلَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ فَأَنزَلَ ٱللَّهُ سَكِينَتَهُۥ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ وَعَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَأَلۡزَمَهُمۡ كَلِمَةَ ٱلتَّقۡوَىٰ وَكَانُوٓاْ أَحَقَّ بِهَا وَأَهۡلَهَاۚ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا (26)
“(স্মরণ করুন) যখন কাফিররা তাদের অন্তরে পোষণ করেছিল গোত্রীয় অহমিকা [তাও আবার] অজ্ঞতার যুগের অহমিকা। তখন আল্লাহ তাঁর রাসূল ও মুমিনদের উপর স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন; আর তাদেরকে তাকওয়ার বাক্যে সুদৃঢ় করলেন, আর তারাই ছিল এর অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত। আর আল্লাহ্ সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।” (৪৮:২৬)
গত কয়েক আসরে আমরা হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এরপর আজকের এই আয়াতে বলা হচ্ছে, জাহেলি যুগের অহমিকার কারণে মক্কার কাফেররা মদীনা থেকে আগত মুসলমানদের ওমরাহ করার অনুমতি দেয়নি।তারা বলেছিল, এই মুসলমানরা বদর ও ওহুদের যুদ্ধে আমাদের বাবা ও ভাইদের হত্যা করেছে। এখন আমরা কীভাবে মক্কা শহরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে তাদেরকে প্রাণ নিয়ে মদীনায় ফিরতে দেব? অথচ তারা একথা ভালো করে জানত, কাউকে কাবাঘর জিয়ারতে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই এবং মক্কা সকলের জন্য নিরাপদ শহর। এমনকি সে সময়ের রীতি ছিল এই যে, কেউ তার পিতার হত্যাকারীকেও যদি কাবাঘর জিয়ারত করা অবস্থায় দেখতে পেত তাহলেও তাকে কিছু বলত না।
এর বিপরীতে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের অন্তরে এমন প্রশান্তি ঢেলে দিয়েছেন যে, তারা কাবাঘর জিয়ারতের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বিরত থাকতে সম্মত হন যার ফলে পরবর্তী বছরগুলোতে নির্বিঘ্নে হজ্ব করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- জাহেলি যুগের অযৌক্তিক রীতিগুলো পরিহার করতে হবে।
২- ঈমান ও তাকওয়ার দাবিদার ব্যক্তিদেরকে যেকোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং প্রশান্ত চিত্তের অধিকারী হতে হবে।
সূরা ফাতহ ২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
لَّقَدۡ صَدَقَ ٱللَّهُ رَسُولَهُ ٱلرُّءۡيَا بِٱلۡحَقِّۖ لَتَدۡخُلُنَّ ٱلۡمَسۡجِدَ ٱلۡحَرَامَ إِن شَآءَ ٱللَّهُ ءَامِنِينَ مُحَلِّقِينَ رُءُوسَكُمۡ وَمُقَصِّرِينَ لَا تَخَافُونَۖ فَعَلِمَ مَا لَمۡ تَعۡلَمُواْ فَجَعَلَ مِن دُونِ ذَٰلِكَ فَتۡحٗا قَرِيبًا (27)
“অবশ্যই আল্লাহ তাঁর রাসূলের স্বপ্নটি যথাযথভাবে সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল-হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে—মাথা মুণ্ডন করে এবং চুল ছেঁটে, নির্ভয়ে। অতঃপর আল্লাহ [এমন কিছু] জেনেছেন যা তোমরা জানতে না। এ ছাড়াও তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন [খায়বারে] এক অত্যাসন্ন বিজয়।” (৪৮:২৭)
মক্কা রওনা হওয়ার আগে আল্লাহর রাসূল স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি সাহাবীদের নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করে ওমরাহ হজ্ব পালন করছেন। সাহাবীদের কাছে তিনি এ স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেন। একথা শুনে সাহাবীরা ভাবলেন, এই স্বপ্ন বুঝি চলতি বছরই বাস্তবায়িত হবে। এ কারণে মক্কার কাছাকাছি গিয়ে কাফেররা যখন তাদের গতিরোধ করে তখন কারো কারো মনে এই সংশয় তৈরি হয় যে, তাহলে কি রাসূলের স্বপ্নও মিথ্যা হয় যাবে? এরকম পরিস্থিতিতে এই আয়াত নাজিল হয়।তাদেরকে বলা হয় তোমরা নিঃসন্দেহে মসজিদুল হারামে প্রবশে করে নিরাপত্তার সঙ্গে হজ্ব আদায় করতে পারবে। হুদায়বিয়ার সন্ধি অনুযায়ী মদীনার মুসলমানরা পরের বছর অত্যন্ত নিরাপত্তা ও প্রশান্তির সঙ্গে তিন দিন ধরে আল্লাহর ঘর জিয়ারত করেন।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুতি অবশ্যই সত্য। কখনও কখনও নিজ প্রজ্ঞা অনুযায়ী তিনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সময় পিছিয়ে দেন। তাই বলে আমাদের মনে যেন আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো সংশয় সৃষ্টি না হয়।
২- শত্রুর ভয়ে নয় বরং সমাজের কল্যাণে যে শান্তি চুক্তি করা হয় তার উপকার অনেক বেশি। এমনকি এ ধরনের অপমানজনক চুক্তির ফলে পরবর্তী সময়ে কাফিরদের ওপর বিজয়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়।
সূরা ফাতহ ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
هُوَ ٱلَّذِيٓ أَرۡسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلۡهُدَىٰ وَدِينِ ٱلۡحَقِّ لِيُظۡهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦۚ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ شَهِيدٗا (28)
"তিনিই তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, অন্য সমস্ত দ্বীনের উপর একে জয়যুক্ত করার জন্য। আর [এ ব্যাপারে] সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।”
আগের আয়াতে মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: এই বিজয় চলতে থাকবে এবং এমন একদিন আসবে যেদিন বিশ্বব্যাপী অন্য সব ধর্মের উপর ইসলাম বিজয়ী হবে। কারণ, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং তিনি মানুষকে সৌভাগ্যের পথনির্দেশ করেন।
হাদিসে এসেছে, শেষ জামানায় রাসূলের বংশধরদের মধ্য থেকে ‘মাহদি’ নামের এক ব্যক্তির হাতে আল্লাহ তায়ালার এই প্রতিশ্রুতি সত্যে পরিণত হবে। তিনি বিশ্বের নির্যাতিত ও মজলুম জনগোষ্ঠীর সহযোগিতায় অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। ইমাম মাহদি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে অত্যাচারীদের পরাস্ত করবেন এবং সারা বিশ্বে ন্যায়, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করবেন।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আল্লাহর ইচ্ছায় একদিন গোটা বিশ্বে সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হবে। সেদিন সকল মানুষের হেদায়েতের পথ উন্মুক্ত হবে।
২- অতীতের ঐশী ধর্মগুলো ছিল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ। কিন্তু ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট সময়ের ধর্ম নয়। কাজেই ইসলাম একদিন গোটা বিশ্ববাসীর ধর্মে পরিণত হবে। এ কারণে মুসলমানদেরকে তাদের দ্বীনি কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামের প্রকৃত ভাবমর্যাদা তুলে ধরতে হবে।
এবারে সূরা ফাতহের শেষ আয়াত অর্থাৎ ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ تَرَىٰهُمۡ رُكَّعٗا سُجَّدٗا يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗاۖ سِيمَاهُمۡ فِي وُجُوهِهِم مِّنۡ أَثَرِ ٱلسُّجُودِۚ ذَٰلِكَ مَثَلُهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِۚ وَمَثَلُهُمۡ فِي ٱلۡإِنجِيلِ كَزَرۡعٍ أَخۡرَجَ شَطَۡٔهُۥ فََٔازَرَهُۥ فَٱسۡتَغۡلَظَ فَٱسۡتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِۦ يُعۡجِبُ ٱلزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ ٱلۡكُفَّارَۗ وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِنۡهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمَۢا (29)
“মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল; আর তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর ও নিজেদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবেন।তাদের লক্ষণ তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার প্রভাবে পরিস্ফুট; এটাই তাওরাতে তাদের দৃষ্টান্ত। আর ইঞ্জীলে তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন একটি চারাগাছ, যা থেকে নির্গত হয় কচিপাতা, তারপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা চাষীদের জন্য মনোমুগ্ধকর। এভাবে আল্লাহ বিশ্বাসীদের (সমৃদ্ধি দ্বারা) অবিশ্বাসীদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। (তবে) কাফেরদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে, আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের।”
এই আয়াতে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় শর্তগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: অন্যান্য ধর্মের ওপর ইসলামের বিজয়ের জন্য মুসলমানরা তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন এই চারটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ঢেলে সাজাবে:
এক- শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদেরকে অত্যন্ত কঠোর হতে হবে।
দুই- ঈমানদারদের মধ্যে সম্পর্ক হবে ভালোবাস, হৃদ্যতা ও সহানুভূতির।
তিন- আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক হবে ইবাদত-বন্দেগির।
এবং
চার- নিজেদের কর্তব্য হবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করার জন্য সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা চালানো।
মুসলামানরা যদি এ বিষয়গুলোকে তাদের জীবন পরিচালনার মাণদণ্ড বানাতে পারে তাহলে তারা শুধু পার্থিব জীবনে শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে তাই নয় সেইসঙ্গে কিয়ামতের দিন আল্লাহর ক্ষমা ও পুরস্কার লাভ করতে পারবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে এখানে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা রয়েছে।
২- আল্লাহর রাসূলের সুন্নত অনুসরণ এবং কঠিন ও সুদৃঢ় ঈমানের অধিকারী মানুষদের ছাড়া বিশ্বব্যাপী ইসলামকে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়।
৩- তাওরাত ও ইঞ্জীল গ্রন্থেও রাসূলের সাহাবীদের মুখমণ্ডলের বর্ণনা এসেছে।
এবং
৪- মুসলমানদের সংখ্যা ও গুণগত মান বৃদ্ধিতে ইসলামের শত্রুদের অন্তরে গাত্রদাহ সৃষ্টি হয়। #
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।