নির্বাচন কমিশন গঠনে 'তদবির' হচ্ছে
'সার্চ কমিটিকে নাম দেওয়া নিয়ে তামাশা হয়েছে'
বাংলাদেশের বর্তমান সার্চ কমিটি এবং নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ার বিষয়টি আসলে দৃষ্টিভঙ্গির। কে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখছেন সেটি একটি বিষয়। তবে সিটিং সরকার সবসময় নিজেদের প্রভাবের মধ্যে রেখে নির্বাচন কমিশন গঠনের চেষ্টা করে থাকে। ফলে সার্চ কমিটি কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে নির্বাচন কমিশনে শেষ দশজনে কাঁদের নাম আসবে তা এখন বলা সম্ভব নয়! অপেক্ষা করতে হবে।
রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, অব. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ১২ টি নির্বাচন কমিশন কাজ করেছে। তারমধ্যে চারটি ছাড়া বাকি সব কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে সর্বশেষ দুটি নির্বাচনের একটি ব্যর্থ এবং অন্যটি জালিয়াতিপূর্ণ হয়েছে একথা বলেছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা-আমার কথা নয়।
তিনি আরো বলেছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবারের কমিশন গঠনে যেসব নাম এসেছে তাতে তামাশা সৃস্টি হয়েছে। আরো দুঃখজনক হচ্ছে কমিশনে থাকার জন্য 'তদবির' হচ্ছে।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, বাংলাদেশে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি করা হয়েছে কিন্তু এই কমিটি নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। বিএনপি বলেছে, সরকারপন্থি লোকজন দিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকার বলছে এটি যথাযথভাবে হয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: দেখুন, এটি দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। কে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখছেন তার দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার।
বাংলাদেশে যখন যে সিটিং সরকার এসেছে তারা যা করবে তা তাদের প্রভাবের মধ্যে রেখেই করবে। যেমন ধরুন এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে আগে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল-সবার ক্ষেত্রে একই চিত্র। তারা নিজেদের প্রভাবের মধ্যে রেখে সবকিছু করার চেষ্টা করবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানে বিচারপতিরা আছেন, এখানে কনস্টিটিউশনাল পোস্টের দুজন আছেন- তাঁদেরকে বলা হয় যে নিরপেক্ষ। এখন যদি কেউ নিরপেক্ষ নাও হয় তারপরও কোথায় যখন কোনো দায়িত্বে থাকবেন তখন যদি তিনি নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করেন সেটি কিন্তু অনেক বড় বিষয়। আপাতত তো বিশ্বাস রাখতেই হবে। একটা আইন হয়েছে। অবশ্য সেই আইনের মধ্যে ফাঁক-ফোকর অনেক রয়েছে। তারপরও এখন তারা একটা কাজ করছে। কোথা থেকে কিভাবে ৩২২ টি নাম প্রকাশ করেছে। কিন্তু যেটা প্রকাশ করতে হবে সেটি হচ্ছে সবশেষ যে দশজনের নাম তারা প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠাবেন সেটি। কিন্তু সেটি প্রকাশ করা হবে কি না সেটি একটি বড় বিষয় এবং প্রশ্ন! এটি তাদের এখতিয়ারের মধ্যেই আছে। তাঁরা যদি সেভাবে বিধি তৈরি করে যে দশজনের নাম প্রকাশ করা হবে। সেটি প্রকাশ করা হলে বোঝা যাবে তারা আন্তরিকভাবে কাজ করছে কি না কিংবা চেষ্টা করছে কি না? তবে আমি তাদের সাথে কথা বলে যেটা বুঝলাম যে তারা মোটামুটি জানে যে তারা বিতর্কিত হয়েছেন।গতবারও হয়েছেন এবারও...। হয়তো তারা চেষ্টা করবেন সেই বিতর্কের উর্ধ্বে উঠতে। তবে বিষয়টি সেই পর্যায়ে না আসা এবং না দেখা পর্যন্ত এখনই বলা খুবই মুশকিল যে তারা সরকারের পক্ষে কাজ করছে নাকি তারা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করছে! দেখুন গতবার নাম দিয়েছিলাম। কিন্তু কিভাবে কি হয়েছিল তা তো ঠিক জানিনা।
রেডিও তেহরান: ড. সাখাওয়াত হোসেন-অপেক্ষার কথা বললেন, জ্বি অপেক্ষা তো করতেই হবে; তবে সার্চ কমিটি এখন পর্যন্ত যেসব কাজ করেছে তাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন এবং এই কমিটির সফলতার সম্ভাবনার বিষয়টি যদিও হাইপোথিটিক্যাল প্রশ্ন তো দেখছেন; কেমন বলে আপনি মনে করছেন?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: দেখুন আমি বলব, তাঁরা যদি আন্তরিক হয় এবং বিষয়টি তারা বুঝতে পারে যে কি ধরনের লোক প্রয়োজন নির্বাচন কমিশনার হওয়ার জন্য তাহলে সেটি হবে ভালো একটা বিষয়। কারণ আমার মতে এর আগের দুটি নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। দুটি নির্বাচন ব্যর্থ হয়েছে। একটি পুরোপুরি ব্যর্থ অপরটি জালিয়াতির নির্বাচন হয়েছে। আন্তর্জাাতিক বিশেষজ্ঞরা একথা বলেছেন-আমার কথা নয়। কাজেই আন্তর্জাতিকভাবে গত দুটি নির্বাচনকে সেভাবে গ্রহণ করা হয় নি। এখন তৃতীয় নির্বাচনও যদি সেরকম হয় তাহলে দেশে একটা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ হয়ে উঠেছে। সেই দেশটিতে যদি আবারও একটা ব্যর্থ নির্বাচন হয় এবং সেটা সরকার গঠিত হয় আর তা নিয়ে যদি গন্ডোগোল গোলোযোগ শুরু হয় তাহলে সেটি তো ভালো কোনো সাইন হবে না। আর সেজন্য আমি মনে করি যে, তাঁদের এই কথাটা চিন্তা করতে হবে। আমাকে যখন ডাকা হয়েছিল আমি সুস্পষ্টভাবে সবার সামনে বিষয়টি তুলে ধরেছি। আমি বলেছি, ৩২২ টি নাম আপনারা পেয়েছেন এটি সবকিছু নয়; এখানে দেখার বিষয় কারা নির্বাচন কমিশনার হলে নির্বাচনকে সুস্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
দেশের ১৭ লক্ষ মানুষকে নিয়ে নির্বাচন হবে-তাদের বিষয়টি দেখতে হবে, সরকারকে ট্যাকেল্ড করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে ট্যাকেল্ড করতে হবে। কাজেই এখানে যেখান সেখান থেকে নাম আসল আর যেকোনোভাবে কটা নাম উঠিয়ে দিয়ে দিলেন-তাতে ভালো কিছু হবে না। এখানে দরকার খুবই বিচক্ষণতার। না বুঝে এই অমুক সেই অমুক এসব ভেবে ব্যক্তি নির্ধারণ করলে কোনো কাজ হবে না। অনেক সময় দেখা গেছে খুব ভালো অ্যাডমিনিস্ট্রেটরও সেখানে কাজ করতে পারেন নি, ব্যর্থ হয়েছেন। কাজেই দেখতে হবে কে কাজটি করতে পারবে। দেখুন এখানে নাম আছে চলচ্চিত্র জগতের মানুষে, আরও ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষের। এখানে একটা তামাশা সৃষ্টি হয়েছে। যারা সিলেক্ট করছেন তাদের জন্য বড় একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে 'তদবির' হচ্ছে। এই প্রথম শুনলাম এমন কথা। এসব যদি হয় তাহলে কিভাবে তারা একটা ভালো কমিশন দাঁড় করাতে পারবে আমি জানি না!
রেডিও তেহরান: ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সার্চ কমিটির প্রস্তাবের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা বলা হলেও চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবেন প্রেসিডেন্ট। যে কথাটিও আপনিও বললেন। তো এখানে প্রেসিডেন্ট তো দলীয় ব্যক্তি। সেক্ষেত্রে কতটা নিরপেক্ষ হতে পারে নির্বাচন কমিশন?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: দেখুন, সে কারণেই বলা হচ্ছে যে ফাইনাল যে দশটি নাম সার্চ কমিটি প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠাবেন সেটি যেন প্রকাশ করা হয়। এমন একটি দাবি উঠেছে। আর সেই দাবি সার্চ কমিটি কতখানি রাখতে পারবে কতখানি পারবে না সেটি এখনই বলা সম্ভব না।
রেডিও তেহরান: ড.এম সাখাওয়াত হোসেন আপনি সাবেক নির্বাচন কমিশনার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এখন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে এই যেসব বিতর্ক ও কর্মকাণ্ড চলছে তা কী কাঙ্ক্ষিত বলে আপনি মনে করেন?
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: না, কাঙ্ক্ষিত না। এ পর্যন্ত বারোটি নির্বাচন কমিশন ছিল।দুভার্গ্যজনকভাবে এরমাধে চারটি ছাড়া বাকি সবগুলো নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। আর ব্যর্থ এই হয়েছে এই কারণে যে আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাতে যেভাবে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সহযোগিতা করা দরকার সেই ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। এটি একটি বড় বিষয়। সে কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা উঠেছে। আমরা বিভিন্ন দেশে দেখছি সিটিং সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে প্রমাণিত যেকোনো দল বলে কথা নয়; যারা ক্ষমতায় ছিল এবং থাকেন তারা যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে। নির্বাচন কমিশনকে তারা সহযোগিতা করে না। ফলে নির্বাচন কমিশন বলা চলে ব্যর্থ হয়। নির্বাচন কমিশনও সেরকম শক্ত অবস্থানে থাকতে পারে নি।
তো জনাব ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশ সর্বসাম্প্রতিক ইসি গঠন নিয়ে সার্চ কমিটির কর্মকাণ্ড, বিরোধীদলগুলোর অভিযোগ সমালোচনা এবং সরকারি দলের বক্তব্য-সামগ্রিক বিষয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৯