ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২ ১৭:৪৪ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা হুজুরাতের ২য় পর্ব নিয়ে আলোচনা। সূরা হুজুরাতের সংক্ষিপ্ত তাফসির। মদীনায় অবতীর্ণ এই সূরায় মূলত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আচার-আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরায় বর্ণিত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করলে সমাজের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব শক্তিশালী হয় এবং না করলে পরস্পরে শত্রুতা, বিদ্বেষ, অমূলক সন্দেহ ও বিভেদ সৃষ্টি হয়। এই সূরার ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ أَن تُصِيبُواْ قَوۡمَۢا بِجَهَٰلَةٖ فَتُصۡبِحُواْ عَلَىٰ مَا فَعَلۡتُمۡ نَٰدِمِينَ (6)

“হে ঈমানদারগণ! যদি কোন ফাসিক তোমাদের কাছে কোন [গুরুত্বপূর্ণ] বার্তা নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা [তা] পরীক্ষা করে দেখ, এ আশঙ্কায় যে, [তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে] অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে বসবে, ফলে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হবে।”  (৪৯:০৬)

আমরা অন্যের কাছ থেকে যেসব খবর পাই তা দুই ধরনের হয়। কোনো কোনো খবরের সঙ্গে আমাদের জীবন বা জীবিকার সম্পর্ক নেই। তবে কোনো কোনো খবরের সঙ্গে আমাদের জীবন ও জীবিকার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ওই খবরের ওপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের করণীয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। এই আয়াতে দ্বিতীয় ধরনের খবরের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: এ ধরনের খবর শোনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে একথা যাচাই করে নিতে হবে যে, খবর প্রদানকারী ব্যক্তি সত্যবাদী নাকি মিথ্যাবাদী? সে ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য খবরটি বর্ণনা করেছে নাকি প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরছে? আমরা যদি এসব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি তাহলে পরবর্তীতে তার ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব নাও হতে পারে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- ঈমানদার ব্যক্তিকে যেকোনো সিদ্ধান্ত গভীর চিন্তাভাবনা করে নিতে হবে। ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।

২- মিথ্যাবাদী বা গোনাহগার ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই। আমরা বিষয়টি যাচাই করে দেখব। কারণ, অনেক সময় মিথ্যাবাদী মানুষও সত্য কথা বলে।

৩- কিছু মানুষ ও গণমাধ্যম সমাজে অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ভুল তথ্য ও গুজব রটিয়ে দেয়। এ ধরনের ক্ষেত্রেও ঈমানদার মানুষ গুজবে কান না দিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করে।

৪- ভুল সিদ্ধান্ত অনুতাপ বয়ে আনে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনুশোচনা করেও কোনো লাভ হয় না কারণ ক্ষতিটি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।

সূরা হুজুরাতের  ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ فِيكُمۡ رَسُولَ ٱللَّهِۚ لَوۡ يُطِيعُكُمۡ فِي كَثِيرٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡرِ لَعَنِتُّمۡ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ حَبَّبَ إِلَيۡكُمُ ٱلۡإِيمَٰنَ وَزَيَّنَهُۥ فِي قُلُوبِكُمۡ وَكَرَّهَ إِلَيۡكُمُ ٱلۡكُفۡرَ وَٱلۡفُسُوقَ وَٱلۡعِصۡيَانَۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلرَّٰشِدُونَ (7) فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَنِعۡمَةٗۚ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ (8)

“আর তোমরা জেনে রাখো যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন [এবং তোমাদেরকে তাঁর আনুগত্য করতে হবে]; তিনি বহু বিষয়ে তোমাদের কথা শুনলে তোমরাই কষ্ট পেতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং সেটাকে তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করেছেন। আর কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে করেছেন তোমাদের কাছে অপ্রিয়। [যারা এসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী] তারাই তো সত্য পথপ্রাপ্ত।”(৪৯:০৭)

“[ঈমানপ্রিয়তা ও কুফরবিমুখতা] আল্লাহর পক্ষ থেকে দান ও অনুগ্রহ; আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (৪৯:০৮)

এই দুই আয়াতে আল্লাহ তায়ালার দু’টি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি হলো- মানবজাতিকে হেদায়েত করার জন্য নবী-রাসূল প্রেরণ এবং দ্বিতীয়টি মানুষের পবিত্র অন্তর বা বিবেক। নবী-রাসূলগণ তাদের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য ও সুস্পষ্ট ঐশী বিধান দিয়ে মানুষকে সৎপথ প্রদর্শন করেন। অন্যদিকে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল তাঁদের মুখনিসৃত বাণীর বাস্তব প্রতিফলন। ঠিক এ কারণে ঈমানদার ব্যক্তিরা নবী-রাসূলদের পূর্ণ আনুগত্য করেন।

অন্যদিকে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এমন প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, ভালো কাজ তার ভালো লাগে এবং খারাপ কাজ তার অপছন্দ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে চোর অন্যের মাল চুরি করে সেও অন্তরে অনুভব করে, কাজটি অত্যন্ত খারাপ ও নিন্দনীয়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- আমরা যদি অনুতপ্ত হতে না চাই তাহলে নিজেদের জীবনে রাসূলের শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে।

২- ভালো কাজের প্রতি আকর্ষণ ও খারাপ কাজের প্রতি ঘৃণা প্রকৃতিগতভাবেই আমাদের মধ্যে দান করেছেন আল্লাহ তায়ালা।

৩- আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের শিক্ষা অনুসরণ এবং নৈতিক অধোঃপতন থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজকে কলুষমুক্ত রাখা সম্ভব।

৪- ঈমান এবং নৈতিক উৎকর্ষ হচ্ছে মানুষের প্রকৃত অলঙ্কার। গাড়ি, বাড়ি কিংবা পোশাকে বাহ্যিক চাকচিক্য হয় ঠিকই কিন্তু তা মানুষের চারিত্রিক বিকাশ ঘটাতে পারে না।

সূরা হুজুরাতের ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَإِن طَآئِفَتَانِ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٱقۡتَتَلُواْ فَأَصۡلِحُواْ بَيۡنَهُمَاۖ فَإِنۢ بَغَتۡ إِحۡدَىٰهُمَا عَلَى ٱلۡأُخۡرَىٰ فَقَٰتِلُواْ ٱلَّتِي تَبۡغِي حَتَّىٰ تَفِيٓءَ إِلَىٰٓ أَمۡرِ ٱللَّهِۚ فَإِن فَآءَتۡ فَأَصۡلِحُواْ بَيۡنَهُمَا بِٱلۡعَدۡلِ وَأَقۡسِطُوٓاْۖ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُقۡسِطِينَ (9)

 “আর দুই দল মুমিনের মধ্যে যুদ্ধ ও বিবাদ দেখা দিলে তোমরা তাদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করে দাও। অতঃপর তাদের একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে, যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা আল্লাহ্‌র নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে, [এবং বাড়াবাড়ি বন্ধ করে] তাহলে তাদের দুই [দলের] মধ্যে ন্যায়ের সাথে সন্ধি স্থাপন কর এবং সুবিচার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালবাসেন।” (৪৯:০৯)

এই আয়াতে আরেকটি সামাজিক ক্ষতির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: কখনও কখনও সমাজের দুই ব্যক্তি বা দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি দলই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য নিজেদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাহায্য কামনা করে। এই আয়াতে বলা হচ্ছে: যারা যুদ্ধ লিপ্ত হয়নি তাদের উচিত হবে যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে শান্তির দিকে আহ্বান করা যাতে সংঘাত আর ছড়াতে না পারে। কিন্তু যদি দুই দলের একদল যুদ্ধ বন্ধ করতে সম্মত না হয় তাহলে সেই দলের বিরুদ্ধে বাকিরা যুদ্ধ করবে যাতে দলটি আর আগ্রাসন চালাতে না পারে এবং সমাজ আরো বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব সমাজে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের।  কাজেই সমাজের কোথাও দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে সে ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপহীন থাকা যাবে না। সংঘাতে জড়ানো দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে দিতে হবে। কিন্তু দুই পক্ষের এক পক্ষ যদি আগ্রাসী মনোভাব দেখাতে থাকে তাহলে তাকে বলপূর্বক থামিয়ে দিতে হবে যাতে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে।

২- সমাজে বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ সৃষ্টিকারী ব্যক্তির সঙ্গে আপোষ করা জায়েয নয়। এ ধরনের ব্যক্তি মুসলমান হলেও তাকে রেহাই দেওয়া যাবে না।

৩- নির্যাতিত ব্যক্তির অধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয় সেজন্য সংঘর্ষরত দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে ন্যায়ের ভিত্তিতে। তা না হলে এ ধরনের শান্তি টেকসই হবে না বরং অপমান ও গ্লানি বয়ে আনবে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ