আসমাউল হুসনা (পর্ব-৬১)
মানুষ দুনিয়ার বুকে মহান আল্লাহর প্রতিনিধি। তবে আল্লাহর যোগ্য প্রতিনিধি হতে হলে তাঁর নামগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখতে হবে। এইসব পবিত্র নাম কেবল একটি শব্দ নয় বরং ব্যাপক অর্থবোধক বিষয়।
বিভিন্ন সময়ে বিচিত্রময় এইসব নামের প্রকাশ ও বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠে। মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার তালিকাভুক্ত এমনই আরও দুই নাম হাইয়্যু ও ক্বাইয়্যুম। হাইয়্যু অর্থ জীবন্ত ও ক্বাইয়্যুম অর্থ নিজ সত্ত্বায় অবিচল, অক্ষয় বা চিরস্থায়ী। মহান আল্লাহর সব নাম পূর্ণতাজ্ঞাপক নানা বাস্তবতার প্রকাশ। এসবের রয়েছে ধারাক্রম। এই মহান নামগুলোর কোনো কোনোটি উৎসারিত হয়েছে মহান আল্লাহর অন্য নাম থেকে। তাই এই নামগুলোর কোনো কোনোটির অবস্থান বা পরিধি ব্যাপকতর ও বেশি প্রভাব বা ক্ষমতার উৎস। মহান আল্লাহর নামগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ও সর্বাত্মক অর্থবহ নাম হল খোদ্ আল্লাহ। আর এই মহান নামের পর মহান আল্লাহর সবচেয়ে ব্যাপক ও প্রভাবপূর্ণ নাম হল হাইয়্যু এবং এরপর হল কাইয়্যুম।
মহান আল্লাহর হাইয়্যু নামের অর্থ হায়াত বা জীবনের অধিকারী তথা জীবন্ত। মহান আল্লাহ চিরঞ্জীব। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী জীবন্ত কোনো কিছুর রয়েছে জীবন-চক্র, বিকাশ, খাদ্য গ্রহণের ক্ষমতা, নিজের সমপর্যায়ের কিছু জন্ম দেয়া, অনুভূতি, আকর্ষণ, বিকর্ষণ ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্যের আলোকে উদ্ভিদও জীবন্ত। মানুষের সামগ্রিক বিষয়ে অনুভূতি ও উপলব্ধির ক্ষমতা থাকলেও পশু-পাখিদের তা নেই। পশুপাখি বিশেষ কোনো দিকে খুব গভীর বা সূক্ষ্ম জ্ঞান রাখলেও সামগ্রিক বিষয়ে অচেতন। অন্যদিকে ফেরেশতারা অপার্থিব ও অবস্তুগত সত্ত্বা হওয়া সত্ত্বেও অনুভূতির অধিকারী ও তৎপর। যে অস্তিত্ব যত বেশি পূর্ণতার অধিকারী সে অস্তিত্ব তত বেশি সচেতন ও সক্রিয়। অন্যদিকে যারা যত বেশি অচেতন ও কম সক্রিয় তারা তত কম জীবন্ত। মহান আল্লাহ জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য তথা জ্ঞান, শক্তি ও তৎপরতা – এ সবেরই অধিকারী। মহান আল্লাহ সক্রিয়তা বা কাজ করার ক্ষেত্রে অশেষ শক্তির অধিকারী এবং অন্য সব সৃষ্টির স্রস্টা । আর তিনি সব কিছুরই জ্ঞান রাখেন।–
মহান আল্লাহ জীবন্ত। কিন্তু তাঁর জীবন্ত থাকার বিষয় অন্য কারো ওপর বা কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নয়। তিনি অব্যয় বা অক্ষয় এবং সময় ও উপায়-উপকরণের কোনো প্রভাব নেই তাঁর জীবন্ত থাকার ওপর। মহান আল্লাহর অমুখাপেক্ষীতা নিরঙ্কুশ। অন্যদিকে অন্য সব কিছুই মহান আল্লাহর মুখাপেক্ষী। মহান আল্লাহর অস্তিত্ব অনাদি ও অসীম। ক্ষয়শীলতা বা ধ্বংসশীলতার কোনো স্পর্শ বা সম্পর্ক নেই মহান আল্লাহর অস্তিত্বের সঙ্গে। কিন্তু অন্য সব অস্তিত্বের রয়েছে ক্ষয়শীলতা বা ধ্বংসশীলতা। আল্লাহ ছাড়া অন্য সব জীবন্ত অস্তিত্ব স্বাধীনভাবে অস্তিত্ব পায়নি এবং তাদের জীবন আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল।
মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম ক্বাইয়্যুম। আরবিতে এর সমগোত্রীয় শব্দ হল ক্বামা ও ক্বিয়াম ইত্যাদি। ক্বামা অর্থ দাঁড়ানো, উত্থান বা জেগে ওঠা ও নিয়ন্ত্রণে রাখা। ক্বিয়াম অর্থ উত্থান বা বিপ্লব ও কর্তৃত্বশীল হওয়া, সক্রিয় হওয়া ইত্যাদি। কর্তৃত্বশীল হওয়ার জন্য উত্থান ঘটা জরুরি। মোটকথা ক্বাইয়ুম শব্দের অর্থ হল সৃষ্টি জগত ও জগতের ব্যবস্থাপনাকে সক্রিয়কারী বা চালুকারী। ক্বাইয়্যুম শব্দের অর্থ আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। কোনো ব্যক্তি যখন ভূমিতে শোয়া অবস্থায় থাকে তখন ভারী কোনো কিছু ওপরে তোলার জন্য তার শক্তি খুব কমই থাকে। বসা অবস্থায় এ শক্তি কিছুটা বাড়ে। কিন্তু দাঁড়ানো অবস্থায় ওই ব্যক্তি সমস্ত শক্তি ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে সক্রিয় হতে পারেন। মানুষ যে অবস্থায় তার সব শক্তিকে সক্রিয় করতে পারে সে অবস্থাকেই আরবি সাহিত্যে ক্বিয়াম বলে উল্লেখ করা হয়।
পবিত্র কুরআনের সুরা মুতাফ্ফিফিন-এর ৬ নম্বর আয়াতে ক্বিয়ামত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে। -অর্থাৎ সেদিন মানুষ তার সব শক্তি, যোগ্যতা ও কৃতকর্মের রেকর্ড নিয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হবে। কিন্তু মহান আল্লাহর ক্বিয়াম স্বনির্ভর। মহান আল্লাহ ঘুম, দুর্বলতা ও বিস্মৃতির মত বিষয়গুলোর শিকার হন না।
ক্বাইয়্যুম অর্থ সব সময়ের জন্য বিরতিহীনভাবে উত্থান ও সুরক্ষা। আর এ জন্যই মহান আল্লাহর হাইয়্যু ও ক্বাইয়্যুম নাম পাশাপাশি আসে। হাইয়্যু অর্থ জীবন দানের সর্বোচ্চ অবস্থা ও ক্বাইয়্যুম অর্থ তা অব্যাহত রাখা। সুরা বাকারায় মহান আল্লাহ নিজের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেছেন: আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি জীবিত ও বিরতিহীনভাবে সবকিছুর ধারক বা সুরক্ষক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। -
অন্য কথায় মহান আল্লাহ যদি এক মুহূর্তের জন্যও অসচেতনতা বা তন্দ্রার শিকার হতেন তাহলে সমস্ত জীব ও বিশ্বজগত ধ্বংস হয়ে যেত। সব কিছুকে সচল ও সক্রিয় রাখেন মহান আল্লাহ। আর এ জন্যই সব কিছু মহান আল্লাহর ওপর চরম বা নিরঙ্কুশ মাত্রায় নির্ভরশীল।
মহান আল্লাহ সবার ওপর কর্তৃত্বশীল ও তাদের সুরক্ষক। তাই আল্লাহর সমকক্ষ কেউ নেই। মহান আল্লাহই সব সৃষ্টি ও অস্তিত্বের উৎস। আর সেসবকে সক্রিয় ও সজীবও রাখেন তিনি। মহান আল্লাহর ক্বাইয়্যুম নামের প্রতিফলন যার মধ্যে রয়েছে সে নিজেও খোদার পথে সক্রিয় থাকে ও অন্যদেরও সক্রিয় করে। মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা ইমাম মাহদি (আ)ও ক্বায়েম উপাধিধারী। মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি আত্মপ্রকাশ ঘটাবেন ও বিশ্ব-বিপ্লব ঘটাবেন। ইমাম মাহদি মহান আল্লাহর দেয়া মানবীয় সব যোগ্যতার চরম বিকাশ ঘটাবেন এবং মহান আল্লাহই তাঁকে এই যোগ্যতা দিয়েছেন। অন্য মানুষেরা ইমাম মাহদির সম পর্যায়ে নেই বলেই তাঁর আবির্ভাব ঘটাচ্ছেন না মহান আল্লাহ। সব ধর্মেই মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের জন্য প্রার্থনা দেখা যায়। আসলে এ জন্য মানুষকে জেগে উঠতে হবে ও এই মহান ইমামের সঙ্গী হওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আর তা না হলে উনার আবির্ভাব ঘটবে না।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।