সুখের নীড়- পর্ব ৮
বিয়ের প্রাক্কালে বা বিয়ের জন্য বাগদত্তা ও বাগদত্ত পাত্রী ও পাত্রদের অনেকেই বিয়ে-পরবর্তী জীবনের পরিস্থিতিকে দাম্পত্য-পূর্ববর্তী জীবনের বন্ধুত্বের মতই স্বপ্নময় ও মধুর বলে মনে করেন।
বাস্তবে এ দুই সময়ের পরিস্থিতির মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। এ দুই পরিস্থিতির মধ্যে তুলনার কারণে অনেকেই দাম্পত্য জীবনকে অনীহার দৃষ্টিতে দেখেন। এ দুই জীবনের তুলনা আসলে স্বপ্নিল জীবনের সঙ্গে বাস্তব জীবনের তুলনার মত। একদিকে রয়েছে ত্রুটিহীন মধুর বন্ধুত্বের সম্পর্ক এবং অন্যদিকে রয়েছে ভালো ও মন্দের অনুভূতি মিলিয়ে বাস্তবতা অনুভবের জগত। দাম্পত্য জীবনকে আদর্শ ও সুখময় করতে হলে ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা ও ধৈর্য ধারণ জরুরি। দাম্পত্য জীবন শুরুর পর স্বামীর কাছে প্রাধান্য পায় কাজ ও সামাজিক নানা সাফল্য। অন্যদিকে নববধূরা কেবল সেই সময়কে আদর্শ মনে করেন যে সময়ে তার প্রিয় পুরুষটি কেবল তার কথাই ভাবতো এবং অন্য কিছুকেই তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত না। ফলে বিয়ের পর এ ধরনের নারী হতাশায় ভুগেন ও মনে করেন যে তার প্রতি স্বামীর ভালবাসা ম্লান হয়ে গেছে। এ অবস্থায় তারা যে কোনো পারস্পরিক সম্পর্ককেই নেতিবাচক চোখে দেখেন।
তাই দাম্পত্য জীবনে প্রবেশের জন্য বাস্তববাদী হওয়া উচিত। বাস্তবতাগুলোকে নিয়ে যেতে হবে আদর্শ অবস্থার কাছাকাছি যাতে যৌক্তিক ও বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। এ জন্য বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার সাহায্য নেয়া জরুরি এবং পরস্পরকে এটা বোঝাতে হবে যে প্রেমময় সম্পর্ক ম্লান হয়ে যাওয়ার অর্থ দয়াহীনতা ও বন্ধুত্বের অবসান নয়। মনে রাখা দরকার সংসার জীবনকে সফল করার জন্য ভালবাসা ও অনুরাগ ছাড়াও আরও অনেক কিছুরও দরকার রয়েছে।
ইরানি পরিবারগুলোতে বাবা-মায়ের প্রতি সম্মানের মূল্যবোধ এখনও বেশি শক্তিশালী। এক জরিপে দেখা গেছে শতকরা ৮৯ ভাগ ইরানি উত্তরদাতা মনে করেন বাবা-মায়ের ভালো বা মন্দ স্বভাব যা-ই থাকুক না কেন সেসবকে বিবেচনায় না এনেই তাঁদেরকে শ্রদ্ধা করতে হবে। বাবা-মায়ের প্রতি এ শ্রদ্ধাবোধের উৎস হল ইসলামী শিক্ষা। পবিত্র কুরআনে সুরা লোকমানের ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়। হ্যাঁ, আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে।
এ ছাড়াও সুরা আসরার ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাঁদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাঁদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাঁদেরকে ধমক দিও না বা কর্কশ আচরণ করো না তাঁদের সঙ্গে এবং বল তাঁদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা। তাঁদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল: হে পালনকর্তা, তাঁদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তাঁরা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।
ইরানের প্রখ্যাত আলেম মরহুম আয়াতুল্লাহিল উজমা মারআশি নাজাফি থেকে বর্ণিত হয়েছে: যখন প্রায় দশ বছর বয়সের বালক ছিলাম তখন একবার মা বললেন দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে, যাও উপরের তলায় গিয়ে তোমার বাবাকে ডাক। দেখলাম যে বাবা তার বইগুলোর ওপর ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফলে দ্বিধায় পড়ে গেলাম: মায়ের আদেশ অনুযায়ী বাবাকে জাগিয়ে তুললে মধুর ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে বাবা রাগ করবেন! তাই এমন সিদ্ধান্ত নিলাম যে বাবাকে জাগিয়ে তুললেও তিনি যেন রাগ না করেন। আমি নতজানু হয়ে বাবার পায়ের তালুতে চুমু খেলাম! বাবা তখনই জেগে আমার অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন ও তখনই আমার জন্য দোয়া করলেন। আজ পর্যন্ত আমার যা কিছু আছে তা বাবার কয়েকটি দোয়ারই ফল।
ইরানি পরিবারগুলোতে এখনও বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের গভীর ভালবাসার ও হৃদ্যতার সম্পর্ক দেখা যায়। ভাই-বোন ও পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের মত অতটা গভীর না হলেও পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগে তা প্রভাব রাখে। কারণ তারা বাবা-মায়ের কাছ থেকে অন্যদের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা বা কৌশলগুলো শিখতে এবং সমাজের অন্য সদস্যদের জন্যেও বিশ্বাস বা আস্থা ও অনুরাগপূর্ণ পরিবেশ বা সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়।
সংসারকে সুখময় করতে হলে স্বামী ও স্ত্রী উভয়কেই হতে হবে ন্যায়পরায়ণ এবং পরস্পরের সহযোগী। তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী বা জন্মগতভাবে একের চেয়ে অন্যজন শ্রেয় এমন ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। স্ত্রী তার চিন্তা ও বুদ্ধিমত্তাকে স্নেহশীলতা এবং সুন্দর বচন রচনায় কাজে লাগাতে পারেন। অন্যদিকে স্বামীও তার দক্ষতাকে বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনা ও মানবীয় চিন্তার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন।
সংসারকে সুখময় করতে স্বামী ও স্ত্রীর জন্য আরেকটি জরুরি বিষয় হল গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক নানা বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করা। বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বা না রাখা, কেনা-কাটা ও নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়সহ আরও অনেক বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর উচিত পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করা। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী-আ বলেছেন, পরামর্শের চেয়ে ভালো কোনো মদদদাতা আর নেই।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/ ০৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।