এপ্রিল ০৯, ২০২২ ১৭:৪৪ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা! স্বাস্থ্যকথার আসরে স্বাগত জনাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করি আপনারা ভালো ও সুস্থ আছেন। নাক কান গলার বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিকার নিয়ে কয়েক আজ চতুর্থ পর্বের আলোচনা হবে।

আপনারা জানেন, নাক-কান-গলার সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঠান্ডার কারণে সমস্যা সৃষ্টি হতে দেখা দেয়। কিন্তু ঠান্ডাজনিত সমস্যা ছাড়াও নাক-কান-গলার আরও অনেক জটিল অসুখ হতে পারে। আর তাই নাক-কান-গলার নানা রকমের সমস্যা ও চিকিৎসা নিয়ে  আমরা কয়েকটি পর্বে আলোচনা করেছি। আজও এ বিষয়ে  স্বাস্থ্যকথার কথার আসরে আলোচনায় আমাদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন, ই এন টি স্পেশালিস্ট ডা, এম মইনুল হাফিজ। 

জনাব, ডা. এম. মইনুল হাফিজ রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: ডা.এম মইনুল হাফিজ, আগের পর্বগুলোতে মোটামুটিভাবে গলা ও নাক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, আজ যদি আপনি কানের সমস্যাগুলো একটু তুলে ধরেন।

চিকিৎসক

ডা. এম. মইনুল হাফিজ: কানের রোগগুলো ছোট বড় এবং বেশি বয়স্ক সবারই হতে পারে। তবে ছোটদের ক্ষেত্রে একটি খুবই কমন সমস্যা হচ্ছে  জন্মগতভাবে কানে না শোনা। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। অনেক কারণ অজানা থাকতে পারে।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা গর্ভাবস্থায় মায়ের পেটের মধ্যে বাচ্চাদের কানের সমস্যা কি হতে পারে, বিষয়টি নিয়ে যদি আলোচনা করেন।

ডা. এম. মইনুল হাফিজ: জ্বি, গর্ভাবস্থায় মায়ের পেটের মধ্যে বাচ্চাদের কানের সমস্যা হতে পারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১০০ জন শিশুর মধ্যে ৪ জন স্বাভাবিকভাবে শুনতে পায় না। গর্ভাবস্থায় এমন সমস্যা মারাত্মক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা এখন মায়ের পেটের ভেতর অ্যানালাইসিস করে সেখান থেকে ফ্লুয়েড সংগ্রহ করে বাচ্চার কানের সমস্যা আছে কি না সেটা পরীক্ষা করে থাকি। অনেক সময় দেখা যায় মেজর সমস্যার কারণে গর্ভপাতও ঘটানো হয়ে থাকে। কারণ ঐ বাচ্চাকে নিয়ে পরবর্তীতে বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে। এরকম ঘটনা দেশে বিদেশে হচ্ছে। অনেক সময় মায়েরা যদি ড্রাগ নেয় তাহলেও বাচ্চার কানের সমস্যা হতে পারে।

অনেক সময় যিনি বাচ্চা নেবেন সেই মায়ের যদি মাম্পস, রুবেলা, হারপিস, চিকেন পক্স বা টক্সোপ্লাসমোসিসের মতো ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ হয় তাহলে শিশুর জন্মগত ভাবে কম শোনে বা কোনও স্পষ্ট ভাবে শব্দই শুনতে পায় না।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা গর্ভাবস্থায় বাচ্চার যে কানের ক্ষতি হয় সেটি কি ধরনের..

ডা. এম মইনুল হাফিজ: মায়ের পেটের মধ্যে বাচ্চার কানে শোনার বিষয়ে দু'ধরনের সমস্যা হতে পারে। কানে শোনার বিষয়ে একটি হচ্ছে কন্ডাক্টিভ-যাতে কন্ডাকশনের সমস্যা হয়। অপরটি হচ্ছে নার্ভের সমস্যা। আর জন্মগত ক্রটির ক্ষেত্রে নার্ভের সমস্যাটাই বেশি হয়। বলা যায় শতকরা ৯৯ শতাংশ বাচ্চার ক্ষেত্রে নার্ভের সমস্যাটা বেশি। আমরা যদি ঐসব বাচ্চার যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চিকিৎসা না করাতে পারি তাহলে মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। আমাদের দেশে দেখা যায় লক্ষ লক্ষ বোবা বাচ্চা আছে-শুধু কিন্ত এই কারণে।

রেডিও তেহরান: তারমানে জন্মগতভাবে কানে শুনতে না পাওয়ার সংকটা ব্যাপকভাবে আছে তাইতো ডা. এম মইনুল হাফিজ?

কান

ডা. এম মইনুল হাফিজ: জ্বি এটি ব্যাপকভাবে আছে। যেহেতু আমি হেয়ারিং হেল্প নিয়ে কাজ করি তাই এ বিষয়টি বুঝতে পারি যে কি পরিমাণে শিশুরা জন্মগতভাবে কানের সমস্যায় ভুগছে।  আমরা বাচ্চাদেরকে হেয়ারিং এইড দেই। সেটা দিয়ে বাচ্চা শোনে এরপর বাচ্চাদের স্পিচ থেরাপি দেয়া হয়, রিহ্যাবিলেটেশন করা এবং কিছুটা বিহ্যাবিয়েল থেরাপি দেয়া হয়। এরপর ওদেরকে মেইনস্ট্রিমে আনা হয়। তখন তারা সাধারণ স্কুলে যায়।

আবার কখনও কখনও দেখা যায় জন্মের সময় শ্রবণ শক্তি স্বাভাবিক থাকলেও ৩/৪ বছর বয়সে মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড বা এনকেফেলাইটিস হলেও শ্রবণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অন্য অনেক অসুখের মতই কানে শোনার অসুবিধা যদি জন্মের সময় নির্ণয় করা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হিয়ারিং এড দিয়ে বা দরকার হলে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করে শিশুকে শব্দের জগতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি কি:

চিকিৎসা বিজ্ঞানে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি পদ্ধতি এক অভিনব চিকতিসা পদ্ধতি। যারা কানে শোনেন না কিম্বা একেবারেই কমশোনেন তাদের চিকিৎসা করা হয় এই সার্জারির মাধ্যমে। ককলিয়ার ইমপ্লান্ট একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র যার একটি অংশ সার্জেনরা অপারেশন করে কানের ভেতর বসিয়ে দেন যা আমৃত্যু কার্যকর থাকে। বাকি অংশটুকু কানের পেছনে লাগিয়ে শব্দ শোনা যায় প্রায় একেবারেই স্বাভাবিকের মতো। কানে শোনার ক্ষেত্রে যাদের জন্মগত সমস্যা রয়েছে তাদের বেলায় ১০ মাস থেকে ৫ বছরের মধ্যে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করলে কানে ভালো শুনতে পাবে।

তাছাড়া যাদের বয়স বেশি তারাও অপারেশন করালে ভালো শুনতে পাবেন। তবে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট যন্ত্রের নাম মোটেও কম নয়। তাই এ যন্ত্রটি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় কানের পর্দা ফেটে যাওয়া- তো এ বিষয়ে যদি আপনি বুঝিয়ে বলেন..

বাচ্চার কানের রোগ

ডা. এম মইনুল হাফিজ:  কানের পর্দা ফাটা একটা জটিল স্বাস্থ্যগত সমস্যা। নানাকারণে কানের পর্দা ফুটো হয়ে যেতে পারে, ফেটে যেতে পারে।  দীর্ঘ শর্দি কাশি থেকেও অনেকের কানের পর্দা ফুটো হয়ে যেতে পারে।  আবার আঘাত থেকেও পর্দা ফেটে যেতে পারে।  এমন হলে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়।  সঠিক চিকিৎসা না পেলে বড় বিপদ হতে পারে।

কানের পর্দা ছিদ্র হওয়ার প্রধান কারণ কানের ইনফেকশন।  পানি জমে এই ইনফেকশন হতে পারে।  আবার আঘাতজনিত কারণে পর্দা ফাটা অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। যদি এ সমস্যার ঠিকমতো চিকিৎসা হয় তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ছিদ্র এমনিতে সেরে যায়।

কেন পর্দা ফাটে

বাতাসের ধাক্কা- কানের ওপর চড় মারলে যে বাতাসের চাপ হয় তাতে কানের পর্দা ফেটে যায়। কানের পাশে বোম ফাটলেও একই ক্ষতি হতে পারে।

পানির ধাক্কা- পানির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লে।

শব্দের ধাক্কা- দেখা যায় কানের পাশে প্রচণ্ড শব্দ হলে কানের পর্দায় প্রদাহ হয়, কানের ভেতরে ছোট ছোট হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমনকি কানে শোনার স্নায়ুও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে।

কানে সরাসরি আঘাত-দুর্ঘটনার সময় বা শক্ত কিছুর সঙ্গে কানে আঘাত লাগলে কানের আশপাশের হাড়, অথবা কান ও মস্তিষ্কের মধ্যে টেম্পোরাল নামক যে হাড় থাকে তা ভেঙে যেতে পারে। এতে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কানের অন্যান্য সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি কানের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কের তরল পদার্থ সিসএফ লিক করতে পারে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে এ রোগীদের।

কটন বাড বা ধারাল অন্যকিছু দিয়ে কান খোঁচানোর সময় হঠাৎ করে কেউ ধাক্কা দিলে পর্দা ছিদ্র হয়ে যায়। যদিও এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, তবুও সমস্যাটি আমরা প্রায়ই দেখে থাকি।

কানের যে প্রদাহ হয়- এ ধরনের বলা চলে আমি লক্ষাধিক রোগী দেখেছি। খুব কমন একটি কানের অসুখ এই প্রদাহ। বাচ্চাদের কানের প্রদাহ হলে ব্যথা হয় এবং মধ্য কর্ণের মধ্যে পানি বা পুঁজ জমে যায় এবং এর চাপ থেকে কিন্তু পর্দা ফেটে যেতে পারে। এটার যদি সঠিক চিকিৎসা করা যায় তাহলে ঠিক হয়ে যাবে। তা না করা হলে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের গ্রামের দিকে এই রোগটি বেশি হয়। সাধারণত এই রোগ নিয়ে পুকুরে গোসল করছে, ডুব দিচ্ছে, এতে ইনফেকশন হয়ে যাচ্ছে।

কী সমস্যা হতে পারে

আঘাত পাওয়ার পর কানটি বন্ধ হয়ে যায় বা রোগী কানে কম শুনে।  কানে শোঁ শোঁ শব্দ হতে পারে, অনেক সময় কান দিয়ে রক্তও বের হতে পারে।  এক্ষেত্রে কানের সঠিক চিকিৎসা না হলে দু-এক দিন পর দেখা যায় কান দিয়ে পুঁজ বা পানি বের হতে পারে।

কাদের এ সমস্যা হতে পারে

কানে সরাসরি আঘাতজনিত কারণে আঘাতের মাত্রা বেশি হলে যে কোনো কারণে পর্দা ফেটে যেতে পারে। বাতাস বা পানি বা শব্দের ধাক্কায় যখন কানের পর্দা ফাটে সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কানের পর্দা আগে থেকেই দুর্বল ছিল যেমন- ছোটবেলায় বারবার কান পাকা রোগ থেকে কানের পর্দা দুর্বল হয়ে যায়, দীর্ঘদিনের টনসিল ও এডেনয়েড প্রদাহে ভোগা, নাকের হাড় বাঁকা, অনেক দিনের নাক ও সাইনাসে প্রদাহ ইত্যাদি। ইউস্টেসিয়ান টিউবের কাজ ঠিকমতো না হওয়ার কারণে কানের পর্দা দুর্বল হয়ে যায়। এ দুর্বল পর্দা অল্প আঘাতেই ফেটে যায়।

কী করবেন

  • কান শুকনা রাখতে হবে।
  • কানের ভেতরে তুলা, কটনবাড, পানি কোনো কিছুই ঢুকানো যাবে না।
  • কান ভেজা অবস্থায় মাথায় পানি ঢালা যাবে না।

এধরণের বহুরোগী আমি অপারেশন করেছি আমার ৩৫ বছরের চিকিৎিক জীবনে। প্রায় ৬/৭ হাজার রোগী অপারেশন করে কানের পর্দা লাগিয়ে দিয়েছি। মধ্য কর্ণের মধ্যে কিছু জয়েন্ট আছে। ওখানে তিনটা হাঁড় আছে। এই হাঁড়গুলো কন্ডাকশান করে। ওগুলো আমরা রিপেয়ার করতে পারি মাইক্রোস্কোপের সাহায্য নিয়ে। কানের পর্দা ফুটো হয়ে যাওয়া এবং পর্দা ফেটে যাওয়ার চিকিৎসা এখন বিশ্বব্যাপী হচ্ছে। এটা নিয়ে অমন দুর্ভাবনার কিছু নেই।

তো ডা. এম মইনুল হাফিজ, নাক কান গলার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অসংখ্যা ধন্যবাদ জানাচ্ছি।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৯

ট্যাগ