স্বাস্থ্যকথা: হৃদরোগ-পর্ব ৪
কীভাবে হৃদরোগ থেকে বাঁচবেন?
এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অভাব এবং সংকট হচ্ছে আমাদের মনের শান্তি। সেই শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারলেই কিন্তু আমরা অনেক রোগ থেকে বেঁচে যাব; হৃদরোগ থেকে তো অবশ্যই। একথাগুলো খুব সরলভাবে বুঝিয়ে দিলেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো.তাইফুর রহমান।
বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বললেন, কোনো ব্যক্তি যদি দেখেন, হাঁটতে গেলে বুক ধড়পড় করছে। হাঁটতে গেলে হাঁপিয়ে উঠছেন, সিঁড়ি ভাঙতে পারছেন না, পাঁচ কেজি একটি ওজন নিয়ে হাঁটতে গেলে কেমন যেন থেমে থেমে হাঁটতে হচ্ছে। এসব বিবেচনায় বলা যায় সম্ভবত আমার হার্টের রোগ আছে। এরপর ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
কোনো অবস্থায় হার্টের রোগ কিংবা যেকোনো রোগকে হেলাফেলা করা যাবে না। জীবন যাপনে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। নির্ভার থাকতে হবে। অল্পে তুষ্ট থাকতে হবে। মনের সুখ খুঁজে নিতে হবে।
শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশাকরছি সবাই ভালো ও সুস্থ আছেন। হৃদরোগ বা হার্টডিজিজ নিয়ে আজ শেষ পর্বের আলোচনা হবে। আর এ বিষয়ে কথা বলবেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ড.মোহা. তাইফুর রহমান। বিশিষ্ট এই চিকিৎসক কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। ডা. মো. তাইফুর রহমান রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
ডা. মো. তাইফুর রহমান: ধন্যবাদ আপনাকে।
রেডিও তেহরান: ডা. তাইফুর রহমান, আপনি গতপর্বে হৃদরোগের পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। আলোচনার শেষ দিকে আপনি সিটি এনজিওগ্রামের কথা বলেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে যদি আরও একটু বিস্তারিত জানান।
ডা. মো. তাইফুর রহমান: দেখুন, আমি বলেছিলাম সিটি এনজিওগ্রাম একমাত্র পরীক্ষা যার মাধ্যমে হার্টে ব্লকের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় তবে এর একটু সমস্যা আছে। আর সেটি হচ্ছে এটি একটু ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল। এছাড়া সব জায়গায় এই পরীক্ষা করানো হয় না। হৃদরোগ, হার্টে ব্লকের ব্যাপারে আমার প্রথম কথা হচ্ছে- রোগীর ইতিহাস কি বলে, লক্ষণগুলো কি বলছে সেটিই হচ্ছে ডায়াগনোসিসের প্রথম ধাপ।
কোনো ব্যক্তি যদি দেখেন, হাঁটতে গেলে বুক ধড়পড় করছে। হাঁটতে গেলে হাঁপিয়ে উঠছেন, সিঁড়ি ভাঙতে পারছেন না, পাঁচ কেজি একটি ওজন নিয়ে হাঁটতে গেলে কেমন যেন থেমে থেমে হাঁটতে হচ্ছে। এসব বিবেচনায় বলা যায় সম্ভবত আমার হার্টের রোগ আছে। এরপর ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এটি হচ্ছে আমার নিজের ডায়াগনোসিস।
আর আপনি যেটি বলছিলেন, হৃদরোগ হওয়ার পর বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর একটা মানুষের হাত পা হয়তো ঠিক থাকে। কিন্তু সে আর আগের মতো কর্মক্ষম থাকতে পারে না। সে কাজ করতে গেলে হাঁপিয়ে উঠবে। এরপরের কথা হচ্ছে হার্টের অনেকগুলো ওষুধ ক্ষেতে হয়। আর হার্টের ওষুধগুলো বেশ ব্যয়বহুল। ফলে কেউ হৃদরোগে পড়লে কিংবা হার্টে ব্লক ধরা পড়লে সেটি একটি পরিবারের ওপর রাষ্ট্রের উপর বোঝা হয়ে ওঠে। সুতরাং হৃদরোগ থেকে বাঁচার জন্য রোগটি হওয়ার আগে আমাদের প্রতিরোধ করাটা খুব বেশি প্রয়োজন।
রেডিও তেহরান: ডা. মো. তাইফুর রহমান, আপনি সবশেষ যে কথাটি বললেন যে হৃদরোগ হওয়ার আগে সতর্ক হতে হবে।হৃদরোগ পরিবারের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। আর হৃদরোগে পরীক্ষা নিরীক্ষায় ইসিজি, ট্রেডমিল টেস্ট, দুরকমের এনজিওগ্রাম এবং সিটি এনজিওগ্রামের কথাও বললেন। ধরুন এসব পরীক্ষা নিরীক্ষায় হৃদরোগ ধরা পড়ল নির্ণয়ও হয়ে গেল। আপনারা যখন চিকিৎসা দিচ্ছেন তখন শুনে থাকি বাইপাস সার্জারি এবং ওপেন হার্ট সার্জারির কথা। তো এগুলো কি কেমন কিভাবে করা হয়, ভয়ের কারণ আছে কি না, ঝুঁকি কতটা থাকে এসব বিষয়ে যদি কিছু বলেন।
ডা. মো. তাইফুর রহমান: দেখুন, হৃদরোগ ধরা পড়ার পর জীবনের সবকিছুকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। সব অনিয়ম দূরে ঠেলে দিতে হবে। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে খুব সতর্ক হতে হবে। রিস্ক ফ্যাক্টর যেগুলো আছে- যেমন ধরুন যদি ডায়াবেটিস থাকে, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, ধূমপানের অভ্যাস থাকে এসবগুলোকে যতটুকু পারা যায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ওষুধ পরবর্তী যে চিকিৎসা তাৎক্ষণিক চিকিৎসার মধ্যে একটি হচ্ছে- রিং লাগানো বা স্টেন্টিং করা এবং বাইপাস সার্জারি করা।
রিং পরানো বা স্টেন্টিং করা কি? Stenting
স্টেনটিং বা রিং পরানো : এনজিওপ্লাস্টির পর ওই জায়গার প্রশস্ততা ধরে রাখতে ওই স্থানে রিং বসানোকে স্টেনটিং (Stenting) বলে। অনেকের ধারণা, স্টেনটিং বুক কেটে করা হয়। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। যে পথে এনজিওগ্রাম করা হয়েছে ওই পথেই এনজিওপ্লাস্টি করে স্টেনটিং বা রিং পরানো হয়।
ধরুন আমার হার্টে একটি ব্লক আছে। কিন্তু সেই ব্লকের একটু তো খোলা আছে। অর্থাৎ ধারা যাক শতকরা ৯৯ ভাগ ব্লক সেখানে একভাগ তো খোলা আছে। আর এই খোলা অংশ দিয়ে খুব চিকন সুতার মতো একটি ওয়্যার নিয়ে যাওয়া হয়। এর উপর বেলুন মাউটেড স্টেন থাকে। রিং বা স্টেনটা বলপেনের ভেতরে যে স্প্রিং থাকে তার মতো। যদি স্প্রিংটাকে টান দেয়া হয় তাহলে তো চিকন হয়ে যাবে। এটার মধ্যে একটা বেলুন থাকে। এটা ওখানে নেয়ার পর বেলুনটাকে চাপ দিলেই রিংটা খুলে রক্তনালির ভেতরে ফুলে ওঠে তখন বেলুনটাকে খুলে নিয়ে আসা হয়। তবে রিংটা ফুলে থাকে। এরফলে যে রক্তনালিটা সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল সেটা প্রসারিত হয়ে যায় এবং রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যায়। তাহলে রিং হলো একটি তার দ্বারা তৈরি এক ধরনের পাইপ, যা মোড়ানো অবস্থায় চিকন হওয়া ব্লকের স্থানে প্রতিস্থাপন করে বাইরে থেকে মোড়ানো তারটি ফুলিয়ে পাইপে রূপান্তরিত করে চিকন রক্তস্রোতকে প্রসারিত করে এবং তা যেন আবার চেপে গিয়ে ব্লকের সৃষ্টি না করতে পারে।
আর বাইপাস সার্জারি হচ্ছে- ধরুন একটি নদী। সেই নদীতের চর পড়তে পড়তে বন্ধ হয়ে গেল। ধরুন শতকরা ৮০ ভাগ কিংবা ৯৯ ভাগ ব্লক হয়ে গেল। রিং পরানোর সময় রক্তনালিতে পাইপ দিয়ে মোটা করে দেয়া হয়েছিল কিন্তু বাইপাস হচ্ছে যেখানে ব্লক হয়েছে তার অন্য জায়গা থেকে একটি সুস্থ ধমনী নিয়ে হার্টের সাথে সংযোগ করে দেয়া হয়। এতে ব্লকের পথ দিয়ে না গিয়ে বাইপাস হয়ে হার্টের পেশীগুলোকে রক্ষা করল। হার্টের মাসেলগুলোকে অনেকটা জমির মতো চিন্তা করতে পারি। রক্তনালিগুলো দিয়ে যখন রক্ত যাবে তখন পাশের জায়গাগুলো সবুজ শ্যামল হয়ে যাবে। ঠিক তেমনি হার্টের মাসেলগুলো আগের মতো সতেজ, সক্রিয় ও সক্ষম হবে। তাহলে
হার্টএর বাইপাস সার্জারিতে, একটি সুস্থ ধমনী শরীরের অন্য এলাকা থেকে নেওয়া হয় (সাধারণত বাহু, বা বুক থেকে) এবং/অথবা পা থেকে একটি শিরা নেওয়া হয় এবং হৃৎপিণ্ডের ব্লক ধমনীতে সংযুক্ত করা হয়। এটি রক্তকে ক্ষতিগ্রস্ত ধমনীকে বাইপাস করতে দেয় এবং হার্টের পেশীগুলির কার্যকারিতা উন্নত করে।
রেডিও তেহরান: ডা, তাইফুর রহমান মিউজিক বিরতির আগে আপনি হার্টে রিং বসানো এবং বাইপাস সার্জারির কথা বলছিলেন এবং এদুটো বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা দিলেন। তো হৃদরোগ নিয়ে আপনি যদি আমাদের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে আরও কিছু পরামর্শ ও উপদেশ দিতে চান?
ডা. মো. তাইফুর রহমান: দেখুন, আসলে একটি জিনিষ অবহেলিত থেকে যায়। আমরা যখন কিছু বলি তখন যেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে বলে মনে হয়। কিন্তু দু:শ্চিন্ত! এটি তো আমাদের মাথায় বিশ্বজুড়ে সব মানুষের কাছে একটি বোঝা হয়ে আছে। ধনী গরীব সবাই খুবই চিন্তিত। সবার মাঝেই দুশ্চিন্তা আছে। আমাদের একেকজনের ভাবনায় একেকরকম চিন্তা ও প্রত্যাশা খেলে যায়। কেউ ভাবেন অনেক পড়ালেখা করতে হবে। কেউ চিন্তা করেন অনেক বড়লোক হতে হবে। ধরুন আমি হয়তো চিন্তা করলাম না কিন্তু আমার পাশে যিনি আছেন তিনি, আমার পরিবার, আমার সমাজ, আমার সংসার সব চিন্তু কিন্তু চেপে বসে। এই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা হৃদরোগের বড় কারণ।
আমার মনে হয় পৃথিবী যেমন দৌঁড়াচ্ছে উর্ধ্বশ্বাসে ঠিক তেমনি আমরাও দৌঁড়াচ্ছি উর্ধ্বশ্বাসে। আজকে টেকনোলজিক্যালি এত উন্নতির কারণে সারা পৃথিবীর সব খবর মুহূর্তে পেয়ে যাচ্ছি। আর সব খবরই কিন্তু আমাদের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
আমি একটু গল্পের মতো করে বলছি। আমি বেড়ে উঠেছিলাম গ্রামে। আমরা দেখেছি চাঁদের আলোয় গ্রামে জারি সারি গান হতো। যাত্রা পালা হতো। এসব উঠে গেছে এখন। এখন জীবন হয়ে গেছে খুব ফার্স্ট। প্রযুক্তির কল্যাণে সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে বসে আছি। আর এর রেডিয়েশন তো আছেই।
আমি যেটা বলব, ঐসব দুশ্চিন্তা থেকে যদি আমরা দূরে থাকতে পারি তাহলে আমরা খুব ভালো থাকতাম। আমি একটা ম্যাসেজ দিতে চাই। সেটি হচ্ছে, সবকিছুর পর নির্ভার হয়ে যাওয়া। আর নির্ভার হয়ে যাওয়ার একটি পথ- আমার সমস্ত কাজ, সমস্ত ভালো মন্দ চাপিয়ে দেব আমার স্রষ্টার উপর। আমার যা কিছু হবে তা খুব সহজভাবে মেনে নেব। ধরে নেব এটা আমার ভাগ্যে ছিল। যদিও কথাটা আধ্যাত্মিক হয়ে যায় জানিনা আপনারা কিভাবে নেবেন?
আমরা যদি নির্ভার জীবনটাকে বেছে নিতে পারি, অল্পে যদি আমরা তুষ্ট থাকতে পারি এবং আমার যা আছে তাই নিয়ে যদি আমার সুখ খুঁজে পাই, আমার মনে যদি আনন্দ ধরে রাখতে পারি। না পাওয়ার বেদনা যদি আমি ভুলতে পারি তাহলে কিন্তু হৃদরোগ থেকে বাঁচব। শুধু হৃদরোগ না পৃথিবীর অনেক রোগ থেকে বেঁচে যাব।
এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অভাব এবং সংকট যেটা হচ্ছে আমাদের মনের শান্তি। সেই শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারলেই কিন্তু আমরা অনেক রোগ থেকে বেঁচে যাব; হৃদরোগ থেকে তো অবশ্যই।
আরেকটা বিষয় বলব, জীবনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। শৃঙ্খলায় আসতেই হবে আমাদের। যতরকমের অনিয়ম আছে সেটা থেকে সরে আসতেই হবে আমাদের। আর বৈজ্ঞানিক যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে- ধরুন আমার হাঁটতে চলতে সমস্যা হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে সেটাকে হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। আমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আর যদি আমার রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে তাহলে হয়তো অল্প চিকিৎসাতেই সেরে যাবে। আল্লাহ না করুক যদি একটা অ্যাটাক হয়ে যায় তাহলে আমি আমার জীবনটাকে শেষ করে দিলাম। আর সেখান থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা আমাকে করতে হবে।
রেডিও তেহরান: জনাব ডা. মো. তাইফুর রহমান হৃদরোগ নিয়ে চারপর্বের আলোচনায় রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ডা. মো. তাইফুর রহমান: জ্বি, আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ। সবার প্রতি আমার সালাম রইল। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন। সবাই ভালো থাকুন।
শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! হৃদরোগকে কোনোভাবেই হেলাফেলা করা যাবে না। হৃদরোগ হওয়ার আগেই আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। যদি হৃদরোগের কোনো লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা নিয়মিত ব্যয়াম করতে হবে। তো আমরা সবাই অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব এবং নিয়মিত ব্যয়াম করব তাহলে সুস্থ থাকব। স্বাস্থ্যকথার আজকের আসর এখানেই গুটিয়ে নিচ্ছি। সবাই ভালো ও সুস্থ থাকুন।#
অনুষ্ঠানটি গ্রন্থণা,প্রযোজনা ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১২