মে ২০, ২০২২ ১৭:২৫ Asia/Dhaka

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে আমি গাজী আবদুর রশীদ। স্তন ক্যান্সারের কথা এখন প্রায়ই শোনা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজারের বেশি মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে শতকরা ৯৮ শতাংশের বেশি নারী, তবে খুব অল্প সংখ্যক পুরুষও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।

প্রতি বছর প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ এ রোগে মারা যান। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের হারও। তো আমরা স্তন ক্যান্সার নিয়ে কয়েক পর্বে আলোচনা করব। আর আমাদের সঙ্গে আছেন কানাডা প্রবাসী বিশিষ্ট চিকিৎসক শাহনাজ কাজী।

রেডিও তেহরান: ডা. শাহনাজ কাজী, রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

ডা. শাহনাজ কাজী: রশীদ ভাই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

রেডিও তেহরান:  স্তন বা ব্রেস্ট ক্যান্সার কি?

ডা. শাহনাজ কাজী: দেখুন, মানুষের শরীরে কোষ বিভাজন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়। শরীরের অন্যান্য স্থানের মতোই যদি স্তনে কোনো কারণে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধি পায় সেক্সেত্রে কোনো চাকা বা পিন্ডের সৃষ্টি করে। একে আমরা টিউমার বলে থাকি। এই টিউমার সাধারণ দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে 'বেনাইন' । যা ক্ষতিকারক নয় এবং সেটা যেখানেই তৈরি হয় সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। আরেকটি হচ্ছে' ম্যালিগন্যান্ট'। একে আমরা ক্যান্সার বলে থাকি। এই ম্যালিগন্যান্ট অবশ্যই ক্ষতিকারক এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা এই স্তন ক্যান্সার কি নারী পুরুষ উভয়ের হতে পারে? বয়সভেদে কি তারতম্য হয়?

ডা. শাহনাজ কাজী: জ্বি এই ক্যান্সার নারী-পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। তবে নারীদের আক্রান্তের হার বহুগুণে বেশি। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই ক্যান্সারে মৃত্যুর ঝুঁকির হার বেশি। বয়সভেদে অবশ্যই তারতম্য হয়। বয়সের সাথে সাথে স্তন ক্যান্সার আনুপাতিক হারে বাড়ে। পশ্চিমা বিশ্বে মহিলাদের ৫০ বছরের পর এই স্তন ক্যান্সারের হার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আমাদের দেশে স্তনে ক্যান্সার আক্রান্তের হার কম বয়সী মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। মধ্য ত্রিশ থেকে অনেকের স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে।

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! আপনারা স্তন ক্যান্সার নিয়ে কানাডা প্রবাসী বিশিষ্ট ডাক্তার শাহনাজ কাজীর সাক্ষাৎকার শুনছিলেন। ফিরছি শিগগিরিই, আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: মিউজিক বিরতির পর আবারও ফিরে এলাম, ডা. শাহনাজ কাজী-আচ্ছা  স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কাদের বেশি?

স্তন ক্যান্সার

ডা. শাহনাজ কাজী: স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে মহিলাদের। এরপর বয়সভেদে এই ঝুঁকির কথা বল্লামই। বয়স একটি বড় ফ্যাক্টর। তারপর একটা জিনিষ আছে সেটি হচ্ছে জিন। জিনগত কারণে এটি হতে পারে। এখানে দুটি জিনের কথা বলা হয়ে থাকে। বিআরসিএ ওয়ান ও টু। এই জিন দুটির অস্বাভাবিক বিভাজনের ফলে শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ স্তন ক্যান্সারের হার বৃদ্ধি পেতে পারে।

বাংশগত কারণ: যেমন মা, খালা, বোন বা মেয়ে এদের কারও যদি স্তন ক্যান্সার থাকে তখন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এরপর 'মাসিক': মাসিক যদি বারো বছরের আগে শুরু হয় এবং পঞ্চাশ বছর পরও শেষ না হয় সেক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। তারমানে এখানে হরমোন বিশেষ করে স্ট্রোজেন হরমোন এখানে খুব বড় ভূমিকা রাখে। নিসন্তান নারীও একটি রিস্ক ফ্যাক্টর। বেশি বয়সে প্রথম সন্তান ধারণ করা। বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ানো। এরপর অনিয়মিত খাদ্যভ্যাস। যেমন ধরুন-শাকসবজী, ফলমূল না খাওয়া। চর্বি জাতীয় খাবার এবং প্রাণীজ আমিষ জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া। আরেকটি বড় কারণ হিসেবে আমরা বলতে পারি অতিরিক্ত ওজন। কায়িক পরিশ্রমে অনভ্যাস। কেউ যদি তামাক জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেন তার জন্যও ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে। আরো একটি বিষয় বলব কারও যদি স্তনে অস্বাভাবিকতা থেকে থাকে। এগুলোই হচ্ছে স্তন ( ব্রেস্ট ) ক্যান্সারের প্রধান ঝুঁকি।

রেডিও তেহরান:  স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি/ বা কিভাবে বোঝা যাবে স্তন ক্যান্সার হয়েছে?

ডা. শাহনাজ কাজী: স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলোর মধ্যে প্রথমে যেকথাটি বলব সেটি হচ্ছে স্তন বা ব্রেস্টে যদি ব্যথাবিহীন চাকা বা পিন্ড অনুভূত হয়। আমি যেকথাটি বলেছি সেটি কিন্তু খেয়াল করতে হবে। স্তনে ব্যথাবিহীন চাকা বা পিন্ড। এটি কিন্তু খুব ভয়ের ব্যাপার। স্তনের বোট ভেতরে ঢুকে যাওয়া। স্তনের বোটা থেকে অস্বাভাবিক রস বা রক্তমিশ্রিত রস বের হওয়া। স্তনের চামড়ায় যদি কোনো পরিবর্তন আসে। যেমন স্তনের চামড়াটা দেখতে কমলার খোসার মতো ফুটো ফুটো হয়ে যাওয়া বা রং পরিবর্তন হওয়া। বগোলে চাকা বা পিন্ড অনুভূত হওয়া। এগুলো হচ্ছে প্রধান লক্ষণ স্তন ক্যান্সারের।

রেডিও তেহরান: ডা. শাহনাজ কাজী, কেন স্তন ক্যান্সার হয়?

ডা. শাহনাজ কাজী: ব্রেস্ট টিস্যুতে বিনা কারণে অনিয়ন্ত্রিত এবং অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের ফলে স্তন বা ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়।

রেডিও তেহরান: আজকের পর্বের সবশেষ যে প্রশ্নটি করব সেটি হচ্ছে, কিভাবে স্তন ক্যান্সারের পরীক্ষা করা যাবে?

ডা. শাহনাজ কাজী: স্তন ক্যান্সারের পরীক্ষা সাধারণত দুইভাবে হয়ে থাকে।

১) ডায়াগোনস্টিক

২) স্ক্রিনিং

স্তন ক্যান্সার

ডায়াগোনস্টিক পরীক্ষাটা হচ্ছে যদি কারও কোনো লক্ষণ দেখা দেয় তবে জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা করাতে হবে। সেটাকে ডায়াগোনস্টিক পরীক্ষা বলে থাকি আমরা।

স্ক্রিনিং পরীক্ষা: এই পরীক্ষা তারাই করাবেন যাদের কোনো লক্ষণ নেই কিন্তু ঝুঁকি রয়েছে। তিন ধরণের স্ক্রিনিং পরীক্ষা করা হয়।

প্রথমটি হচ্ছে ম্যামোগ্রাম। ম্যামোগ্রাম একটি ব্রেস্ট স্ক্রিনিং টেস্ট যা এক্স-রে ইমেজের মাধ্যমে উভয় স্তনের টিস্যুতে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সনাক্ত করে। সনাক্তকরণযোগ্য অস্বাভাবিকতাগুলির মধ্যে ছোট ক্যালকুলেশন, সিস্ট এবং টিউমারগুলি অন্তর্ভুক্ত থাকে এটা ছাড়া স্তনের স্ব-পরীক্ষার সময় (B S E) সনাক্ত করা যায় না। ম্যামোগ্রামই হচ্ছে স্তন ক্যান্সার আছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য প্রথম পদক্ষেপ।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন। ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন (চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করানো)। এটা করানোর জন্য একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।  চিকিৎসক মহিলার  স্তন পরীক্ষা করবেন। ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিন বছরে একবার ও ৪০ বছর পার হলে প্রতিবছর একবার পরীক্ষা করাতে হবে।

তৃতীয় পরীক্ষা  সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন:  অর্থাৎ  রোগী নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করবেন। ২০ বছর বয়স হতে প্রতি মাসে একবার নিজেকে নিজে পরীক্ষা করা। সারা জীবন তা চালিয়ে যাওয়া। নিজের স্তনের স্বাভাবিকতা বুঝতে পারা, যাতে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে  দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যায়।

নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করার পদ্ধতি

নিজেকে নিজে পরীক্ষা করা একটি কারগরি বিষয়। প্রতি মাসে একবার। একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে নারী ঋতুচক্র শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা করলে ভালো হয়। কারণ, সে সময় স্তন কিছুটা হালকা থাকে এবং ব্যথা কম হয়। মেনোপজ হয়ে যাওয়া নারীরা যেকোনো দিন পরীক্ষা করতে পারেন।

প্রথমত

পরিষ্কার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পর্যাপ্ত আলোয় নিম্নের প্রতিটি অবস্থায় নিজেকে লক্ষ করুন।

১. দুই বাহু শরীরের দুই পাশে ঝুলিয়ে রাখুন

২. বাহুদ্বয় মাথার ওপরে বা পেছনে উঁচিয়ে ধরুন।

৩. দুই হাত কোমরে চাপ দিয়ে দাঁড়াতে হবে, যাতে বুকের মাংসপেশি টান টান হতে পারে। 

৪. স্তনবৃন্তে হালকা করে একটু চাপ দিয়ে দেখতে হবে, কোনো রস বের হয় কি না। 

দ্বিতীয়ত

হাত দিয়ে পরীক্ষা করে অনুভব করুন। দুই অবস্থানে থেকে দুইবারে এটি করতে হবে। 

১. বিছানায় শুয়ে। ডান হাত দিয়ে বাঁ স্তন এবং বাঁহাত দিয়ে ডান স্তন। যে পাশের পরীক্ষা করতে হবে, সে পাশের হাত মাথার ওপর রাখতে হবে, কাঁধের নিচে ছোট বালিশ বা তোয়ালে ভাঁজ করে দিতে হবে, যাতে বুক ও স্তন একই সমান্তরালে থাকে। অন্য পাশে অল্প কাত হয়ে শুতে হবে। এবার হাতে মাঝের তিন আঙুলের প্যাড দিয়ে প্রথমে একটু হালকা চাপ, পরে আরও ভারী চাপ, এরপর আরও চাপ দিয়ে স্তন সীমানার পুরো এলাকা অনুভব করতে হবে। যেন কোনো অংশ বাদ না যায়। স্তন টিস্যুতে চাপ রাখা আঙুলের প্যাড (ঘুরন্ত লাটিমের মতো) একটি অক্ষের ওপর কয়েকবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরীক্ষা করুন।

২. গোসলের সময় দাঁড়িয়ে। শরীরে সাবান মেখে একইভাবে পরীক্ষা করতে হবে। 

কোনো অসংগতি থাকলে তা আঙুলের পরীক্ষায় অনুভূত হয়। আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

সবার অনুভব করার ক্ষমতা সমান নয়। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন ঋতুবতী, গর্ভবতী, শিশুকে দুধদানকারী এবং মেনোপজ নারীর স্তন ও স্তনগ্রন্থি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কখনো কখনো স্তনে স্বাভাবিকভাবে চাকা চাকা অনুভব হতে পারে। জানা না থাকলে অকারণ ভীতির সৃষ্টি হয়। ঠিকভাবে সব স্থান পরীক্ষা না করা হলে রোগ এড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা দক্ষ চিকিৎসক দ্বারা দুই–তিন বছরে একবার পরীক্ষা করানো স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনুভব করার মতো চাকা থাকলে চিকিৎসকের পরীক্ষায় ভুল হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।

তো ডা. শাহনাজ কাজী স্তন ক্যান্সার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আর শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা!  স্তন ক্যান্সার নিয়ে  আজকের আসর এখানেই গুটিয়ে নিচ্ছি। আগামী আসরেও এ বিষয়ে আলোচনা হবে। সে আসরেও আমাদের সাথে থাকবেন বিশিষ্ট চিকিৎসক শাহনাজ কাজী। তখনও আমাদের সাথে থাকবেন বলে আশা করছি। একইসাথে  আহবান থাকছে স্তন ক্যান্সার নিয়ে হেলাফেলা করবেন না। লজ্জা করবেন না। যথাসময়ে চিকিৎসা করানো হলে কোনো ঝুঁকি থাকে না।  আপনারা সবাই স্বাস্থ্যসচেতন হোন এবং নিয়মিত ব্যয়াম করবেন, পুষ্টিকর খাবার খাবেন, বেশি বেশি বিশুদ্ধ পানি পান করবেন।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২০