জুন ৩০, ২০২২ ১৮:৪১ Asia/Dhaka

আজকের আলোচনা শুরু করব মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম সাদিক্ব (আ)'র একটি বাণী দিয়ে। তিনি বলেছেন: সংসারে স্বামীকে তার পরিবারের ব্যাপারে তিনটি বিষয় মেনে চলতে হবে যদি ওই তিনটি বিষয় বা গুণ তার স্বভাব বা প্রকৃতির মধ্যে নাও থাকে।

এ তিনটি বিষয় হল: সুন্দর আচরণ, পরিমিত বা স্বাভাবিক মাত্রায় দানশীলতা তথা পরিবারের জন্য স্বাভাবিক মাত্রায় অর্থ ও সম্পদ ব্যায়ের জন্য প্রস্তুত থাকা এবং পরিবারের সম্ভ্রম ও সম্মানের ব্যাপারে ধৈর্যশীলতা নিয়ে সংবেদনশীল ও সাহসী থাকা।

সমাজকে সজীব ও সুস্থ রাখতে হলে পরিবার ও পরিবার-ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পরিবার যদি বাইরের হুমকি ও উপদ্রপ থেকে নিরাপদ থাকে তাহলে তা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য অশেষ কল্যাণ ও শক্তির উৎস হয়। পরিবারবিহীন সমাজ অশান্ত ও অনিরাপদ। পরিবার না থাকলে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া যায় না এবং পরিবারকে সুশিক্ষিত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। পরিবারবিহীন সমাজ বা নড়বড়ে হয়ে পড়া পরিবারযুক্ত সমাজ প্রতিপালন ও সুশিক্ষার সর্বোত্তম কেন্দ্র হতে বঞ্চিত হবে।

পরিবার না থাকলে থাকবে না শিশু, থাকবে না কিশোর, থাকবে না মানুষ, থাকবে না নারী ও থাকবে না পুরুষ এবং থাকবে না নৈতিকতা। পরিবার না থাকলে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান এবং অতীতের মানুষদের রেখে যাওয়া মূল্যবান অভিজ্ঞতাগুলো পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কাছে পৌঁছবে না।  তাই পরিবারগুলোকে রক্ষা ও মজবুত করার ব্যাপারে সবারই সক্রিয় থাকা উচিত।

ইরানি পরিবার-ব্যবস্থায় ইসলামের বন্ধন ও ইরানি ঐতিহ্যের ছাপ অত্যন্ত সুদৃঢ়।  ইসলামী রীতি ও ঐতিহ্যগুলো ইরানের পরিবারগুলোকে শক্তিশালী করেছে এবং ইরানি ঐতিহ্যগুলোও ইসলামী রীতির পরিপূরক বা সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখছে। যেমন, ইরানের বিয়ের অনুষ্ঠানের রীতি ও ঐতিহ্যগুলো একদিকে যেমন ধর্মীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও অনুশাসনগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে তেমনি ইসলামী রীতিগুলোও পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধনগুলোকে সুদৃঢ় রেখেছে।

ইরানের যেসব পরিবার খুব একটা ধার্মিক নয় সেসব পরিবারও কখনও কখনও ধর্মীয় বিষয়গুলোকে বেশ গুরুত্ব দে। যেমন, তারা সন্তানদের বিয়ের বা আকদ্‌ অনুষ্ঠানের সময় তাদের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করেন মহান আল্লাহর কাছে। এ বিষয়টি তাদের পারিবারিক মায়া-মতা ও স্নেহের বন্ধনের দৃঢ়তাও তুলে ধরে। ইরানি সংস্কৃতির ওপর ইসলামী সংস্কৃতির গভীর প্রভাব ও কর্তৃত্বও এভাবে ফুটে ওঠে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। ইসলামী সংস্কৃতির ব্যাপক শক্তিমত্তা ও প্রাণসঞ্জীবনী ক্ষমতার বিষয়ও ফুটে ওঠে এমন অনুষ্ঠানগুলোতে।

ইরানি পরিবারগুলো সমাজবদ্ধ জীবন ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোকে বেশ গুরুত্ব দেয়। ইরানের বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠানগুলোই এর প্রমাণ। ঐতিহ্যবাহী নানা আনুষ্ঠানিকতা ও সমাবেশ ছাড়া এসব অনুষ্ঠানের কথা ইরানে কল্পনাও করা যায় না। এইসব অনুষ্ঠান ইরানি পরিবারগুলোকে ঐক্যবদ্ধ, সংহত ও কৃত্রিমতামুক্ত রেখেছে। ইরানি পরিবারগুলো স্নেহ-অনুভূতি ও মায়া-মমতায় টইটম্বুর। এইসব অনুভূতিকে ও ইরানি পরিবারগুলোকে সজীব রেখেছে বিয়ে-শাদি ও বিয়ের ভোজসভার মত নানা ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান বা রীতি ও প্রথা।  ইসলামের রীতি অনুযায় আক্‌দ্‌ হল দাম্পত্য জীবন শুরু করার ব্যাপারে নারী ও পুরুষের সম্মতি এবং এর সঙ্গে রয়েছে নানা বিধান বা আইনের মাধ্যমে বৈধতা অর্জনের বিষয় ও বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান।

ঐতিহ্যবাহী ইরানি পরিবারগুলোতে বিয়ের আক্‌দ্ অনুষ্ঠান করা হয় কনের বাবার বাড়ির ঘরের মেঝের ওপর বড় চাদর জাতীয় কাপড় বিছিয়ে। আর এই চাদরের মধ্যে পাশাপাশি বসেন বর ও কনে এবং এখানে বসেই তারা আক্‌দ্‌-এর খুতবা বা বক্তব্য শোনেন।    

সব মেহমান যখন আক্‌দ্‌ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন তখনই কনে ওই মজলিসে আসেন ও মেঝেতে বিছানো ওই বিশেষ চাদরের মধ্যে বসেন। বর হবু স্ত্রীর ডান পাশে বসেন। এই চাদরের মধ্যে ভেড়ার পশমের তৈরি এক টুকরা মোটা কাপড় বা রুমাল রাখা হয়  একটি সাদা কাপড়ের ওপর যা বংশ পরম্পরায় সংরক্ষণ করা হয়েছে কনের পরিবারে। এ ছাড়াও আক্‌দ্‌ অনুষ্ঠানের এই চাদরে পবিত্র কুরআন, ফুলের তোড়া এবং আরও অনেক কিছু রাখা হয় যেসবের সঙ্গে রয়েছে অনেক সুন্দর বিশ্বাস ও ধারণার সম্পর্ক।

যিনি আক্‌দ্‌-এর খুতবা পড়ান তিনি কনেকে প্রদেয় উপহার তথা মোহরানার কথাও উল্লেখ করেন আক্‌দ্‌ এর খুতবায়  যাতে কনে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে সন্তুষ্ট চিত্তে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা ঘোষণা করতে পারেন। কেউ কেউ মোহরানাকে কনের মূল্য বা কেনা-বেচার সামগ্রী বলে তুলনা করতে চান কিন্তু তা ঠিক নয়। মোহরানা হল কনের প্রতি আন্তরিকতার প্রকাশ হিসেবে প্রদেয় উপহার। এ জন্য মোহরানাকে আরবিতে সিদাক্ব বলা হয় যার অর্থ সত্য বা সঠিক কাজ। মোহরানা কনের সঙ্গে আলাপ করেই ঠিক করা হয়। মোহরানার রয়েছে নানা ধরন। যেমন, অর্থ বা স্বর্ণ মুদ্রা, বাড়ি, গাড়ি বা জমি জাতীয় সম্পদ, পবিত্র কুরআন কিংবা কোনো ভালো কাজ।  

ইরানে কনের যে কোনো মোহরানার সঙ্গেই পবিত্র কুরআনের কপি থাকেই। এটি ইসলামী এই দেশের অপরিহার্য রীতি। এই কুরআন নতুন পরিবারের জন্য সুখ ও সমৃদ্ধির গ্যারান্টির প্রতীক।  আক্‌দ্‌-এর খুতবায় বিয়ের গুরুত্ব সম্পর্কিত হাদিসও উল্লেখ করা হয় এবং এ সময় বর ও কনের মাথার ওপর জমাট-বাধা চিনির দুটি বড় টুকরো বা খণ্ডকে ঘষে ঘষে গুড়ো করা হয়। এরপর হাত তালি ও দরুদ শরিফ পাঠের মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ আনন্দ অনুষ্ঠান চলতে থাকে এবং বর ও কনে আংটি বিনিময় করেন। এরপর বর ও কনে পরস্পরকে মধু খাওয়ান দাম্পত্য জীবনকে মধুর করার প্রতীকী ইঙ্গিত হিসেবে। তারপর বর ও কনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা তাদেরকে দামি পাথর ও স্বর্ণ-অলংকার ইত্যাদি উপহার দেন। অন্যদিকে বর ও কনেও উপস্থিত সবাইকে ক্ষুদ্র কদমা জাতীয় মিষ্টি, সোনালী রংয়ের পয়সা ও কখনও ক্ষুদ্র পিরামিড আকৃতির জমাটবদ্ধ চিনির টুকরা উপহার দেন।

দাম্পত্য জীবনে সুখের এক অনন্য চাবি হল স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি সততা এবং সত্যবাদিতা।  মহানবী (সা) বলেছেন, যার মধ্যে তিনটি গুণ দেখতে পাবে তার ব্যাপারে আশাবাদী হতে পার। এই তিনটি গুণ হল, লজ্জাশীলতা, আমানতদারি বা বিশ্বস্ততা এবং সত্যবাদিতা।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/ ৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ