সুখের নীড়- পর্ব ১৪
মানব-কল্যাণের নানা দিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যারা সমাজে হয়েছেন খ্যাতিমান তাদের এইসব সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিশ্বাসী ও যোগ্য মা-বাবার তথা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার মানব-প্রকৃতির স্বাভাবিক চাহিদার প্রকাশ। মানুষের আত্মিক, স্বভাবগত ও প্রকৃতিগত চাহিদাগুলো অতীতেও যেমন ছিল বর্তমানেও তা আছে ও ভবিষ্যতেও তা বজায় থাকবে। আসলে ইসলামের বিধানগুলো মানুষের মানবীয় প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই ইসলামের বিরুদ্ধে চলা মানে মানব প্রকৃতির বিরুদ্ধেই চলা। পরিবারের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী পদক্ষেপও তাই মানবজাতির জন্যই হবে ধ্বংসাত্মক। ইসলাম বৈরাগ্যবাদকে মানব-প্রকৃতির বিরোধীই বলে স্বীকৃতি দেয় না। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য পরিবার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা জরুরি। পরিবার মহান আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন ও মানুষের জন্য অত্যন্ত বড় খোদায়ি উপহার। পরিবার গঠন ও সন্তান নেয়াকে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। এর বিপক্ষে প্রচলিত নানা অজুহাত, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিয়ে না করা বা সন্তান না নেয়ার ধারণাকে পবিত্র কুরআনে প্রত্যাখ্যান করেছেন মহান আল্লাহ। মহান আল্লাহ সুরা নুরের ৩২ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
ইরানি পরিবারগুলো সন্তানের বিয়েকে বেশ গুরুত্ব দেন। ইরানি বাবা-মায়ের জন্য তাদের সন্তানের বিয়ে ও বিবাহিত জীবনের সুখ দেখাটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। সন্তানদের বিয়ের জন্য সম্ভাব্য সব জিনিষ তারা সংগ্রহ করেন ও ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্বও পালনের চেষ্টা করেন অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে।
ইরানিদের বিয়ের অনুষ্ঠানের রীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা গত কয়েক পর্বে আক্দ্ অনুষ্ঠানের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছি। আক্দ্-এর চাদর যা মেঝেতে বিছানো হয় তাতে অনেক কিছু সাজিয়ে রাখা হয়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দ্রব্য বা আইটেম হল : একটি আয়না, এক জোড়া মোমদানি, পবিত্র কুরআন, ফুলসহ ফুলদানি, মিছরি বা সুগার কিউবের টুকরো ভর্তি পাত্র ইত্যাদি। আয়না রাখা হয় বর ও কনের মুখোমুখি স্থানে। এর উদ্দেশ্য হল বর ও কনে যেন পরস্পরকে দেখতে পারে এবং তাদের অন্তরের আয়নাও যেন হয় পরস্পরের প্রতি স্বচ্ছ। মোমদানি দু'টি থাকে আয়নার দুই বিপরীত দিকে। আলোকিত মোমবাতি প্রতীকি অর্থে বর ও কনের সম্পর্কের উষ্ণতা এবং ঔজ্জ্বল্য তুলে ধরে। আক্দ্-এর বিছানায় মিছরি বা সুগার কিউবের টুকরো ভর্তি পাত্র রাখার প্রতীকি অর্থ হল বর-কনের দাম্পত্য জীবনও যেন হয় সুমিষ্ট। এইসব পাত্র হয় বেশ সুসজ্জিত ও কখনও বর্ণাঢ্য ফিতা দিয়ে বাঁধা।
ইরানিদের বিয়ের আক্দ্-অনুষ্ঠানের চাদর বা বিছানার আরও আইটেম হল রুটি, পনির ও সবজি। এসব রাখাকে বরকতময় রিজিকের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। শাক-সবজি রাখার অর্থ তারুণ্য ও সুস্থতা। আজকাল ছোটো ছোটে প্যাকেটে বা খুব সুন্দর মোড়কে আক্দ্-এর বিছানায় এসব সাজিয়ে রাখা হয়। আক্দ্-এর চাদর বা বিছানায় মধুও রাখা হয়। একটি পাত্রে রাখা হয় এই মধু। আকদ্-এর খুতবা পড়ানো হয়ে গেলে বর ও কনে পরস্পরকে এই পাত্রের মধু মুখে তুলে খাইয়ে দেন। এখানেও এই প্রতীকী অর্থ বিবেচনায় রাখা হয় যে ভবিষ্যতে বর ও কনে সব সময় পরস্পরের জন্য মধুময় হয়ে থাকবেন। আক্দ্-এর চাদর বা বিছানার আরও আইটেম হল মুরগির ডিম। এটা হল অনাগত শিশু তথা নব প্রজন্মের জন্মের প্রতীক। সাধারণত কয়েকটি বা বেশ কয়েকটি ডিম খুব সুন্দর সাজে সাজিয়ে রাখা হয়। আক্দ্-এর চাদর বা বিছানায় স্বর্ণমুদ্রাও রাখা হয়। এটা রাখা হয় বরকনের রিজিক বৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে। এ ছাড়াও আকদ্-এর বিছানায় আখরোট ও বাদাম-ভর্তি পাত্র রাখা হয় পুষ্টিকর খোদায়ি নেয়ামত হিসেবে। অনেকে মনে করেন এসব রাখতে হবে খোসাসহ বা বাদামের দুই অংশের অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় যাতে নব দম্পতিও সব সময় অবিচ্ছিন্ন থাকেন।
ইরানিদের বিয়ের আক্দ্-অনুষ্ঠানের চাদর বা বিছানায় আইটেম হল ডালিম ও আপেল কিংবা আরও অনেক ফল রাখা হয় যার প্রতীকী অর্থ হল নব-দম্পতি যেন সব সময় খোদায়ি নেয়ামতের অধিকারী হন। তবে এই বিছানায় ফুলের তোড়ার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। এর প্রতীকি অর্থ প্রেম ও প্রফুল্লতার প্রাচুর্য। এ ছাড়াও ইস্পান্দ নামক এক ধরনের হার্বাল বা ভেষজ দানা পুড়িয়ে তার ধোঁয়া উড়িয়ে বর ও কনেকে আকদ্-অনুষ্ঠানের বিছানায় বসানো হয় যাতে অশুভ দৃষ্টি বা হিংসুকের হিংসার অনিষ্ট থেকে নব-দম্পতি মুক্ত থাকেন। দু'টি রাজহাঁসও এই বিছানায় রাখেন অনেকেই। এর কারণ হল রাজহাঁসের জুটি খুবই অবিচ্ছেদ্য এবং এ জুটির একটি মরে গেলেও ওই রাজহাঁস আর অন্য রাজহাঁসের জোড়ার সঙ্গী হয় না।
স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা মহান আল্লাহর এক বড় অনুগ্রহ। যেসব বিষয় বা কাজ এই ভালোবাসাকে গভীর করে সেসবের আশ্রয় বা প্রয়োগ করা উচিত বেশ দক্ষতার সঙ্গে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ কথা ও সম্বোধন স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসাকে গভীর করে। এ ধরনের আরও কয়েকটি মাধ্যম বা কাজ হল স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের মুচকি হাসি বিনিময় করা, চেহারা হাস্যজ্জোল রাখা, পরস্পরের প্রতি দয়ার্দ্র দৃষ্টিতে তাকানো, পরস্পরকে উপহার দেয়া, সুসজ্জিত থাকা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগ প্রকাশ করা।
ইমাম রেজা-আ. বলেছেন, যেসব নারী স্বামীকে ভালোবাসে ও স্বামীর প্রতি গভীর অনুরাগী হয় তারা মূল্যবান রত্নের মত। মহানবী-সা. বলেছেন, স্ত্রীর পাশে বসা বা সঙ্গে থাকাকে মহান আল্লাহ আমার মসজিদ তথা মসজিদে নববীতে এতেকাফ করার চেয়েও বেশি পছন্দ করেন। মহানবীর প্রতি হযরত খাদিযার ও হযরত খাদিযার প্রতি মহানবীর গভীর ভালোবাসা এবং আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী ও নবীনন্দিনী হযরত ফাতিমার পারস্পরিক গভীর ভালোবাসাও মুমিনের জন্য আদর্শ হয়ে আছে। মহাপুরুষরা পরিবারের ভেতরে ও বাইরে সব ক্ষেত্রেই মানুষের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/ ৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।