জুলাই ০৩, ২০২২ ১৮:৪৭ Asia/Dhaka

বন্ধুরা, 'জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানিদের অবদান' শীর্ষক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। ইউনেস্কোর উদ্যোগে চলতি ২০২২ সালে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান দিবস। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে এ দিবস পালনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইরানও এ দিবস পালন করে থাকে এবং এ দেশটিও জ্ঞান গবেষণায় পিছিয়ে নেই। তবে এ ক্ষেত্রে ইরানের বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে। ইরানে বহু জ্ঞানীগুণী, মনীষী ও বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে দেশটির ইতিহাস অনেক পুরানো। 'ইরানি মনীষী ও মনীষা' শীর্ষক নতুন ধারাবাহিক এ অনুষ্ঠানে আমরা ইরানে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস, বিজ্ঞানীদের অতীত ঐতিহ্য, তাদের নানা কর্মকাণ্ড, অবদান ও জীবনী নিয়ে আলোচনা করবো।

মানব সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ভূমিকা বা গুরুত্বের বিষয়টি কারো কাছেই অজানা নয়। এ কারণে রসায়ন, পদার্থ ও গণিতশাস্ত্র নিয়ে গবেষণার প্রতি মানুষের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। শিক্ষাঙ্গনের বিভিন্ন স্তরে এসব বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব গবেষণা কেন্দ্রে বিজ্ঞানের বিভিন্ন জটিল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়। ইউনেস্কো প্রতিবছর 'টেকসই উন্নয়নে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান দিবস' পালনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে যাতে মানুষ মৌলিক বিজ্ঞান অর্থাৎ পদার্থ, রসায়ন, গণিত, ভূগোল, পরিবেশ ও জীববিদ্যা, পরিসংখ্যান, জেনেটিক বা বংশগতি বিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে ওঠে। মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটানো, সমাজের মানুষের কাছে বিজ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং বিভিন্ন দেশে মৌলিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা ও বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবারের ইউনেস্কোর ঘোষিত বিজ্ঞান দিবসের অন্যতম লক্ষ্য।

উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বেসিক সায়েন্স বা 'মৌলিক বিজ্ঞান'। উদাহরণ স্বরূপ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে খাদ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের কথা উল্লেখ করা যায় যাতে মানুষ উপকৃত হতে পারে। একই সাথে সবার উচিত বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের টিকে থাকার জন্য এসব ক্ষেত্রে গবেষণার গুরুত্ব উপলব্ধি করা। বাস্তবতা হচ্ছে, 'মৌলিক বিজ্ঞান' প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা কিনা নতুন নতুন আবিষ্কারে সহায়ক।   

ইরানে বৈজ্ঞানিক উৎপাদন ও অগ্রগতির ইতিহাস জানতে হলে অতীতের সোনালী দিনগুলোর দিকে ফিরে যেতে হবে। এ ছাড়া, গত শতাব্দিতে বিজ্ঞান, গবেষণা ও আধ্যাত্মিকতার কারণে ইরান বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিল। এমনকি সাহিত্য  অঙ্গনেও ইরানের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। ইরানের বিখ্যাত কবি রুদাকির কবিতা ও সাহিত্য থেকে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, তুমি যদি জ্ঞানচর্চা কর তাহলে মহাকাশের বহু রহস্য তোমার কাছ উন্মোচিত হবে। ইসলাম ধর্মেও জ্ঞানচর্চা ও লেখা পড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। 

বৃহত্তর ইরানের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শিল্প, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান চোখে পড়ার মতো। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বিশেষ অবস্থানের কারণে ইরান বহুবার বহি:শক্তির মাধ্যমে হামলার শিকার হয়েছে। কিন্তু শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বাইরের কোনো শক্তি ইরানে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি বরং আক্রমণকারীরাই ইরানের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এ কারণে কথাবার্তা ও আচরণের ক্ষেত্রে অনেক আদব কায়দা, সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে সৌজন্যমূলক অনেক শব্দের ব্যবহার এবং ইরানের সাংস্কৃতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় অন্যান্য জাতির সংস্কৃতিতে।

প্রাচীন ইরান তথা ইসলামের প্রাথমিক যুগে জ্ঞানবিজ্ঞানের সূতিকাগার হিসেবে  বিশ্বজুড়ে এ দেশটির খ্যাতি ছিল। আজকের যুগে চিকিৎসা শাস্ত্র, গণিত, দর্শন, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব উন্নয়ন ও অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করছি তার পেছনে সে সময়কার ইরানি মনীষীদের বিরাট অবদান রয়েছে। এ প্রসঙ্গে রসায়ন ও অ্যালজেবরা শাস্ত্রে ইরানি মনিষীদের অবদানের কথা উল্লেখ করা যায়।                                                                                

উদাহরণ স্বরূপ, ইরানের খ্যাতনামা মনীষী মুসা আল খাওয়ারিজমির কথা  উল্লেখ করা যায় যিনি অ্যালগরিদম বা বীজগণিত তথা অ্যালজেবরার জনক ছিলেন। তিনি প্রথম তার একটি বইয়ে এই অ্যালজেবরার নাম উল্লেখ করেন। বইটির নাম হলো ‘আল জাবর ওয়াল মুকাবিলা'। তিনি ভারতীয় ও পার্সিয়ান হিসাব গ্রহণ বা গণনাপদ্ধতির মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন একটি গণনা পদ্ধতি চালু করেছিলেন। এ কারণে তখনকার সময়ে ইউরোপীয়রা তাদের নিজস্ব গণনা পদ্ধতি বা যন্ত্র থেকে সরে এসে নতুন এ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল।

তার হাতেই বীজগণিত পরে আরও সমৃদ্ধ হয়। বর্তমান যুগ পর্যন্ত গণিতবিদ্যায় যে উন্নয়ন এবং এর সহায়তায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে উন্নতি ও আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে তার মূলে রয়েছে আল খাওয়ারিজমির উদ্ভাবিত গণিতবিষয়ক নীতিমালারই বেশি অবদান। তার রচিত বই ‘আল জাবর ওয়াল মুকাবিলা’ থেকে বীজগণিতের ইংরেজি নাম অ্যালজেবরা উৎপত্তি লাভ করে। মুসা আল খাওয়ারিজমির এ আবিষ্কার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।

ইরানে চিকিৎসাবিদ্যা ও গবেষণার ইতিহাস অনেক পুরানো এবং এ ক্ষেত্রে দেশটি বেশ সমৃদ্ধ। প্রাচীন ভারত ও গ্রিসের চিকিৎসা শাস্ত্রে ইরানের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে ইরানের জান্দি শাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করা যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ছিল একটি হাসপাতাল এবং এটি ছিল তৎকালীন সময়ের প্রথম চিকিৎসা বিষয়ক শিক্ষাকেন্দ্র। মেডিকেল তথা চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতেন। ভারত, গ্রিসসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা ইরানের জান্দি শাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতো  পড়াশোনা করার জন্য। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এও দাবি করতেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সাফল্যের কারণে সেখানে প্রথম হাসপাতাল ব্যবস্থা চালু হয়েছিল যা ইরানিদের জন্য ছিল গর্বের বিষয়।

খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দিতে ইরানের আরেক খ্যাতনামা চিকিৎসা বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ ও দার্শনিক ছিলেন মোহাম্মদ জাকারিয়া রাজি। তিনি বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন রকমের ওষুধ আবিষ্কারের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। চোখ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করার কারণে চক্ষু রোগ চিকিৎসার পথপ্রদর্শক বলা হয়ে থাকে তাকে। চোখের রেটিনার যে দশটি লেয়ার আছে তা তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/মো.আবুসাঈদ/৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ