ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব-৬
হুসাইন আমার থেকে ও আমি হুসাইন থেকে: মহানবী-সা.
শোকাবহ মহররম উপলক্ষে ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার ষষ্ঠ পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।
ইমাম হুসাইনের আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মূল্য এত অসীম ও ব্যাপক যে তা চিন্তা করতেও ভাবনাগুলো যেন খেই হারিয়ে ফেলে। মানবতা ও ইসলামের প্রাণ যখন নিভু নিভু, এর আত্মা যখন নরপিশাচদের পাল্লায় পড়ে চরম কলুষতার শিকার হচ্ছিল তখন ইমাম হুসাইন-আ. ও তাঁর অল্প একদল সঙ্গী যেন মৃতসঞ্জীবনী শরবত নিয়ে একে বাঁচানোর ব্যবস্থা করলেন।
ধর্ম-ব্যবসায়ীদের হাত থেকে ও ইসলামের নামে ভোগবাদী স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে মহান সংগ্রামী ও ন্যায়বিচারকামী সত্যিকারের ইসলামকে ফিরিয়ে আনতে ইমামের ওই নজিরবিহীন আত্মত্যাগ এতটা জরুরি হয়ে পড়েছিল যে তা না হলে সত্যিকারের ইসলাম আজ থাকতো কেবল যাদুঘরে অথবা কিতাবের পাতায় এবং ইসলামের নামে মাঠে-ময়দানে যা থাকতো তা দেখে মানুষ বলতো এমন বিষাক্ত আফিমের মাদকাসক্তি ও নির্ভেজাল সন্ত্রাসবাদ কোনো মানুষের ধর্ম হতে পারে না, এমন বিষাক্ত সুফিয়ানি-মারোয়ানি-মুয়াবিয়ায়ি ও ইয়াযিদি ধর্ম পশুত্বেরও অনেক নিম্নস্তরের জিনিষ!
ইমাম হুসাইনের আন্দোলনের অশেষ গুরুত্ব তুলে ধরতেই মহানবী-সা হয়তো বলেছিলেন, হুসাইন আমার থেকে ও আমি হুসাইন থেকে! এ ছাড়াও তিনি বলেছিলেন, হুসাইন মিসবাহুল হুদা তথা হেদায়াতের প্রদীপ এবং সাফিনাতুন নাজাত তথা নাজাতের তরী!
কবি নজরুল বলেছেন, আঁজলা ভরে আনলো কি 'প্রাণ' (মহাশক্তি) কারবালাতে বীর শহীদান!
ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগের ফলে মানুষের ঘুমন্ত ও সুপ্ত ইমান জেগে ওঠে আগ্নেয়গিরির সুপ্ত লাভার মত। ফলে তৎকালীন মুসলিম জাহানের বহু মানুষ তাদের অবহেলার জন্য এত বেশি অনুতপ্ত হল যে তারা শহীদ হওয়ার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে যান। ইতিহাসে এই দল তাওয়াবিন তথা তওবাকারী বা অনুতপ্ত নামে পরিচিত। এ ছাড়াও মহামতি মুখতার ন্যায়বিচারপন্থী ও মুক্তিকামী মুসলমানদের সুসংগঠিত করে কারবালার সব ঘাতকদের শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ নিয়ে সফল হন এবং কিছু সময়ের জন্য ন্যায়বিচারকামী একটি ইসলামী হুকুমাতও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
সেদিন ইমাম হুসাইন যদি আজকের যুগের কোনো কোনো তথাকথিত মুসলিম বিশ্বের নেতার মত কৌশল বা হেকমাতের কথা বলে জিহাদ ও শাহাদাতের পথ এড়িয়ে যেতেন তাহলে ইসলাম আজ হয়ে পড়ত কেবল ভীরু কাপুরুষ ও আপোষকামীদের ধর্ম ! অবশ্য হুসাইনি আদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে ও কারবালা বিপ্লবের প্রকৃত ইতিহাসের চর্চা না হওয়ার কারণে আজও অনেকেই মহানবী, হযরত আলী ও ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন সম্পর্কে অবমাননাকর নানা ভিত্তিহীন কাহিনী প্রচার করে এবং একদল সরলমনা মানুষ সেসব বিশ্বাসও করে।
যেমন, বিষাদ-সিন্ধু নামক উপন্যাসে দেখানো হয়েছে যে নারী-কেন্দ্রীক বিরোধকে কেন্দ্র করে তথা ইয়াজিদের পছন্দের একজন নারীকে ইমাম হাসান বিয়ে করায় নবী-পরিবারের সঙ্গে ইয়াজিদের বিরোধ শুরু এবং এ জন্যই ইয়াজিদ ষড়যন্ত্র করে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমাম হাসানকে হত্যা কর। আর এ জন্যই ইমাম হুসাইন প্রতিশোধ নিতে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কারবালায় শহীদ হন।
অথচ ইমাম হাসান ইয়াজিদের রাজত্বকালে জীবিতই ছিলেন না, মুয়াবিয়ার রাজত্বকালে মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্রেই তিনি শহীদ হন। ইমাম হাসান-আ. তাঁর এক স্ত্রীর বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ হলেও ওই স্ত্রী ইয়াজিদের পছন্দের ছিলেন বিষাদ সিন্ধুর এমন তথ্যও বানোয়াট। বিষাদ-সিন্ধুতে আরও তুলে ধরা হয় যে নবী-পরিবারের ওপর হত্যাকাণ্ডসহ যা কিছু হয়েছে তা দুর্ভাগ্যের কারণেই হয়েছে যা নির্ধারণ করেছেন স্বয়ং আল্লাহ, ফলে পাঠকরা ভাবতে বাধ্য হয় যে বাস্তবে কারবালার ঘটনায় মুয়াবিয়া- ইয়াজিদ চক্রের কোন দোষ নেই! ইমাম হাসান ও হুসাইনের প্রতি মুয়াবিয়ার নাকি গভীর ভালোবাসা ছিল এটাও এই কাল্পনিক উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে যা পুরোপুরি বানোয়াট! এ ছাড়াও ইমাম জাইনুল আবেদিন ও মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া ইবনে হযরত আলী সম্পর্কে অবমাননাকর বানোয়াট গল্পসহ নানা বানোয়াট গল্প জুড়ে দেয়া হয়েছে এ উপন্যাসে!
এবারে সংক্ষেপে কারবালা বিপ্লবের সংক্ষিপ্ত সত্য ইতিহাস তুলে ধরছি। হযরত আলীর (আ.) শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (আ.) খলীফা হন। কিন্তু মু‘আবিয়া হযরত আলীকে অস্বীকার করার মত ইমাম হাসানকেও খলিফা বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে। ইমাম হাসান মু‘আবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে বের হন। কিন্তু মু‘আবিয়া অর্থ-সম্পদ ও পদমর্যাদার প্রলোভন দেখিয়ে ইমাম হাসানের সৈন্যদের কিনে নেয়। এমনকি ইমাম হাসানের প্রধান সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসও রাতের অন্ধকারে নিজের দীন বিক্রি করে মু‘আবিয়ার দলে যোগ দেয়। ফলে ইমাম হাসান মু‘আবিয়ার সাথে সন্ধি করেন। সন্ধির অন্যতম শর্ত ছিল মু‘আবিয়ার মৃত্যুর পর খেলাফত ইমাম হাসানের কাছে আসবে। আর তিনি জীবিত না থাকলে তা ইমাম হুসাইনের কাছে আসবে। কিন্তু মু‘আবিয়া মৃত্যুর পূর্বেই সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে তাঁর ফাসেক পুত্র ইয়াযীদকে মুসলমানদের খলিফা মনোনীত করে। মু‘আবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াযীদ খলিফা হয়। সে মদীনার গভর্নরকে নির্দেশ দেয় যাতে সে ইমাম হুসাইনের কাছ থেকে তার খেলাফতের পক্ষে স্বীকারোক্তি আদায় করে।
কিন্তু ইমাম হুসাইন-আ. ইয়াযীদকে খলীফা বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং তাঁর দীনি আন্দোলন শুরু করেন। তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে চলে যান। সেখানে অবস্থানকালে তাঁকে কুফায় গিয়ে নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে কুফা থেকে হাজার হাজার চিঠি পাঠানো হয়। অন্যদিকে হজ্বের সময় তাঁকে গুপ্তঘাতক দিয়ে হত্যা করা হবে জানতে পেরে তিনি হজ্ব অসমাপ্ত রেখেই কুফার দিকে রওনা হন। পথিমধ্যে ইয়াযীদের সেনাবাহিনী ইমামের কাফেলাকে বাধা দিয়ে কারবালায় নিয়ে আসে। এখানে ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্য এবং সঙ্গী-সাথীসহ তিন দিনের পিপাসার্ত অবস্থায় হাজার হাজার শত্রুসৈন্যের মোকাবিলায় যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের নারী ও শিশুদের তাঁবুগুলোতে ইয়াযীদের সেনারা আক্রমণ চালিয়ে লুটপাট করে এবং পরে অগ্নিসংযোগও করে। ইমাম হুসাইনের একমাত্র জীবিত পুত্র ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ও ইমাম হুসাইনের বোন হযরত যায়নাবসহ সকলকে বন্দি করা হয়। তাঁদের হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে প্রতিটি জনপদ ও বাজারে ঘুরিয়ে প্রথমে কুফায় উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের দরবারে ও পরে দামেশ্কে ইয়াযীদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। ইয়াযীদের সৈন্যরা যাত্রাপথে ইমাম হুসাইনসহ তাঁর সঙ্গীসাথীদের কাটা মাথাগুলো বর্শায় বিদ্ধ করে এ বন্দি কাফেলার সম্মুখভাগে বহন করে যাতে ইমাম-পরিবারের সদস্যদের দুঃখ আরও বৃদ্ধি পায়। ইয়াযীদের দরবারে ইমাম হুসাইনের পবিত্র মাথা একটি পাত্রে রাখা হলে ইয়াযীদ উল্লাস প্রকাশ করে।
ইয়াযীদ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-কে হত্যা করতে চায়, কিন্তু হযরত যায়নাবের সাহসী ভূমিকার কারণে সে এ কাজ হতে বিরত হয়। কিছুদিন বন্দি অবস্থায় রাখার পর ইমাম হুসাইনের পরিবার-পরিজনকে মদীনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।#
পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।