আগস্ট ০৪, ২০২২ ১৫:৪৭ Asia/Dhaka

শোকাবহ মহররম উপলক্ষে ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার সপ্তম পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।

 

গত পর্বের আলোচনায় আমরা কারবালা বিপ্লবের ইতিহাস নিয়ে বানোয়াট গল্প বা কিসসা-কাহিনীর অস্তিত্ব সম্পর্কে কথা বলেছি। এ প্রসঙ্গে ব্যাপক প্রচলিত বাংলা উপন্যাস বা বই বিষাদ-সিন্ধুতে উল্লেখিত কয়েকটি ভিত্তিহীন ধারণা, গল্প ও তথ্য তুলে ধরেছি। বিষাদ-সিন্ধুতে উল্লেখিত আরেকটি বানোয়াট তথ্য হল হযরত আলীর পুত্র মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়ার সাথে শিমারের যুদ্ধ! না, বাস্তবে শিমারের সঙ্গে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়ার কোনো যুদ্ধ হয়নি এবং তিনি শিমারকে শাস্তিও দেননি, বরং মুখতার সাকাফি যখন কুফার শাসন-ক্ষমতা থেকে বনি উমাইয়্যাকে উচ্ছেদ করেন তখন তিনিই শিমার, উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদসহ ইমাম হুসাইনের হত্যাকাণ্ডে জড়িত মূল হোতাদের প্রায় সবাইকে শাস্তি দেন ও হত্যা করেন। তবে ইয়াজিদ মুখতারের উত্থানের কয়েক বছর আগেই মারা যায় এবং তার মৃত্যুর ধরণ বা অবস্থা নিয়েও নানা ধরনের বর্ণনা রয়েছে। যেমন, মাতাল অবস্থায় টয়লেটে পড়ে গিয়ে বা ঘোড়া থেকে পড়ে কিংবা আগুনে পুড়ে অথবা মারাত্মক রোগে ভুগে মৃত্যু ইত্যাদি।

অনেকেই এমন ধারণা রাখেন ও প্রচার করেন যে ইমাম হুসাইন (আ) উম্মতের পাপের বোঝা কাঁধে নিতেই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন যাতে মহানবীর উম্মতের কাউকেই পাপের জন্য শাস্তি পেতে না হয়! এটাও একটি ভিত্তিহীন ধারণা বা অযৌক্তিক বিশ্বাস!  যদি তা-ই হতো তাহলে তিনি বলতেন, আমার শাহাদাতের পর মুসলমানরা তোমরা যত খুশি পাপ কর, কারণ তোমাদের পাপের বোঝা বহনের কাজ আমার শাহাদাতের মাধ্যমে হয়ে যাচ্ছে!

ইমাম হুসাইন (আ) সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নির্দেশ প্রদানের কুরআনি বিধান বাস্তবায়ন করতে ও তাঁর নানা উম্মতের সংস্কার সাধন করতেই বিপ্লব করেছিলেন বলে নিজেই উল্লেখ করেছেন। তাঁর ওই বিপ্লব বা আন্দোলন না ঘটলে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত বা যা থাকতো তা হতো নামে-মাত্র ইসলাম!

ইমাম হুসাইন-আ. শিখাতে চেয়েছেন যে কখনও কখনও শহীদি মৃত্যু ছাড়া প্রকৃত জীবন ও সম্মানজনক জীবন অর্জন করা যায় না। শহীদি মৃত্যু  ঘন অন্ধকারেও এনে দেয় মুক্তির দিশা যেন ঘন-অন্ধকারে সূর্যের আলোর তীব্র ঝলকানি। আকাশচুম্বী জুলুম আর স্বৈরাচারের মাঝে ন্যায়ানুগতার বজ্র আওয়াজ তোলার নবুওতি মিশনকেই অব্যাহত রাখতে বিপ্লব করেছিলেন শহীদ-সম্রাট ইমাম হুসাইন-আ.। তাঁর বিপ্লব দিশাহারা উম্মতের চরম স্থবিরতার মাঝে বিশ্ব-বিবেককে দিয়েছিল প্রচণ্ড ধাক্কা, অসীম ঝাঁকুনি।  যখন সবাই ছিল ইয়াজিদের জুলুমের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত তখন এ মহান ইমাম হতাশ জগতের পিন-পতন নিস্তব্ধ নীরবতার মাঝে হঠাৎ গর্জে ওঠেন এবং মিথ্যার ঘুম-পাড়ানি গানে নির্জীব ঘুমন্ত-জাতির মধ্যে আপোষের শৃঙ্খল-ছেড়ার হায়দারি হাঁক হাঁকেন। তিনি বজ্রকন্ঠে সত্যবাণীর স্লোগান তুলে মিথ্যাকে তলিয়ে দেয়ার দুনিয়া-কাঁপানো ডাক দিয়েছিলেন বলেই তা অমরত্ব পেয়েছে।

ইমাম হুসাইন-আ পবিত্র কুরআনের এ বাণীর বাস্তবায়নও তুলে ধরতে চেয়েছেন যে বাণীতে বলা হয়েছে: আল্লাহ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না সেই জাতি নিজেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় বা সেজন্য সচেষ্ট হয়।

তিনি পবিত্র কুরআনের এ বাণীর বাস্তবায়নও তুলে ধরতে চেয়েছেন যে বাণীতে বলা হয়েছে: তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর তবে আল্লাহও তোমাদের সাহায্য করবেন।

ইমাম হুসাইন-আ পবিত্র কুরআনের এ বাণীর বাস্তবায়নও তুলে ধরতে চেয়েছেন যে বাণীতে বলা হয়েছে: মানুষ কি মনে করেছে যে, আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেয়া হবে?

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে মানুষকে ভয়, রোগ-শোক, অভাব ইত্যাদি আরও অনেক মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন যাতে বোঝা যায় যে কারা প্রকৃত ঈমানদার ও আল্লাহর পথে অবিচল ও ধৈর্যশীল। ইমাম হুসাইনের বিপ্লবও আমাদের তা স্মরণ করিয়ে দেয়।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে মুমিনদের জীবন বেহেশতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহর পথে সংগ্রামের ময়দানে বা জিহাদের ময়দানে জীবন দান করলে মহান আল্লাহ এর বিনিময়ে বেহেশত প্রদান করবেন যদিও আমাদের জান ও মাল সব কিছুরই মালিক আল্লাহ। ইমাম হুসাইন আ. এই জিহাদি সংস্কৃতি ও শাহাদাতের সংস্কৃতিকেই চালু করতে চেয়েছিলেন মুসলমানদের মধ্যে। অবশ্য ইমাম সে রকম সহজ জিহাদে যোগ দেননি যে জিহাদে যাওয়া সবার জন্য সহজ ও সবাই দলে দলে খুশি মনে হাসতে হাসতে শত্রুর মোকাবেলায় বিজয়ের সুনিশ্চিত আশা নিয়ে কিংবা ব্যাপক গণিমত লাভের আশা বুকে নিয়ে এবং কোনো ধরনের ক্ষুধা ও তৃষ্ণা বা অসম যুদ্ধের ভয় না রেখেই এগিয়ে যান। ইমাম হুসাইন চেয়েছিলেন ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্য তাঁর সব কিছু বিলিয়ে দিতে যাতে মুসলমানদের মধ্যে গাফিলতি ও অচৈতন্যের অমানিশার আঁধার দূর হয়ে যায়। তাঁর মহান সঙ্গীরাও সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের জীবন দিয়ে জাতির বিবেককে জাগিয়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কবি ফরুরুখ আহমদ যেমনটি লিখেছেন: হোক দুশমন অগণন তবু হে সেনানী! আজ দাও হুকুম/মৃত্যু সাগরে ঝাপ দিয়ে মোরা ভাঙবো ক্লান্ত প্রাণের ঘুম!

হ্যাঁ, শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইন-আ. ও তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাত স্থবির ও নিশ্চল হয়ে পড়া তৎকালীন ইসলামী সমাজের শিরায় শিরায় রক্ত সঞ্চালনে সক্ষম হয়েছিল এবং বিকৃত হয়ে পড়া ইসলাম আবারও ধীরে ধীরে তার আসল রূপ ফিরে পেতে থাকে। আজ পর্যন্ত যত মানুষ শহীদ সম্রাট ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য যত চোখের পানি ফেলেছে তত পানি কখনও ফেলেনি ও ফেলবেও না  কিয়ামত পর্যন্ত এবং সেসব পানি জমা করলে হয়তো একটি বড় সাগরের রূপ নেবে! আর এই শোকই যুগে যুগে পরিণত হচ্ছে মহাশক্তিতে যে মহাশক্তির জোয়ারে ভেসে গেছে সাম্রাজ্যবাদের কত আগ্রাসন ও কত তাগুতি ও জালিম সরকার। পরমাণু শক্তিসহ জাগতিক সব শক্তি এই মহাশক্তির কাছে অসহায়! ইরানের ইসলামী বিপ্লবও এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। সে যুগে কারবালার মহবিপ্লবের ফলে সঞ্চারিত ইসলামী প্রাণশক্তির পুনরুজ্জীবনে উমাইয়্যাদের সাম্রাজ্য নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। ফলে এ মহাবিপ্লবের পর নবী-বংশের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য শুরু হয় আন্দোলন। আব্বাসীয়রা নবিজীর আহলে-বাইতপন্থীদের সমর্থন নিয়ে উৎখাত করে বনি উমাইয়্যাদের, অবশ্য তারাও নবী-বংশের কাছে ক্ষমতা না দিয়ে নিজেরাই ক্ষমতা দখল করে বসে।#

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।