আগস্ট ১৪, ২০২২ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জারিয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির। মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরায় পার্থিব জীবন ও পরকাল, সৃষ্টজগতে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের নির্দশন, কয়েকজন নবীর কাহিনী এবং পথভ্রষ্ট কিছু জাতির পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। এই সূরার ৩৮ থেকে ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَفِی مُوسَى إِذْ أَرْسَلْنَاهُ إِلَى فِرْعَوْنَ بِسُلْطَانٍ مُبِینٍ ﴿٣٨﴾ فَتَوَلَّى بِرُکْنِهِ وَقَالَ سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ ﴿٣٩﴾ فَأَخَذْنَاهُ وَجُنُودَهُ فَنَبَذْنَاهُمْ فِی الْیَمِّ وَهُوَ مُلِیمٌ ﴿٤٠﴾

“আর আমি মূসার [বৃত্তান্তেও নিদর্শন ও শিক্ষা রেখেছি] যখন আমি তাকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ ফেরাউনের নিকট প্রেরণ করেছিলাম।”(৫১:৩৮)

“তখন ফেরাউন তার ক্ষমতা ও সেনাবাহিনীর অহংকারে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এ ব্যক্তি হয় এক জাদুকর, না হয় উন্মাদ।”(৫১:৩৯)

“কাজেই আমি তাকে ও তার সেনাদলকে আমার [ক্রোধের] শিকার করি এবং ওদের সাগরে নিক্ষেপ করি, আর [সে যে শত্রুতা ও একগুঁয়েমি করত তার কারণে] সে ছিল তিরস্কার পাওয়ার যোগ্য।” (৫১:৪০)

গত আসরে আমরা লুত জাতির ওপর আল্লাহ তায়ালার আজাব সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এরপর আজকের এই তিন আয়াতে অত্যাচারী শাসক ফেরাউন ও তার সেনাদলের পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।  বলা হচ্ছে, হযরত মূসা (আ.) নিজের জাতি- বনি ইসরাইলের কাছে না গিয়ে প্রথমে ফেরাউনের কাছে যান। কারণ, ফেরাউন বনি-ইসরাইল জাতির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তাদের ওপর নির্যাতন চালাত এবং এই জাতির নারী ও পুরুষদের দাস-দাসী করে রেখে দিয়েছিল। এ কারণে, আল্লাহর নির্দেশে হযরত মূসা (আ.) বনি-ইসরাইল জাতিকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রথম এই অত্যাচারী শাসকের কাছে যান। ফেরাউনের দরবারে তিনি বিভিন্ন মুজিযা ও সুস্পষ্ট দলিল উপস্থাপন করে নিজের নবুওয়াতের প্রমাণ তুলে ধরেন। কিন্তু ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গ হযরত মূসার কথা মেনে নিতে রাজি হলো না। তারা বরং হযরত মূসাকে যাদুকর ও উন্মাদ বলে ভর্ৎসনা করল। এই অপরাধের কারণে অবশেষে ফেরাউন ও তার সেনাদলের উপর আল্লাহর শাস্তি নেমে এল এবং তাদের পালানোর কোনো পথ ছিল না।  তাদের সকলে নীল নদের পানিতে ডুবে মরল এবং এর ফলে পরবর্তী যুগের মানুষের জন্য ফেরুউনের জীবনে রয়ে গেল শিক্ষা।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- অত্যাচারী ও জালিমদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেওয়া নবী-রাসূলদের অন্যতম দায়িত্ব।

২- অত্যাচারী শাসকরা সমাজ সংস্কারের জন্য আগত নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে এবং আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের যাদুকর, উন্মাদ ও বিকৃত-মস্তিষ্ক বলে প্রচার চালায়।

৩- পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শাসকও আল্লাহর ইচ্ছার সামনে অসহায়। কাজেই আমাদের উচিত আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভর করা এবং পৃথিবীর অন্য কোনো শক্তিকে ভয় না পাওয়া।

সূরা জারিয়াতের ৪১ থেকে ৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَفِی عَادٍ إِذْ أَرْسَلْنَا عَلَیْهِمُ الرِّیحَ الْعَقِیمَ ﴿٤١﴾ مَا تَذَرُ مِنْ شَیْءٍ أَتَتْ عَلَیْهِ إِلا جَعَلَتْهُ کَالرَّمِیمِ ﴿٤٢﴾

“আর [নিদর্শন রয়েছে] আদ জাতির [ঘটনাতেও], যখন আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম অকল্যাণকর ও বিধ্বংসী বায়ু।” (৫১: ৪১)

“[এই বায়ু] যা কিছুর উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল তাকেই [পঁচে যাওয়া হাড়ের মতো] চূৰ্ণ-বিচূর্ণ ধ্বংসস্তুপে পরিণত না করে ছাড়েনি।” (৫১: ৪২)

হযরত হুদ (আ.) ছিলেন আদ জাতির কাছে প্রেরিত আল্লাহর নবী। আদ জাতি আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে বসবাস করত এবং শারিরীক গঠনের দিক দিয়ে তারা ছিল অনেক লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী। পাহাড়ের ভেতরে পাথর খোদাই করে বিশাল বিশাল ভবন ও প্রাসাদ নির্মাণ করতে তাদের জুড়ি ছিল না। কিন্তু তারা আল্লাহর নবীর আনুগত্য করার পরিবর্তে অত্যাচারী শাসকদের কথা মেনে চলত। বারবার তাদেরকে সতর্ক করা সত্ত্বেও তারা যখন সত্যের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রচণ্ড রকম ঝঞ্ঝা বায়ু এসে আদ জাতির বসতিতে আঘাত হানে এবং সুঠাম দেহের অধিকারী মানুষগুলোকে খড়-কুটার মতো উড়িয়ে নিয়ে আবার ভূপৃষ্ঠে আছড়ে ফেলে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- যে বায়ু আল্লাহর রহমত হিসেবে পরিচিত এবং মেঘমালা বয়ে এনে আমাদের জন্য বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ভূপৃষ্ঠে প্রাণের সঞ্চার করে সেই বায়ুই কখনো কখনো আল্লাহর ক্রোধের হাতিয়ারে পরিণত হয় এবং অপরাধীদের লণ্ডভণ্ড ও ধ্বংস করে দেয়।

২- পানি ও বাতাস প্রাকৃতিক বস্তু হলেও এগুলো আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে এবং তাঁর ইচ্ছায় জালিমদেরকে গ্রাস করে নেয়।

সূরা জারিয়াতের ৪৩ থেকে ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَفِی ثَمُودَ إِذْ قِیلَ لَهُمْ تَمَتَّعُوا حَتَّى حِینٍ ﴿٤٣﴾ فَعَتَوْا عَنْ أَمْرِ رَبِّهِمْ فَأَخَذَتْهُمُ الصَّاعِقَةُ وَهُمْ یَنْظُرُونَ ﴿٤٤﴾ فَمَا اسْتَطَاعُوا مِنْ قِیَامٍ وَمَا کَانُوا مُنْتَصِرِینَ ﴿٤٥﴾ وَقَوْمَ نُوحٍ مِنْ قَبْلُ إِنَّهُمْ کَانُوا قَوْمًا فَاسِقِینَ ﴿٤٦﴾

“আরও [নিদর্শন রয়েছে] সামুদ জাতির বৃত্তান্তেও, যখন তাদেরকে বলা হয়েছিল: [জীবনটাকে] উপভোগ করে নাও একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত [যা তিনদিনের বেশি ছিল না]।” (৫১: ৪৩)

“তারা তাদের প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল; ফলে তাদের চোখের সামনে তাদের প্রতি বজ্রাঘাত হল।” (৫১: ৪৪)

“অতঃপর তাদের যেমন উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না তেমনি আত্মরক্ষা করার মতো অবস্থাও তাদের ছিল না।” (৫১: ৪৫)

“তাদের পূর্বে [আমি ধ্বংস করেছি] নূহের সম্প্রদায়কে, নিশ্চয় তারা ছিল সত্যত্যাগী  ও অবাধ্য সম্প্রদায়।” (৫১: ৪৬)

হযরত সালেহ (আ.)কে আল্লাহ তায়ালা সামুদ জাতিকে হেদায়েত করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই জাতির লোকজন নবীকে মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনা দেখাতে বলল। তারা বলল: পারলে পাহাড় ভেদ করে একটি উট বের করে দেখাও। হযরত সালেহ তাদেরকে বললেন: আমি যদি এটা দেখাতে পারি এবং তারপরও যদি তোমরা ঈমান না আনো তাহলে কিন্তু ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সামুদ জাতির লোকজন ভাবতেই পারেনি এমন একটি অসম্ভব বিষয় বাস্তব হবে। তাই তারা তাদের দাবিতে অটল থাকল।

এ অবস্থায় আল্লাহর ইচ্ছায় পাহাড় ফেটে একটি বিশালাকৃতির উট বেরিয়ে এল। কিন্তু জাতির দুষ্ট মানুষগুলো আল্লাহর নবীকে স্বীকার করে নেওয়ার পরিবর্তে উটটিকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। আল্লাহর পাঠানো উটটি হত্যা করার পরও আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তওবা করার জন্য তিন দিন সময় দিলেন। কিন্তু ওই তিন দিনেও তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করায় এমন ভয়ানক বজ্রপাতে তারা ধ্বংস হয়ে গেল যে, কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত পেল না।  একইভাবে হযরত নূহ (আ.) তাঁর জাতির কাছে শত শত বছর ধরে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া সত্ত্বেও খুব অল্প সংখ্যক মানুষ ঈমান এনেছিল। বেশিরভাগ মানুষ কুফর ও মূর্তিপূজায় লিপ্ত থাকায় সেখানেও আল্লাহ তায়ালা তুফান ও ভয়াবহ প্লাবন পাঠিয়ে হযরত নূহ (আ.)-এর জাতিকেও ধ্বংস করে দেন।

এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মহান আল্লাহ গোনাহগার বান্দাদের তওবা করে অনুতপ্ত হয়ে তাঁর কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেন। কিন্তু তারা যদি ফিরে না যায় তাহলে দুনিয়া কিংবা আখিরাতে তাদেরকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

২- যেসব জাতি অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে সংশোধন না করে তারাই আবার পরবর্তী জাতিগুলোর জন্য শিক্ষা হয়ে যায়।

৩- পানি, বাতাস ও বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক বিষয়গুলো আল্লাহর নির্দেশ চলে এবং কখনও কখনও অপরাধী জাতিগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়ার হাতিয়ারে পরিণত হয়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ