রংধনু আসর: পরোপকারের গল্প
রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদের সঙ্গে আছি আমি নাসির মাহমুদ এবং আমি আকতার জাহান।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই অন্যের বিপদে-আপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দাও! অন্যজনের বিপদে এগিয়ে আসা, পাশে দাঁড়ানো, সহমর্মী হওয়া কিংবা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেষ্টা করাই হচ্ছে মনুষ্যত্ব।
সত্যি বলতে কী, মানুষের সদ্গুণাবলির অন্যতম হচ্ছে পরোপকার। এটি একটি মহৎ গুণ। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা থেকেই এই গুণটি উৎসারিত। যারা পরের উপকার করে তারা কখনও নিজের চিন্তা করে না। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করার মাধ্যমেই সে তৃপ্তি খুঁজে পায়। কেবল মানুষই নয়, আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টিও পরের উপকার করে। কবি রজনিকান্ত সেন তার ‘পরোপকার’ কবিতায় এ সম্পর্কে লিখেছেন-
নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্ন দান।
বন্ধুরা, এই কবিতা থেকে তোমরা নিশ্চয়ই পরোপকারের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছো। পবিত্র কুরআনেও অভাবগ্রস্তদের দান খয়রাত ও সাহায্য সহযোগিতা করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহান আল্লাহতাআলা বলেছেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে।’ (সুরা-৩ আলে-ইমরান, আয়াত: ১১০)।
এ বিষয়ে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি সদয় হও, তাহলে আসমানের মালিক আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’ মূলত এ কারণেই রাসূল (সা.) গরীব-দুঃখী ও অসহায় মানুষদের সাহায্য করার জন্য যাকাতভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলেছিলেন। রাসূলের পর অন্যান্য মুসলিম শাসকরাও অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্যে বায়তুলমালের অর্থ ব্যয় করতেন।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো যে, পরোপকার সম্পর্কে আজ আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এতে থাকবে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং দুটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। আশাকরি আমাদের আজকের আয়োজনও তোমাদের ভালো লাগবে।

অনেক দিন আগে আরব দেশে বাস করতো এক খ্রিস্টান। যুবক বয়সে সে পরিশ্রম করে সংসার চালাতো। শেষ বয়সে এসে তার দুটি চোখই নষ্ট হয়ে গেল। তরুণ বয়সে উপার্জন করলেও ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য সে কোন সঞ্চয় করেনি। তাই বুড়ো বয়সে এসে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া তার আর কোন উপায় রইল না।
তখন আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাসনকাল। একদিন ঐ বুড়ো লোকটি রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষা করছিল। এমন সময় হযরত আলী সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ভিক্ষুককে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। আশপাশের লোকজনের কাছে জানতে তিনি চাইলেন,কী ব্যাপার! এই লোকটি ভিক্ষা করছে কেন?
সবাই জবাব দিল, এই লোকটি একজন খ্রিস্টান। চোখে দেখে না বলে কাজ করতে পারে না। তাছাড়া শরীরে আগের মত জোরও পায় না। তাই ভিক্ষা করছে।
হযরত আলী জানতে চাইলেন, লোকটার ছেলেপুলে নাই?
লোকজন জানালো: তার কোনো ছেলেপুলে নাই। তারা এ কথাও জানালো যে, তরুণ বয়সে সে খুব কর্মঠ ছিল। তখন সে রোজগার করে সংসার চালাত। কিন্তু বোকা লোকটি ভবিষ্যতের জন্য কোন সঞ্চয় করেনি। যা রোজগার করেছে তাই শেষ করে ফেলেছে। বুড়ো বয়সে এখন পস্তাচ্ছে। এখন ভিক্ষা না করে উপায় কি বলুন?
এসব কথা শুনে আমিরুল মোমেনীন বিস্ময় প্রকাশ করলেন। জনগণের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘এই লোকটার যখন শক্তি-সামর্থ ছিল তখন তোমরা তার প্রশংসা করেছো, তার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিয়েছে। আর এখন সে বুড়ো- অসহায় হয়ে যাওয়ায় তোমরা তাকে এভাবে ত্যাগ করবে? জোয়ানকালে তার কাছ থেকে যথেষ্ট সেবা আদায় করেছো কিন্তু এখন তার বিপদের সময় সে কোন সাহায্য পাবে না-এটা তো হতে পারে না। সে তো ইসলামী রাষ্ট্রের একজন নাগরিক। তোমাদের মত সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার তারও আছে। সে কোন্ ধর্মের অনুসারী তাতে কিছু যায় আসে না।’
এসব কথা বলার পর হযরত আলী তখনই সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মচারীকে আদেশ দিলেন, ঐ বৃদ্ধ লোকটির আজীবন পেনশনের ব্যবস্থা করতে।
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে পরোপকারের গুরুত্ব্ সম্পর্কে একটি গান। এটি লিখেছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক, সুর করেছেন জাফর সাদেক আর গেয়েছে বাংলাদেশের শিশুশিল্পী জাইমা নূর ও তার সঙ্গীরা।
চমৎকার কথা ও সুরে পরিবেশিত গানটি থেকে অপরের প্রতি সদয় হওয়ার গুরুত্ব জানলাম জানলাম। তবে অন্যের উপকার করার পর তা নিয়ে খোঁটা দেওয়া যাবে না। পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ২৬৪ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, 'হে মুমিনগণ! খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-সদকাকে নষ্ট করো না।'
পরোপকার করে অথবা দান-সদকা দিয়ে তা নিয়ে অহঙ্কার করতে নিষেধ করা হয়েছে বরং ইসলাম ধর্ম উপকার করার পর তা গোপন রাখাকে বেশি পছন্দ করে। যদি উপকার করা সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ করার পেছনে অন্যকে ভালো কাজে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে তা ভিন্ন কথা। তবে কারো উপকার শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করা উচিত, পার্থিব স্বার্থে নয়। তারাই খোঁটা দিতে পারে, যারা পার্থিব প্রাপ্তির আশায় উপকার করে। অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে এ সম্পর্কেই রয়েছে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
মুসলমানদের একটি কাফেলা একবার মক্কার দিকে যাচ্ছিল। মদিনা ও মক্কার মাঝামাঝি একটি স্থানে কাফেলা কয়েক দিনের জন্য থামে। সেখানে তারা বিশ্রাম নেয়। এ সময় ওই কাফেলায় যোগ দেয় আরেক ব্যক্তি। তিনিও মক্কায় যাবেন। ওই লোক কাফেলায় যোগ দেওয়ার পর এক ধার্মিক ব্যক্তিকে দেখে বিস্মিত হলেন। প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, ওই ধার্মিক ব্যক্তি সবার সেবা করছেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নানা কাজ সম্পন্ন করে দিচ্ছেন।
এরপর তিনি একটু দূর থেকে ধার্মিক ওই ব্যক্তিকে দেখিয়ে কাফেলার অন্য এক লোককে জিজ্ঞেস করলেন, ওই যে লোকটি আপনাদের সেবা করছেন তাকে কি আপনারা চেনেন?
কাফেলার লোকটি বলল, না, তাকেতো আমরা চিনি না। তিনি মদিনায় আমাদের কাফেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তিনি খুবই ধার্মিক ও মুক্তাকি। আমরা তাকে কাজ করতে বলিনি, তিনি নিজে থেকেই আমাদের জন্য কাজ করার এবং আমাদেরকে সহযোগিতার প্রস্তাব দেন।
নতুনকরে কাফেলায় যোগ দেওয়া ব্যক্তি এসব কথা শুনে বলেন, বুঝাই যাচ্ছে আপনারা উনাকে চেনেন না। উনাকে চিনলে আপনারা কখনোই উনাকে আপনাদের কাজ করতে দিতেন না। কারণ তিনি হলেন ইমাম হোসেন (আ.)'র সন্তান ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.)।
এ কথা জানতে পেরে সবার মধ্যে এক ধরণের অপরাধবোধ জন্ম নিল। তারা দ্রুত ইমাম জয়নুল আবেদিনের কাছে গেলেন ক্ষমা চাইতে। কাফেলার সব লোক ইমামের কাছে গিয়ে বললেন, আপনি যদি আমাদেরকে নিজের পরিচয় দিতেন তাহলে কতই না ভালো হতো। আমরাতো আপনার সঙ্গে বেয়াদবি করে বড় ধরণের পাপও করে ফেলতে পারতাম!
এসব কথা শুনে ইমাম জয়নুল আবেদিন বলেন, "আমি ইচ্ছাকৃতভাবে আপনাদের কাফেলায় যোগ দিয়েছি কারণ আপনারা আমাকে চিনতেন না। কারণ আমি মাঝে মধ্যেই এমন সব ব্যক্তির সঙ্গে সফর করি যারা আমাকে চেনেন। মহানবী (স.)'র আত্মীয় হওয়ার কারণে তারা আমার সঙ্গে সদাচরণ করেন এবং আদর-আপ্যায়ন করেন। তারা আমাকে কোনো কাজ বা সেবাই করতে দেন না। এ কারণে আমি এমন সফরসঙ্গী বেছে নিয়েছিলাম যারা আমাকে চেনেন না। আমি সফরসঙ্গীদের সেবা করে কল্যাণের অংশীদার হতে চেয়েছিলাম।"
বন্ধুরা, দেখলেতো ইমাম জয়নুল আবেদিন কেমন পরোপকারি ছিলেন! ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনাই রয়েছে যেখানে এটা স্পষ্ট যে, প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তিরা অন্যের উপকার করার জন্য সব সময় সচেষ্ট ছিলেন এবং তারা উপকার করার পর খোঁটা দেওয়াতো দূরের কথা বরং তা গোপন করার চেষ্টা করতেন। আশা করি তোমরাও পরোপকার করার ক্ষেত্রে এসব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। কাউকে কখনো খোঁটা দিয়ে কথা বলবে না- কেমন!
কবি মতিউর রহমান মল্লিকের লেখা এবং মশিউর রহমানের সুরে গানটি শুনলে। গানটি গেয়েছে বাংলাদেশি শিশুশিল্পী তাসফিয়া জাহান তাহিয়া। আশা করি গানের শিক্ষা তোমাদের জীবনে কাজে লাগাবে।
তো বন্ধুরা, দেখতে দেখতে আমাদের সবগুলো আয়োজন এক এক করে ফুরিয়ে এলো। তোমরা যারা এ আসরে অংশ নিতে চাও- তারা তোমাদের টেলিফোন অথবা মোবাইল নম্বর লিখে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দাও। আমরাই টেলিফোন করে তোমাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার ব্যবস্থা করবো। তো, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো আগামী আসরে।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।