অক্টোবর ২০, ২০২২ ১৮:০৬ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের খ্যাতনামা মনীষী আবু রেইহান বিরুনির নানা আবিষ্কার ও গবেষণাকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের আরেকজন প্রখ্যাত মনীষী কবি-সাহিত্যিক, গণিতবিদ, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়ামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।

ওমর খৈয়াম তার জীবনকালে বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক ও গণিতবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। চতুষ্পদী কবিতা বা রুবাইয়াত লেখার কারণে আজ সাহিত্য অঙ্গনে তিনি ইরানসহ সারা বিশ্বে খ্যাতির চূড়ায় রয়েছেন অথচ সে যুগের মানুষ এ সম্পর্কে কিছুই জানতো না। বীজগণিতের উপর ওমর খৈয়ামের রচিত গ্রন্থ প্রকাশের আগেই বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে দিনক্ষণ, মাস আর বছরের নির্ভুল হিসাব বের করার কারণে প্রাচ্যের দেশগুলোতে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।  ওমর খৈয়াম যে পঞ্জিকা তৈরি করেছিলেন তা ছিল তৎকালীন সুলতান মালিক শাহের আদেশে।  তিনি আটজন বিশেষজ্ঞ মিলে ১০৭৫ সালে প্রথম সৌর পঞ্জিকা তৈরি করেছিলেন। মালিক শাহের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় 'তারিখ জালালি'। বিশ্বখ্যাত এই মনীষী ছিলেন ইরানের সালজুক শাসনামলের। তিনি গণিতশাস্ত্র ছাড়াও সাহিত্য ও ইতিহাসবিদ হিসাবেও খ্যাতি অর্জন করছিলেন।

ওমর খৈয়াম বীজগণিত বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধানের পদ্ধতি বর্ণনা করায় এবং প্রাচীন গ্রিসের বড় দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের অন্যতম ইউক্লিডের পঞ্চম নীতি নিয়ে গবেষণার কারণে গণিতবিদ হিসেবে ওমর খৈয়ামের নাম জ্ঞানবিজ্ঞানের ইতিহাসে স্থান করে নেয়। মস্কো ইউনিভার্সিটির বিশিষ্ট গবেষক প্রফেসর রৌজেন ফেল্ড দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন, 'আধুনিক যুগে নিউটনের যে সূত্রটি দ্বিপদী উপপাদ্য হিসেবে বিখ্যাত, তা আসলে ওমর খৈয়ামেরই চিন্তার ফসল'।

ওমর খৈয়ামের সমাধিসৌধ

ওমর খৈয়াম ১১শ' খ্রিষ্টাব্দে ইরানের নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি একজন ধর্মবিশারদের তত্বাবধানে ফিকাহ শাস্ত্রের ওপর পড়াশোনা করেন এবং হাদিস, কোরআনের তাফসির, দর্শন, হেকমত ও জ্যোতিশাস্ত্রের ওপর জ্ঞানার্জন করেন।

আবার কেউ কেউ বলে থাকেন তিনি সরাসরি গ্রিক ভাষা থেকেও দর্শনশাস্ত্রের সাথে পরিচয় লাভ করেছিলেন। ওমর খৈয়াম খ্রিষ্টীয় ১২শতকের প্রথম দিকে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। নিশাবুরেই তার কবর ও স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ইমামযাদা মাহরুকের মাজারের পাশেই তাকে কবর দেয়া হয়েছিল।

কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ওমর খৈয়ামকে ইরানের আরেক প্রখ্যাত মনীষী ইবনে সিনার ছাত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার অনেকে বলেছেন, খৈয়াম ছিলেন ইমাম মোয়াফ্ফাক নিশাবুরির সুযোগ্য ছাত্র। তবে তিনি ইবনে সিনার ছাত্র কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে কেননা ইবনে সিনা ওমর খৈয়ামের সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন না। তবে খৈয়াম সবসময়ই ইবনে সিনাকে তার ওস্তাদ বা শিক্ষক হিসেবে মনে করতেন। তার এ মনে করাটা ছিল আত্মিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে।

আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসের জনক হিসেবে পরিচিত জর্জ শার্টন তার এক বইয়ে ওমর খৈয়ামকে মধ্যযুগের অন্যতম বড় গণিতবিদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'ওমর খৈয়াম বীজগণিতের ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধানের একটি পদ্ধতি বর্ণনা করেন। ত্রিঘাত সমীকরণ সমস্যার সমাধান প্রদানকে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান হিসেবে মানা হয়। তিনি প্রথম উপবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান বের করেন'।

গণিতশাস্ত্রে ওমর খৈয়ামের অসামান্য দখল ছিল। পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি- এ তিনটি শাখাতেই তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। বীজগণিতের ওপর রচিত তাঁর গ্রন্থের নাম "মাকালাতু ফি'ল জবরি ওয়াল মুকাবিলা"। আরবি ভাষায় রচিত এ গ্রন্থটি ছিল বর্গমূল ও ঘনমূল নিষ্কাশনের ভারতীয় পদ্ধতি এবং ত্রিকোণমিতির সাহায্যে বীজগণিতের সমীকরণ সমাধান পদ্ধতি।

ওমর খৈয়ামের গণিত-সম্বন্ধীয় মূল পুস্তকের নাম 'মুশকিলাতুল হিসাব'। এটি গাণিতিক কিছু জটিল সমস্যা-সংক্রান্ত অনুশীলনী গ্রন্থ।

ওমর খৈয়াম রচিত জ্যামিতি গ্রন্থটির নাম 'মূসাদিরাতু কিতাব-ই-উকলিদাস'। ইউক্লিডের জ্যামিতি সম্বন্ধে বহু মৌলিক ও উচ্চাঙ্গের আলোচনা আছে এতে। এ পুস্তকটির হস্তলিপি এখনও হল্যান্ডের লাইডেন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।

জালালি ক্যালেন্ডার

ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিজ্ঞানী। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও ভূগোল বিষয়েও তিনি গবেষণা ও গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। আলকেমী বা ধাতব পদার্থের রাসায়নিক বিশ্লেষণ ও মিশ্রণের হার-সংক্রান্ত বিষয়েও তিনি একটি পুস্তক রচনা করেন। এ পুস্তকটিতে ভেষজ বিজ্ঞানও স্থান পেয়েছে। এছাড়া ভূগোল বিষয়ে তিনি ঋতু পরিবর্তনের নৈসর্গিক কারণ-সংক্রান্ত একটি পুস্তক রচনা করেন। পুস্তকটির নাম ‘লাওয়াযিমু আমকিনা'।

ওমর খৈয়াম একজন বিখ্যাত দার্শনিকও ছিলেন। গ্রিক দর্শনে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। ত্রয়োদশ শতকে 'দার্শনিকদের ইতিহাস' গ্রন্থের লেখক আল-কুফতি ওমর খৈয়ামকে গ্রিক দর্শনে পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ বলে অভিহিত করেন।

ইমাম জহীরউদ্দিন বায়হাকীর বর্ণনায় উল্লেখ আছে, খ্যাতনামা দার্শনিক ইবনে সিনার গ্রন্থগুলো তিনি মনোযোগের সাথে পাঠ করতেন। দর্শনে তাঁর জ্ঞান প্রায় ইবনে সিনার সমকক্ষ ছিল। সৃষ্টি ও মানুষের নৈতিক দায়িত্বের ওপর লেখা তাঁর বিখ্যাত বইয়ের নাম 'কউন ওয়া তকলীফ'।

এছাড়া, বাস্তব জগতের অস্তিত্ব ও স্বরূপের ওপর তিনি দুই খণ্ডের মূল্যবান যে গ্রন্থ রচনা করেন তার নাম 'আর-রিসাতুল উলা ফি'ল ওজুদ'। দর্শনবিষয়ক গ্রন্থগুলো তিনি আরবি ও ফারসি উভয় ভাষাতেই রচনা করেন।

চিকিৎসাশাস্ত্রেও ওমর খৈয়াম সুপণ্ডিত ছিলেন। অথচ এ বিষয়ে তিনি কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি। তবে ওমর খৈয়ামের চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল তৎকালীন সর্বাধুনিক ইউনানি বা হেকিমি পদ্ধতি। এটা তিনি রপ্ত করেছিলেন তাঁর গুরু ইবনে সিনার চিকিৎসা-বিষয়ক গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করে। ইবনে সিনা ও তাঁর অনুসারীরা ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেন।

'শাফা' ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত আরেকটি বই। এ বইতে গণিত ছাড়াও মিউজিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আলোচনা রয়েছে। সংখ্যাতত্ত্ব নিয়েও এ বইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। যাইহোক, শেষ জীবনে ওমর খৈয়ামের মধ্যে আধ্যাত্মবোধের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। সৃষ্টিকর্তাকে তিনি অন্তরে উপলব্ধির পাশাপাশি তাঁর কাছে একান্তভাবে আত্ম-নিবেদন করেছিলেন।

ওমর খৈয়াম বিশ্বাস করতেন দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা জীবনের সঙ্গি হলেও এ জীবনের প্রতি ভালোবাসার মিষ্টি স্বাদও রয়েছে। যন্ত্রণা ও বেদনাই জীবনকে অমূল্য ও অর্থবহ করে তোলে এবং এটা প্রমাণ করে এ জীবন মূল্যহীন নয়। যে কোনো বস্তুর অন্তর্নিহিত রহস্য উৎঘাটনে ওমর খৈয়াম ধাবিত হতেন্। তিনি যে কোনো সূক্ষ্ম বিষয়ও খতিয়ে দেখতেন। কেননা তিনি ছিলেন গণিতের মানুষ, হিসাবের মানুষ। তিনি এ সিদ্ধান্ত পৌঁছেন যে একটি পরিপূর্ণ ও সফল জীবন মৃত্যু ও ধ্বংসের চাইতে উত্তম।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ