নভেম্বর ২২, ২০২২ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক-শ্রোতা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। ইরানের কালজয়ী গল্পের পসরা 'গল্প ও প্রবাদের গল্পের' আজকের আসরে আমরা শুনবো চমৎকার একটি প্রাচীন প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: আঙিনার গাছটিও গভর্নরের চোখে পড়ে না।

এই প্রবাদের পেছনে রয়েছে চমৎকার একটি গল্প। গল্পটি হলো: দুই লোকের মাঝে বেশ আন্তরিক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক ছিল। তাদের একজন নিরুপায় হয়ে দুরাঞ্চলে সফরে যেতে বাধ্য হলো। কারণ হলো পড়ালেখা। বাকি বন্ধু একাকি রয়ে গেল নিজের শহরেই। শহরের নাম মার্ভ্। মার্‌ভ শহরটি এক সময় ইরানের অন্তর্ভুক্ত একটি শহর ছিল। এখন অবশ্য এই শহরটি তুর্কমেনিস্তানে পড়েছে। বন্ধুর পড়ালেখা শেষ করে ফিরে আসার অপেক্ষায় এখানেই রয়ে গেল অপর বন্ধু।

মারভে যে বন্ধুটি রয়ে গেল তার কাজ ছিল ব্যবসা বাণিজ্য। সে ব্যবসা করে ভালোই মুনাফা করলো। মোটামুটি ধনী হয়ে গেল সে। মানুষের কাছে বিশ্বস্ত এবং সম্মানের যোগ্য হয়ে উঠলো। দুই বন্ধুর মাঝে দীর্ঘদিন যোগাযোগ না হওয়ায় একটু দূরত্ব বেড়ে গেল। এরইমাঝে মারভ শহরের গভর্নরও মারা গেল। খলিফা সিদ্ধান্ত নিলো ব্যবসায়ী বন্ধুকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেবে এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজও করে ফেললো-ব্যবসায়ীকে গভর্নর নিয়োগ দিলো। এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। গভর্নরের চারপাশে এখন বহু লোকে ভীড় লেগেই থাকে। একেক জনের একেক রকমের সমস্যা। সেইসব সমস্যার সমাধান দিতে হয় গভর্নরকে। লোকের ভীড়ের কারণে গভর্নরের সঙ্গে খুব সহজে দেখা করা সম্ভব ছিল না। সবাইকে গভর্নর বিভিন্ন আদেশ দিতো এবং গভর্নরকে সবাই খুব ভয় পেতো। এদিকে যে বন্ধুটি পড়ালেখা করার জন্য প্রবাসে গিয়েছিল সে মারভে ফিরে এলো। শিক্ষিত বন্ধুটি যখন শহরে পা রাখলো সোজা চলে গেল তার পুরোণো বন্ধুর দেখা করতে সেই পুরাতন বাসায়। প্রতিবেশিরা তাকে বললো গভর্নর তো অনেক আগেই তার এই বাসাটা বিক্রি করে দিয়ে আরও বড়সড়ো একটি বাসা কিনেছে। ওই বাসাতেই এখন সে বসবাস করছে। শিক্ষিত বন্ধু যখন শুনলো তার বন্ধু গভর্নর হয়েছে ভীষণ খুশি হয়ে গেল এবং তার নতুন বাসায় গেল দেখা করতে। সে সোজা গভর্নরের ঘরে যাবার ইচ্ছে করলো কিন্তু পারলো না। কেননা এখন তার বন্ধু গভর্নর। অনেক নিয়মনীতি মেনে তার সঙ্গে দেখা করতে হয়। বাসায় ঢোকার মুখে তাকে আটকে দিলো দারোয়ান। দারোয়ান বললো: এই যে! এভাবে মাথা নীচু করে গভর্নরের বাসায় ঢুকে যেতে চাচ্ছো! অনুমতির তোয়াক্কা করছো না!

এমনিতেই ঢুকে যাবে নাকি? কে তুমি? কী চাও?

শিক্ষিত বন্ধুটি বললো: আমি তো বাইরের কোনো মানুষ নই, অপরিচিত কেউ নই। আমি গভর্নরের অনেক পুরোনো বন্ধু। বহুদিন ওর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। সেজন্য এসেছি তার সঙ্গে দেখা করে বন্ধুত্বের বন্ধনকে তরতাজা করতে।

দারোয়ান বললো: এভাবে তো হবে না। তুমি যাও! গভর্নর বাসা থেকে বের হয়ে আসা পর্যন্ত ওই গাছটার নীচে গিয়ে বসো! তোমাকে যদি দেখে আর তাঁর যদি ইচ্ছে করে তাহলে তুমি কথা বলতে পারবে।

গভর্নরের বাসভবনের সামনে বড় একটা চেনর গাছ ছিলো। শিক্ষিত বন্ধুটি ওই গাছের নীচে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল গভর্নর বন্ধুর আসার অপেক্ষায়। কিন্তু বন্ধু তো ঘর থেকে বেরুচ্ছেই না।

অপেক্ষার পর অপেক্ষার পালা। দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যার অন্ধকার। এমন সময় খবর এলো গভর্নর বাসা থেকে বের হবার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। শিক্ষিত বন্ধু বসা থেকে এবার উঠে দাঁড়ালো এবং চেনর বৃক্ষের গোড়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। হ্যাঁ, গভর্নর বাসা থেকে বের হয়েছেন। তাঁর চারপাশে দশ-বারোজন মানুষ তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তাদের সাথে কথা বলছিলেন গভর্নর। কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন তার ঘোড়ার গাড়ি মানে টমটমের দিকে। উঠে গিয়ে বসলো এবং গাড়ি ছেড়ে দিলো। চেনর গাছের নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমান তার বন্ধুর দিকে আড় চোখেও তাকাবার ফুরসৎ তার হলো না।

মনে মনে কষ্টই পেল বেচারা। তবে ধীরে ধীরে সে নিজেকে নিজে বোঝাতে লাগলো: আশেপাশের লোকজন তাকে এদিক ওদিক তাকাবার সুযোগ দেয় নি। আঁধারও নেমে এসেছিল, হয়তো সে কারণেই সে তার বন্ধুকে দেখতে পায় নি। কাল নিশ্চয়ই সে আমাকে দেখতে পাবে। কিন্তু পরদিনও একই ঘটনা ঘটলো। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুর প্রতি গভর্নরের চোখই পড়ে নি। বেশ কয়েকদিন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। সে বুঝলো তার বন্ধুর জীবনযাপনের রূপ ও ঢঙ পুরোই পাল্টে গেছে। সুতরাং বন্ধুর সঙ্গে খুব দ্রুত দেখা হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। চেনর গাছের নীচ থেকে সোজা চলে গেল তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে-যেখানে সে শিক্ষকতা করতো। বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেল। হঠাৎ একদিন শহরে শোনা গেল গভর্নর বরখাস্ত হয়েছে। কয়েকদিন পর নতুন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হলো। এই ঘটনার পর শিক্ষিত বন্ধুটি পুরোণো বন্ধুর বাসায় গেল। আজ আর দারোয়ানের খবরদারি নেই। দরোজায় টোকা দিলো এবং ঘরে ঢুকলো। বহু বছর পর দুই বন্ধু একে অপরকে পেয়ে বেশ খুশি হলো। গভর্নর বন্ধু বললো: ভাবতেও পারি নি ভুলে যাবে এবং এতোদিন পর আসবে দেখা করতে। গভর্নর থাকা অবস্থায় যদি আসতে। শিক্ষিত বন্ধু বললো: তোমার সাথে দেখা করতে বহুবার এসেছি কিন্তু তোমার দারোয়ান তো আমাকে অনুমতিই দিলো না। তোমার বাসার বাইরের চেনর গাছের নীচে কতো যে দিন অপেক্ষা করেছি। হয়তো আসা-যাওয়ার পথে তোমার দৃষ্টি পড়বে।

কিন্তু তুমি তো তোমার আশেপাশেই তাকাতে না। গভর্নর বন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো: ঠিকই বলছো! আমি আত্মমগ্ন এবং অহংকারী হয়ে গিয়েছিলাম। আমার চারপাশের চাটুকার ছাড়া অন্য কাউকে আমার নজরেই পড়তো না। এতোই আত্মমগ্ন ছিলাম বাসার সামনের এতো বড় চেনর গাছটি পর্যন্ত চোখে পড়তো না, নীচে কে আছে তা তো দূরেরই কথা। শিক্ষত বন্ধু বললো: ঠিক আছে যা হবার তো হয়েই গেছে সামনে যেন আবার অহংকার তোমাকে অন্ধ করে না ফেলে।

এরপর থেকেই যখনই কেউ ক্ষমতাবান আর ধনী হয়ে পুরোণো বন্ধুকে ভুলে যায় তখনই এই প্রবাদটি উচ্চারণ করে: মার্ভের গভর্নরের মতো বাড়ির আঙিনার চেনর গাছটিও নজরে পড়ে না।#

পার্সটুডে/এনএম/২২

 

ট্যাগ